বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৪৯.

0
334

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৪৯.

আজ সকাল থেকে আকাশে মেঘ করে আছে, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। মেঘে মেঘে আকাশ ঢেকে আছে। কেমন মন খারাপ করা বিষন্ন একটা দিন। এমন দিনে না চাইতেও ভালো মন খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু আজ মীরার মন অসম্ভব ভালো। তা সে বৃষ্টির জন্যই হোক বা অন্য কারনে। বোধহয় অন্য কারণটাই আসল।

আজ এক সপ্তাহ ধরে ওর জীবনটা কেমন বদলে গেছে। ঘটনাটা শুরু হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন। মীরা সকালে তৈরি হয়ে আশিকের সঙ্গে বেরিয়েছিল। রাত থেকে আশিকর আর জ্বর আসেনি, তবু মিরা ওকে জ্বরের ওষুধ খাইয়েছে। রাতে বেশ কবার জেগে উঠে পরীক্ষা ও করেছে, আবার জ্বর এলো কিনা। শেষ রাতের দিকে নিশ্চিন্ত হয়ে তবে ঘুমিয়েছে।

পুরো অনুষ্ঠান খুব চমৎকার হয়েছে। ছাত্র শিক্ষক সকলেই মহা খুশি। মীরার অবশ্য একটু মন খারাপ হয়েছিল, আশিক আবৃত্তি করতে পারিনি বলে। ওর গলা ভেঙে আছে, উপস্থাপনাই করেছে বহু কষ্টে।

আশিক একটা কালো পাঞ্জাবি পরেছে। কদিনের অসুস্থতার কারণে চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ যেমন আছে, তেমনি যত্নের চিহ্ন ও আছে। ওর অসুস্থতার কথা সবাই জানে বলে কেউই ওকে তেমন একটা কাজ করতে দিচ্ছে না। মারুফ, সুমন, রিপন সবাই অনেক পরিশ্রম করছে।
ভোরবেলা স্টেজের কাজ হয়ে যাবার পর মীরার আর কোন কাজ নেই। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর আফসিন এসেছে। টুম্পা এসেছে আরো আগেই। স্টেজ থেকে একটু দূরেই টেবিলের উপর স্ন্যাকস রাখা আছে। মিরা সবার জন্য খাবার নিচ্ছিল, তখনই শুনতে পেল দুটো ছেলে ওকে নিয়ে কথা বলছে। মীরার পেছনে তাকাতে রুচি হল না। এতদিন হয়ে গেছে এখনো সবাই এগুলো নিয়ে খিস্তি করে মজা পায়।
মীরা তাকালো না। একটু আড়ালে সরে গেল। আর তখনই টের পেল পেছন থেকে আশিক এসে ছেলে দুটোর কাঁধে হাত রেখেছে। আশিক ঠান্ডা গলায় বলল
– তোরা কোন ডিপার্টমেন্ট রে?
ছেলে গুলো একটু ঘাবড়ে গেল। আশিককে মোটামুটি সবাই চেনে। তৌহিদের সঙ্গে মারামারির ঘটনাটাও জানে। ছেলে গুলো ডিপার্টমেন্টর নাম বলল। আশিক ঠাণ্ডা গলায় বলল
– এতক্ষণ তোরা যাকে নিয়ে কথা বলছিলি, সে আমার বউ।
মীরা আর আশিকেকে নিয়ে রটনাটা সবাই জানে, কিন্তু ওদের বিয়ের খবরটা এখনো সেভাবে কেউ জানেনা। ছেলেগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। আশিক আগের চেয়ে ও শীতল গলায় বলল
-আর একবার আমার বউয়ের দিকে তাকাবি, কি আর একটা বাজে কথা বলবি তো তোদের চোখ তুলে নেব। প্রগ্রাম দেখতে এসেছিস দেখ, তা না হলে বিদায় হ।

ছেলে গুলো সুরসুর করে অডিয়েন্সের মধ্যে ঢুকে বসে পরল।আশিক আর কিছু বলল না। ভাবলেশহীন মুখ করে আবার স্টেজে ফিরে গেলো।

আড়ালে দাঁড়িয়ে মীরা পুরো ঘটনাটাই দেখল। মিরার কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। এমন করে কেউ কখনো ওর জন্য বলেনি। আগের দিনও আশিক প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু সেটা যে কোন মেয়ের ক্ষেত্রেই করত। আজ যেটা করেছে সেটা শুধুমাত্র ওর জন্য। “আমার বউ” কথাটা কেমন ওর মনের মধ্যে গেঁথে গেল। মীরা চোখ তুলে স্টেজের দিকে তাকালো। দুরে আশিরকে দেখা যাচ্ছে। মীরার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা অনুভব করছে। এরকম তো আগে কখনো হয়নি। কাল টুম্পা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল

– তুই কি আশিক ভাইয়ের প্রেমে পড়েছিস?
মীরা জবাব দেয়নি। চোখ তুলে তাকাতেও সাহস হচ্ছিল না। টুম্পা চিৎ হয়ে ঘাসের উপর উপর শুয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল
– মীরা, শেষ পর্যন্ত তুইও পড়লি? অবশ্য তোর দোষ নেই, তুই এমন লৌহমানবী বলে। তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে আরো আগেই পড়তো।
তারপর উঠে বসে বলল
– তবে আমি যদি উনার জায়গায় হতাম তবে তোর উপর তিতি বিরক্ত হয়ে যেতাম
– কেন আমি কি করেছি?
– কি করেছিস বুঝিস না? প্রথম দিন খারাপ ব্যবহার করলি, তারপর থেকে খিটখিটে মায়ের মতন আচরণ করছিস। ওষুধ খান, ভাত খান রুটি খান। যত্তসব! একটু রোমান্টিক হতে পারিস না?
মিরার মনে হয়েছিল সত্যিই ও হয়তো একটু বেশি বেশি করছে। যতক্ষণ আশিকের কাছাকাছি থাকে ততক্ষণ শুধু খিটখিট করতে থাকে। কিন্তু এরপরে ও যতবার আশিকের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছে আশিক ততটাই দূরে সরে গেছে। জ্বর সেরে যাবার পর আবার লাইব্রেরীতে ঘুমানো শুরু করেছে। জিজ্ঞেস করলে বলে পড়তে পড়তে ঘুম এসে যায়। মীরা অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর কখনো ঘুমিয়ে পড়ে নিজেই টের পায়না। তবে সকালবেলায় লাইব্রেরীর সাইডটেবিলে একটা কবিতা পায়। এ যেন একটা খেলা আশিকের। এতসব কঠিন কঠিন কবিতা মীরার মাথায় ঢোকে না। ও শুধু একটা কথাই জানে যে আশিকের আশেপাশে থাকতে ওর ভালো লাগে।ওর কথা শুনলে কেমন ঘোর লাগে। মনে হয় হাজার প্রজাপতিরা ডানা মেলছে।

গতরাতেও যখন আশিক লাইব্রেরীতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো , মীরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি
– মানে?
– মানে আমার কারনেই তো আপনাকে অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। আপনি এখানেই থাকুন। আমি চলে যাচ্ছি।

আমি তোমার কারনে যাচ্ছি কথাটা ঠিক, তবে তার মানে এই নয় যে তোমাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। তুমি আলোতে ঘুমাতে পারো না তাই আমি ওখানে থাকি। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে আবার চলে আসি।
– কোথায়? আপনি তো আর আসেন না।
– আসি, তুমি ঘুমিয়ে পড়ার পর।
– আমি তো সকালেও আপনাকে দেখি না।
– কি করে দেখবে? আমি তো তার আগেই উঠে পড়ি।
– তাহলে আপনি আমার জন্য যান না?
– না
– তাহলে এখানেই থাকুন। আমার আলোতে কোন সমস্যা হবে না
আশিক জবাব দিল না, তবে ও লাইট বন্ধ করে এসে বিছানায় বসলো। তারপর আস্তে আস্তে বলল
– ঘুমিয়ে পড় মীরা।

মীরার মনটাই ভালো হয়ে গেল। সেই মন ভালো থাকার রেশটা সকালবেলাতে রয়ে গেল। নিচে নেমে দেখল সবাই বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আফসিন রোজিনাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে এডমিট কার্ড আনতে। রোজিনা এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। হাসান সাহেবের সাথেই গাড়ি করে যাচ্ছে সবাই। যেহেতু আকাশের অবস্থা ভালো নেই , তাই একসঙ্গেই যাবে সবাই।মীরা রোজিনাকে বলল আজ দুপুরের খাবার ওই রান্না করবে ওরা যেন নিশ্চিন্তে ঘুরে আসে।

মীরা ব্রেকফাস্ট তৈরি করে টেবিলে রাখল। দুপুরে খিচুড়ি, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি করবে ঠিক করল। দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে করতেই টের পেলো ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মিরা এক ছুটে ছাদে চলে গেল। কতদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। ছাদের এই পাশটা অনেক সুন্দর। একপাশে একটা বাগান বিলাস গাছ। বাইরে থেকে খুব একটা দেখা যায় না।মীরা অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজলো। আজ যেন ওর মনের সব কষ্ট এই বৃষ্টির জলের সঙ্গে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। খুব গান গাইতে ইচ্ছা করছে কিন্তু ও গান গাইতে পারে না। মিরা আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বুজেই বলল

বৃষ্টি বৃষ্টি
জলে জলে জোনাকি
আমি সুখ যার মনে
তার নাম জানো কী ?
মেঘ মেঘ চুল তার
অভ্রের গয়না
নদী পাতা জল চোখ
ফুলসাজ আয়না।
বৃষ্টি বৃষ্টি
কঁচুপাতা কাঁচ নথ
মন ভার জানালায়
রাতদিন দিনরাত।
ঘুম নেই ঘুম নেই
ছাপজল বালিশে
হাঁটুভাঙা নোনা ঝিল
দুচোখের নালিশে।
বৃষ্টি বৃষ্টি
জলেদের চাঁদনি
দে সোনা এনে দে
মন সুখ রোশনি।
চলবে …….
আজকের কবিতাটা রুদ্র গোস্বামীর লেখা। ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে লেখা থেকে ক’দিনের জন্য বিরতি নেব ঠিক করেছিলাম। তবু আজকের পর্বটা দিলাম। পরবর্তীটা কখন দিতে পারব, ঠিক বুঝতে পারছি না। সবাই আমার জন্য একটু দোয়া করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here