#নিভৃত_কুহক (পর্ব ৩)
মার্চ, ২০২২
১.
সাব্বির গুলশান এক নম্বরে ‘এম এন্ড এন’ গ্রুপের রিসেপশনে অনেকক্ষণ বসে আছে। ওর সিংহভাগ কাজ এই প্রতিষ্ঠানের সাথে। তাই ঘন ঘনই আসা হয় এদের অফিসে। একটা বড় অর্ডারের জন্য কোটেশন জমা দেবার লাস্ট ডেট আজ। সাব্বির সাধারণত একদম শেষ মুহুর্তেই কোটেশন জমা দেয়। কে কত রেট দেয় সেটা জেনে তবেই ও কোটেশনে সবচেয়ে কম রেট দেয়। আর কাজটাও বাগিয়ে নেয়। অবশ্য মূল কাজটা করে মিস এলিটা, এই অফিসেরই সাপ্লাই চেইন ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার। আগেভাগেই ওকে অন্যান্য সাপ্লায়ারের রেটগুলো জানিয়ে দেয়। অবশ্য এজন্য এলিটাকে আলাদা করে কমিশন দিতে হয়। তাতে অবশ্য সাব্বিরের সমস্যা হয় না। কমিশন দিয়েও ভালো একটা লাভ থেকে যায়। এলিটারও একটা লাভ হয়। অবশ্য এর বাইরেও এলিটার সাথে ওর আরেকটা সম্পর্ক আছে। মেয়েটা ওকে আলাদা করে পছন্দ করে। এই অফিসে প্রথম যেদিন আসে সেদিন এলিটাকে দেখে ও হা হয়ে গিয়েছিল। এত সুন্দর মেয়েটা! ধবধবে ফর্সা, চোখে কাজল দেওয়া, পিঠের উপর মেঘকালো চুল। প্রথম দিনেই ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবার সেই সাথে মনটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমন সুন্দর একটা মেয়ে ও কেন বিয়ে করতে পারল না? মুনিয়াকে অনেকটা দায়ে ঠেকেই বিয়ে করতে হয়েছিল। সে সময় ওর চাকরিটাই ওদের পরিবারকে টেনে তুলে ধরেছিল। সেদিক দিয়ে ও কৃতজ্ঞত। কিন্তু এখন অভাবের সেই দিনগুলো আর নেই। কেন যেন খুব আফসোস হয়। আরেকটু অপেক্ষা করলে ও ঠিক এলিটার মতোই এমন সুন্দর একটা মেয়ে বিয়ে করতে পারত।
এলিটা প্রথম দিনই ওর চোখে মুগ্ধতা টের পেয়েছিল, কিন্তু পাত্তা দেয়নি। সাব্বির অবশ্য নানান কায়দায় এলিটাকে বাগে এনেছে। এখন সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেছে।
এই যখন ভাবছে ঠিক তখনই এলিটাকে দেখা যায়। একটা মোহনীয় হাসি দিয়ে বলে, ‘সরি, অনেকক্ষণ বসে থাকতে হলো। কোটেশন এনেছেন?’
সাব্বির মাথা নেড়ে উজ্জ্বল মুখে বলে, ‘তোমার জন্য অনন্তকাল বসে থাকতে রাজি।’
এলিটা একবার ঝট করে পেছনে দেখে নেয় কেউ আছে কি না, তারপর একটু রাগী গলায় বলে, ‘বলেছি না, অফিসে তুমি বলবেন না। দিন কোটেশনটা। আর আগের কাজের টাকাটা কই?’
এলিটা কমিশনের টাকাগুলো ক্যাশে নেয়, কখনোই চেক নেয় না। তাতে নিরাপদ থাকে লেনদেন।
সাব্বির ব্যাগ থেকে কোটেশনের মুখবন্ধ হলুদ খামটা বের করে ওর হাতে দিতে দিতে বলে, ‘আজকেই পাবেন। বিকেলে ছুটির পর ডিসিসি মার্কেটে চলে এসেন। আমি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করব।’
কথাটা বলে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসে সাব্বির। এলিটা খামটা নিয়ে মুখ গম্ভীর করে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। সাব্বিরের এই একটা জিনিস ভালো লাগে না। প্রতিবার টাকা দেবার সময় ওর গাড়িতে করে এক দু’ঘন্টার ড্রাইভে নিয়ে যাবেই। আর সেটা বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবেই। সুযোগ বুঝে ঠিক চুমু খাবে। খুব যে একটা খারাপ লাগে তা না। কিন্তু আবার ভয়ও করে, কেউ যদি দেখে ফেলে।
সেদিন অফিস শেষে এলিটা যখন গুলশান এক নম্বরের ডিসিসি মার্কেটে আসে ততক্ষণে বিকেলের সূর্যটা হেলে পড়েছে। আজ ভীষণ গরম পড়েছে, এতটুকু রিকশায় আসতেই হাঁপিয়ে গেছে। নাহ, গাড়ি ছাড়া চলাচল করা খুব মুশকিল। এলিটা ভ্রু কুঁচকে সাব্বিরের সাদা এলিয়ন গাড়িটা খোঁজে। একটু খুঁজতে পেয়েও যায়। কিন্তু সরাসরি গাড়িতে উঠে না। একবার সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, আশেপাশে সতর্ক চোখ বোলায়। নাহ, পরিচিত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এলিটা এবার উল্টো ঘুরে হাঁটা শুরু করে। তারপর সাব্বিরের গাড়ির সামনে এসে ঝট করে দরজা খুলে সাব্বিরের পাশে বসে পড়ে। সাব্বির কোনো প্রশ্ন না করে গাড়ী চালানো শুরু করে। এলিটা যতটুকু পারে জানালার দিকে মুখের পাশটায় হাত দিয়ে ঢেকে রাখে, যাতে চট করে কেউ চিনতে না পারে।
একটু আরাম লাগছে এখন। গাড়ির ভেতর কী আরামদায়ক ঠান্ডা! চোখ বুজে আসে এলিটার। যখন চোখ খোলে দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, গাড়ি তিনশ ফিট দিয়ে পূর্বাচলের ভেতরে ঢুকছে। ঢাকার কাছে এই জায়গাটা এখন জমজমাট থাকে। শহর থেকে অনেকেই গাড়ি নিয়ে এখানে সন্ধ্যায় ভিড় জমায়৷ অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর আলো ঝলমল রেস্টুরেন্ট আছে এখানে। সাব্বির অবশ্য সেদিক যায় না। প্লটের ভেতরের রাস্তা দিয়ে এলোমেলো গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকে। আর একটা হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে চায়। জায়গাটা নির্জন, সাব্বির ক্রমশ সাহসী হয়ে উঠছে।
এলিটা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আজ ভালো লাগছে না। আমার টাকাটা দাও, আর কষ্ট করে আমাকে একটু বাসায় দিয়ে আসো।’
সাব্বির একটু মন খারাপ করে। তারপর গাড়িটা থামিয়ে ব্যাগ থেকে মোটা একটা খাম বের করে, ‘এখানে এক লাখ আছে।’
এলিটার চোখ চকচক করে ওঠে, ছোঁ মেরে খামটা নেয়। তারপর একবার ভেতরে দেখে নেয়, হাজার টাকার একটা বান্ডিল। মনটা ভালো হয়ে যায়। পৃথিবীতে এই একটা জিনিস যাতে দারুণ একটা জাদু আছে, মুহুর্তেই মন ভালো হয়ে যায়। কেন জানি সাব্বিরকে এখন আর অতটা অসহ্য মনে হচ্ছে না। টাকার লেনদেনে ও কখনোই দুই নাম্বারি করে না।
একটু আগের কড়া কথার জন্য মায়া হয় এলিটার, হাতটা ধরে বলে, ‘কী, মন খারাপ কেন?’
সাব্বির অভিমানী গলায় বলে, ‘আমাকে একটুও মায়া করো না তুমি। তোমার সাথে তো আমার শুধু এই কমিশনের সম্পর্ক না। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’
এলিটা চোখে কৌতুকের হাসি হেসে বলে, ‘তাই নাকি? তা আমার যে এত কষ্ট হয় এই গরমে, খেয়াল করো না? যদি এতই ভালোবাসো, একটা গাড়ি কিনে দাও না।’
সাব্বির হঠাৎ করে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে বলে, ‘সব কিনে দেব এলিটা।’
এলিটা এবার বাধা দেয় না, যদিও জানে এগুলো শুধু বলার জন্যই বলা। তাও ক্ষণিকের জন্য এই মিথ্যেটাও ভালো লাগতে থাকে।
এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে, সাব্বির বিরক্ত হয়ে একবার স্ক্রিনের দিকে তাকায়, মুনিয়ার ফোন। এক হাতে ফোনটা সাইলেন্ট করে আবার চুমু খেতে থাকে।
এদিকে মুনিয়া পিউকে নাস্তা দিতে দিতে ভাবছিল সাব্বির ফোনটা ধরল না। ওর প্রিয় টিকিয়া কাবাব বানিয়েছিল সন্ধ্যার নাস্তার জন্য। এলে চা টা বসিয়ে দিত। তাহলে আজও রাত হবে ফিরতে? আরেকবার ফোন দেবার পরও যখন ও ধরে না তখন হঠাৎ করেই ওর মনে হয় ও নিশ্চয়ই গাড়ি চালাচ্ছে। এবার নিজের উপরই রাগ হয়, ওর এই বার বার ফোনের জন্য না আবার একটা দূর্ঘটনা হয়ে যায়! বুকটা কেঁপে ওঠে মুনিয়ার, দ্রুত চোখ বন্ধ করে ও তিনবার দোয়া ইউনুস পড়ে। তাতে মনটা একটু শান্ত হয়।
এপ্রিল, ২০২২
২.
পিউ মনোযোগ দিয়ে অংক করছিল। এখন স্কুল বন্ধ, রোজার ছুটি চলছে। আজ ও রোজা রেখেছে, আম্মু কিছুতেই রোজা রাখতে দেবে না এই গরমে। কিন্তু ও তো এখন বড় হয়ে গেছে, ক্লাশ ফাইভে পড়ে। অনেক কিছু বুঝতে পারে। মা যে লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করে ও জানে। ও বড় হলে মাকে আর কান্না করতে হবে না।
এমন যখন ভাবছিল ঠিক তখন ও টের পায় দাদু পেছন থেকে গালে কী যেন মাখিয়ে দিচ্ছেন। ও চিৎকার করে বলে, ‘দাদু, এটা কী দিচ্ছ আমার গালে?’
দিলারা রাগী গলায় বলেন, ‘চুপ কইরা বইসা থাক। তোর জন্য দুধ দিয়া মসুর ডাল বাটাইছি। এখন থেকে প্রতিদিন মুখে দিবি, মুখ ফর্সা হইব।’
পিউ মুখ শক্ত করে বলে, ‘আমি এগুলো মুখে দেব না দাদু। আমার ফর্সা হবার দরকার নাই। তুমি যাও তো, আমার অনেক পড়া বাকি আছে।’
দিলারা মুখ বেঁকিয়ে বলেন, ‘ফর্সা হবার দরকার নাই? বুঝবি যখন বিয়া হইব না। চুপ কইরা বইসা থাক, আমি দিয়া দিতাছি।’
পিউয়ের ভীষণ রাগ হতে থাকে। কিছু হলেই দাদু এইসব হাবিজাবি কথা বলবে। আজ আম্মুকে ও বলে দেবে সব।
সেদিন বিকেলে আম্মু বাসায় এসেই ইফতার বানানো শুরু করে। পিউ ভাবে কথাটা এখন বলবে নাকি ইফতার করেই বলবে? নাহ, আম্মু এখন অনেক ব্যস্ত, আর দাদুও ডাইনিংয়ে বসে আছে। থাক, পরে চুপিচুপি বলতে হবে।
পিউ রান্নাঘরে ঘুরঘুর করতে করতে বলে, ‘আম্মু, আমি পিয়াঁজুগুলো ভেজে দেই?’
মুনিয়া হাসে, বলে, ‘উহু, তুই পারলে শরবতটা বানা।’
ডাইনিং থেকে শাশুড়ী দিলারা উঠে আসেন, তারপর কড়া গলায় বলেন, ‘এত চুলার পাড়ে ঘুরঘুর করিস না, মায়ের মতো কালা হইয়া যাইবি। এমনিতেই তো রঙ ময়লা।’
পিউ মন খারাপ করে মায়ের দিকে তাকায়। মুনিয়া সবে মাত্র পিয়াঁজু ছেড়েছে, গরম তেলে একটা ছ্যাঁত করে শব্দ হয়। সেইসাথে ওর মাথাতেও যেন শব্দটা হয়। কঠিন চোখে একবার দিলারার দিকে তাকায়, কড়া কথা বলতে যেয়েও থেমে যায়। রোজা রেখে আর ভালো লাগছে না ঝগড়া করতে। এই মহিলা সুযোগ পেলেই ওর গায়ের রঙ নিয়ে খোঁচা দেবে। নাহ, ওনাকে একবার ভালো করে বলতে হবে ব্যাপারটা।
সেদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে পিউ মায়ের কাছ ঘেঁষে বসে। আশেপাশে দাদু নেই, এই সুযোগ। ও নিচু গলায় বলে, ‘মা, দাদু আজ আমার মুখে ডাল বাটা লাগিয়ে দিয়েছে।’
মুনিয়া শুয়ে টিভি দেখছিল, ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘তাই? ভালো তো। মুখের ত্বক ভালো থাকে।’
পিউ মাথা নেড়ে বলে, ‘তুমি কিছুই জানো না। দাদু বলেছে এটা দিলে আমি নাকি ফর্সা হয়ে যাব। আর তাতে আমার বিয়ে হতে সহজ হবে।’
মুনিয়া থমকে তাকায়, তারপর শোয়া থেকে উঠে পড়ে। ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কিহ! এটা বলেছে তোর দাদু!’
পিউ জোরে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
মুনিয়ার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। পাশেই সাব্বির মোবাইলে কি যেন দেখছিল। মুনিয়া গলা তুলে বলে, ‘শুনলে, তোমার মা কি বলেছে? ওনার কি কোনো আক্কেল নেই যে পিউকে এমন কথা বলে? উনি সুযোগ পেলেই এমন বলে। আজ বিকেলেও বলেছে। কী পেয়েছে তোমার মা? আর আমার মেয়ে কি কালো?’
সাব্বির মেসেঞ্জারে এলিটাকে মেসেজ দিচ্ছিল। সেদিনের সেই সন্ধ্যাটা বার বার মনে একটা সুখের অনুভূতি দিচ্ছিল। মুনিয়ার কথায় বিরক্ত হয়, বলে, ‘অসুবিধা কী? মা তো ভালোর জন্যই করেছেন। রঙটা আরেকটু ফর্সা হলে তো ভালোই। তুমি তো মেয়ের কোনো খেয়ালই রাখছ না। মা এটুকু করছে তাও তোমার সহ্য হচ্ছে না।’
মুনিয়া কেটে কেটে বলে, ‘আমার মেয়ের জন্য তোমার মা’র কিছুই করতে হবে না। আমার মেয়ে যেমন আছে তেমনই সুন্দর।’
কথাগুলো বুঝি বেশ জোরেই বলে ফেলেছিল ও। দিলারা বেগম গজগজ করতে করতে রুমে ঢোকেন, মুখ চোখা করে বলেন, ‘নিজেকে দিয়ে বোঝ না? তোমার তো বিয়েই হচ্ছিল না। আমার ছেলে রাজি হয়েছিল বলে বেঁচে গেছ।’
মুনিয়ার মাথায় তড়াক করে রক্ত উঠে যায়, আর পারে না, চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন, আপনাদের সংসার চলছিল না তখন। আমার চাকরির পয়সার লোভেই আপনারা বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে না করলে আপনাদের রাস্তায় নামতে হতো।’
মুহুর্তে যেন আগুন ধরে যায়। দিলারা বেগমও ওর গায়ের রঙ নিয়ে যা তা বলতে থাকেন। মুনিয়াও সমানে উত্তর দিতে থাকে।
সাব্বির কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে ঝগড়াটা থামাতে, পারে না। মায়ের কথাও যেমন ঠিক আবার মুনিয়ার কথাও ঠিক। তখন বাস্তবতা এমন ছিল যে মুনিয়া এই সংসারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। পরের দিন বাজারের পয়সাও থাকত না। সেই দুঃসময়ে মুনিয়াই লোন করে টাকা এনে দিল, আর ওর ব্যবসাটা বাড়তে থাকল। এই দিক থেকে মুনিয়ার কাছে ওরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু মন থেকে কখনোই ওকে মেনে নেয়নি, নাহ, ও নিজেও না, ওর মা’ও না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এলিটার মতো সুন্দর একটা মেয়েকে ও পেল না জীবনে।
পিউ ওর রুমে পড়ার টেবিলে চুপ করে বসে মা আর দাদুর ঝগড়া শুনছিল। ইচ্ছে করছে ছুটে যেয়ে মাকে এই ঘরে নিয়ে আসে। ওকে নিয়েই যত কান্ড। ইশ কেন যে ও মাকে বলতে গেল। দাদু সারাক্ষণ গায়ের রঙ নিয়ে কথা বলবে। পিউ ওর দু’হাত সামনে মেলে ধরে, ভালো করে দেখে হাত দু’টো। এটা সাদা হলেই কি আর কালো হলেই কি? তাতে কি কেউ ওর প্রতিবার স্কুলে ফার্স্ট হওয়া আটকাতে পারবে? আর ও ফার্স্ট হয় বলেই না স্কুলের সব স্যাররা ওকে এত্ত আদর করেন। ক্লাশের সবাই ওকে আলাদা চোখে দেখে। এমন কি ওর স্কুলে বন্ধুদের মায়েরাও ওকে আদর করে, জানতে চায় ও কেমন করে পড়ে। ও পড়াশোনায় ভালো বলেই না সবাই এত আদর করে। তাহলে মা আর দাদু কেন এটা বোঝে না? নাহ, মাকে বলতে হবে, এসব নিয়ে মন খারাপ না করতে। ও এখন থেকে অনেক পড়বে যাতে ওকে নিয়ে কখনোই মা বকা না খায়, কেউ কোনো কথা শোনাতে না পারে মাকে। পিউ বই খোলে, তারপর মনোযোগ দিয়ে পড়তে বসে। মনে মনে ভাবে, ওকে আরও অনেক ভালো করতে হবে।
সেদিন রাতে মুনিয়া সাব্বিরের সাথে ঘুমোয় না। পাশের রুমে পিউয়ের সাথে এসে শুয়ে পড়ে। সাব্বিরও একবার এসে ওর মান ভাঙায় না যেন দোষটা ওরই। কালো বলেই আজ এত অবহেলা? একটু ফর্সা হলে বুঝি অনেক আদর করে মান ভাঙাত? আসলে মায়া নেই ওর জন্য।
রাত বাড়ে, কিন্তু মুনিয়ার ঘুম আসে না। বার বার চোখ জ্বালা করে কান্না পায়। সাব্বির একবারও ওর পক্ষ নিয়ে শক্তভাবে মাকে থামায়নি। ওকে এত এত কথা শোনাল, ওর গায়ের রঙ নিয়ে কতগুলো কুৎসিত কথা বলল, তাও কোনো প্রতিবাদই করল না। করবে কেন, সাব্বির নিজেও তো ওকে তাই ভাবে, ভালোওবাসে না। আচ্ছা যাক, তা না বাসুক। ওকে যা ইচ্ছে বলুক, কিন্তু পিউকে? এইটুকু একটা মেয়েকে বিয়ের কথা বলেছেন, গায়ের রঙ নিয়ে খোটা দিয়েছেন। উনি কী মানুষ! নিজের বাড়ির লোকজনই যদি এমন করে তাহলে বাইরের লোকজনের দোষ কী?
আচ্ছা, বাইরের মানুষও যদি ওর পিউকে গায়ের রঙ নিয়ে কথা শোনায়? হঠাৎ করে একটা ঘটনা মনে হতেই মুনিয়া কুঁকড়ে যায়। ও যখন ক্লাশ নাইনে বা টেনে, তখন ওর স্কুলে যাবার পথে কিছু ছেলে ওকে দেখলেই ‘কালী কালী’ বলে চিৎকার করত। আর তখন ভীষণ ভয়ে ও সিঁটিয়ে যেত। মাথা নিচু করে দৌড়ে জায়গাটা পার হয়ে যেত। আর ছেলেগুলো কেমন কুৎসিত করে হাসত। কতবার যে ও এই ঘটনাটা স্বপ্ন দেখেছে আর ভয়ে কুঁকড়ে গেছে ঘুমের ঘোরে!
ঘটনাটা মনে হতেই মুনিয়ার বুকটা কেউ চেপে ধরে যেন। ওর ছোট্ট মেয়েটাকে কেউ যদি অমন করে বলে? তাহলে যে ওর মতো সারাজীবনের জন্য ওর মনটা ছোট হয়ে যাবে, আত্মবিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলবে।
মুনিয়া পাশেই ঘুমিয়ে থাকা মেয়ের দিকে তাকায়। এমন নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ অমন বলতে পারে! মুনিয়া কপালে হাত বোলাতে বোলাতে মুখটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইচ্ছে করে মেয়েকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে, যাতে কেউ ওর সোনামানিকটাকে কিছু বলতে না পারে।
মুনিয়া সেদিন রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে রেহনুমার কথা মনে হয়। সেই উনিশ বছর আগে ওর মতোই কালো একটা মেয়ের চোখে একজন মায়া খুঁজে পেয়েছিল। মুনিয়া মনে মনে প্রার্থনা করে ওর পিউ যেন এমন একজন খুঁজে পায়।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১৮/০৪/২০২৩