বইছে আবার চৈতী হাওয়া
২১.
আজ মীরার মনটা খুব ভালো। ওর ফেসবুক পেজ থেকে প্রথম অর্ডার কনফার্ম হয়েছে। গোলাপি আর সিলভারের কম্বিনেশনে একটা সেট তৈরি করেছিল। কিছুক্ষণ আগে একজন অর্ডার কনফার্ম করেছে। মীরা খুব অপেক্ষায় ছিল, তবে এত তাড়াতাড়ি কনফার্ম হবে ভাবতেও পারেনি। ওরা ক্যাশ অন ডেলিভারি চাইছে। মিরা রিকুয়েস্ট করেছে কোথাও থেকে পিক করতে। অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হলেও রাইফেলস স্কোয়ার থেকে পিক করবে, পাঁচটার সময়। মীরা ঘড়ি দেখল। পৌনে একটা বাজে। আজকে ল্যাব নেই। লাস্ট ক্লাসটা ও ক্যান্সেল হয়েছে। তাড়াতাড়ি হলে গিয়ে একটু গুছিয়ে বেরোতে হবে। সুন্দর করে প্যাকেট করতে হবে। এটা ওর প্রথম অর্ডার। এর উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
মীরা ঠিক করল আজকে আর বাস ধরবে না রিক্সা নিয়ে হলে চলে যাবে। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেটের দিকে যাচ্ছিল, সেই সময়েই মেসেজ এল। শুভ মেসেজ করেছে। লিখেছে, জরুরী কথা আছে আজকে একসঙ্গে বসবে, একটু থাকতে। মীরা ফিরে এসে লাইব্রেরীর সামনে বসলো।
প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেছে, শুভর কোন খবর নেই। মীরা আস্তে আস্তে হেঁটে ফোর্থ ইয়ারের রুমের কাছে গেল। শুভ অন্য কয়েকটা ছেলের সঙ্গে গল্প করছে। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকতেই চোখাচোখি হল। মিরা আর একটা কথাও বলল না। উল্টো দিকে ফিরে হাঁটা ধরল। করিডোরে এসে টের পেল শুভ ওর পেছন পেছন আসছে। তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে বলল
– কি হলো? চলে যাচ্ছ কেন?
-আমার আরো আগেই যাবার কথা ছিল। তুমি থাকতে বললে তাই অনেকক্ষণ বসে ছিলাম।
-এমন কি মহা জরুরী কাজ তোমার? একটু অপেক্ষা করতে পারো না?
মীরা কঠিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আজকে একটা ভালো দিন, শুধু শুধু মেজাজ খারাপ করতে চাইছে না ও। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
-আমি বরং চলে যাচ্ছি। তুমি তোমার জরুরী কাজটা শেষ করো।
শুভ হাল ছেড়ে দিল। বলল
-আচ্ছা সরি। আসলেই একটা জরুরী বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম
-তাহলে বলো না। তোমার জরুরী কাজ শেষ হলে আমাকে ফোন দিও। আমি হলে যাচ্ছি।
-আচ্ছা আচ্ছা শোনো। কথা শেষ। চলো কোথাও বসি। লাঞ্চ করি।
-আমি এখন কোথাও যাবনা। তোমার কিছু বলার থাকলে এখানেই বল।
-কেন সমস্যা কি?
-আমাকে পাঁচটায় এক জায়গায় যেতে হবে।
-কোথায়? টিউশনি আছে?
– না
– তাহলে?
– একটা অর্ডার ডেলিভারি করতে যেতে হবে।
শুভ ভুরু কুঁচকে বলল
-কিসের অর্ডার?
– জুয়েলারির
– কোথায় ডেলিভারি দিতে হবে? বাসায়?
– না বাসায় না। রাইফেলস স্কয়ার থেকে নেবে।
– তাহলে এক কাজ করি, তুমি হলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেডি হও। আমরা বরং রাইফেল স্কয়ারেই বসি।
এতক্ষণে মীরার মাথা ঠান্ডা হলো। বলল
-আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তিনটার সময় চলে এসো।
মিরা ঠিক করেছে আজ শাড়ি পড়বে। ক্যাম্পাস থেকে ফিরে স্নান সেরে নিজের ডিজাইন করা নীল কালো ব্লকের শাড়িটা বের করল। যত্ন করে সময় নিয়ে পরল।ঘন করে কাজল দিল চোখে। আর কোন প্রসাধন ব্যবহার করলো না। শুধু অক্সিডাইস আর নীল কাঠের পুঁথি দেয়া সেটটা পরল। সাজ সম্পন্ন করে আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ হল। চমৎকার মানিয়েছে শাড়ির সঙ্গে গয়নাটা। ছোট্ট করে একটা কাজলের কালো টিপও দিয়ে নিল। পরবে না পরবে না ভেবেও দস্তার চুড়ি দুটো বের করে পারে ফেলল। শুভ ফোন দিচ্ছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।
হলের গেট থেকে মীরাকে বের হতে দেখে চমকে গেল শুভ। এত অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ ওকে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। শুভ আজ ওকে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করানোর পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন তো ইচ্ছা করছে এক্ষুনি নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে। কোনদিনও যে কাজটা করেনা শুভ আজ সেটাই করল। ক্যাম্পাস থেকে রিকশা বেরোনোর পর পরই আলতো করে মীরার হাতটা ধরল। তারপর বলল
-তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে মীরা। অদ্ভুত সুন্দর।
মীরা একটু আরক্ত হল। কিছু বলল না।
রেডি হতে গিয়ে দুপুরে খাবার খেতে পারেনি মীরা, ভেবেছিল রেস্টুরেন্টে বসে কিছু খাবে। কিন্তু ওকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই শুভ বার্গার অর্ডার করেছে। বিশাল সাইজের এই বস্তু সামনে নিয়ে বসে আছে মীরা। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। প্রথমত বার্গার খেতে ওর ভালো লাগেনা , তার উপর পাবলিক প্লেসে বসে এত বড় একটা জিনিস খাওয়াটা খুবই অস্বস্তিকর। শুভ দিব্যি খাচ্ছে। ওর মধ্যে কোন জড়তা নেই। মীরা ঘড়ি দেখল। পাঁচটা প্রায় বেজে গেছে। শুভ মুখ তুলে বললো
-কি হলো খাও
– এখন না। কাজটা আগে হোক
– তুমি এত টেনশন করছ কেন?
– টেনশন না। প্রথম অর্ডার তো, তাই একটু নার্ভাস।
-কি করে পেলে এই অর্ডার?
-ফেসবুক পেজের মাধ্যমে
– তোমার ফেসবুক পেজ আছে নাকি?
– রিসেন্টলি ওপেন করেছি , মানে আশিক ভাই করে দিয়েছে আর কি।
শুভর কপালে ভাঁজ পরল। আশিক কি আজকাল একটু বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে মীরার ব্যাপারে? পরমহুর্তেই চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল মাথা থেকে। আশিকতো এরকম সবাইকেই সাহায্য করে। তবে সেদিন টিএসসির দৃশ্যটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে হঠাৎ এত রেগে গেল কেন আশিক?
মীরার ফোন বাজছে। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল
-আমি এক্ষুনি আসছি
শুভ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বাবা মা এখন ইউকেতে আছে। শুভ ইচ্ছা করেই ওখানে এপ্লাই করেনি। মীরাকে ওর বাবা-মা মেনে নেবে না। স্কলারশিপটা হয়ে গেলেই ও মীরাকে নিয়ে চলে যাবে। তারপর এক সময় ওনারা ঠিকই মেনে নেবেন। সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হল মীরাকে রাজি করানো। মীরা ব্যাপারটার গুরুত্বই বুঝতেই চাইছে না। মুখের উপর বলাও যাচ্ছে না যে ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে মিরাদের কিছুতেই যায় না। ইউএসএর কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল শুভ, এর মধ্যে থেকে একজন সুপারভাইজার রেসপন্স করেছেন। শুভ বলেছে ও ম্যারেড। সুপারভাইজার জানিয়েছেন স্কলারশিপ কনফার্ম হলে ওয়াইফ সহ আসতে পারবে। এখন যে করেই হোক মীরাকে কনভেন্স করতে হবে।
মীরা ফিরে এসে ঝলমলে কন্ঠে বলল
-আরো দুটো অর্ডার পেয়ে গেছি। আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে।
শুভ জবাব দিল না। এরকম ফেরিওয়ালার মতন জিনিসপত্র বিক্রি করা ওর একটুও পছন্দ না। যাইহোক আপাতত কিছু বলল না। একবার এখান থেকে চলে গেলে তো আর এসব করতে পারবেনা। কথা ঘুরিয়ে বলল
-মীরা তোমার সঙ্গে একটু জরুরী কথা ছিল।
মীরা মোবাইলে কিছু একটা চেক করছিল। অন্যমনস্ক কণ্ঠ বলল
-আমাকে এখনই বেরোতে হবে। মিটিং আছে।
– কিসের মিটিং?
– একুশে ফেব্রুয়ারির প্রোগ্রামের। আশিক ভাই এইমাত্র মেসেজ করেছে।
শুভর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিছু একটা বলতে গিয়েও ও বলল না। এই মুহূর্তে মিরাকে চটানো ঠিক হবে না। মাথা ঠান্ডা করে বলল
-কোথায় মিটিং তোমাদের? চলো তোমাকে নামিয়ে দেই।
-তাহলে তো ভালই হয়। আজকে টিএসসিতে মিটিং হচ্ছে না। আশিক ভাইয়ের নতুন অফিসে যেতে বলেছে। ধানমন্ডিতে। ব্রিজের কাছে।
-চল নামিয়ে দিচ্ছি।
২২.
বাবার সঙ্গে আশিকের সম্পর্কটা অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে। ঠিক বন্ধুত্বপূর্ণ না হলেও এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়েছে দুজনের মধ্যে। বিশেষত ওই ঘটনাটার পরে। আরিফ সাহেব আশিককে বিশ্বাস করেছেন। তার উপরে নির্ভর করেছেন। এটা ভালো লেগেছে আশিকের। তাই সেদিন খেতে বসে যখন নতুন অফিসের কথাটা বললেন, আশিক মানা করতে পারল না। জায়গাটা ওনার এক ক্লায়েন্টের। আরিফ সাহেব চেয়েছিলেন আশিকের পরীক্ষা শেষ হলে তারপর থেকে শুরু করতে কিন্তু ওদের ফিনান্সিয়াল একটু ক্রাইসিস থাকাতে ওনারা আগেই দিতে চাচ্ছেন। তাছাড়া জায়গাটা বেশ সুন্দর। হাতছাড়া হয়ে যাবে এই ভেবে আরিফ সাহেব ছমাস আগেই নিয়ে নিয়েছেন। খাওয়া দাওয়ার পর আরিফ সাহেব ছেলেকে চাবিও বুঝিয়ে দিলেন।
আশিক প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও ওখানে যাবার পর ওর খুব ভালো লাগলো। অফিস বলতে যেমনটা ভেবেছিল সেরকম নয়। লেকের পাশে একটা দোতলা বাড়ি। নিচ তলায় একটা গানের স্কুল। করোনাকালীন সময়ে ছাত্রছাত্রী কমে যাওয়াতে ভাড়া দিতে পারছে না, তাই উপর তলা ভাড়া দিয়ে দিচ্ছে। পুরনো দিনের বাড়ি বলে বেশ বড় বড় রুম। সামনে বড় বারান্দা। পেছনের দিকে এক চিলতে বেলকনি। সামনের কিছুটা অংশ করা হয়নি বলে ছাদটুকু বাড়তি পাওনা। ভীষণ পছন্দ হলো আশিকের। লেখালেখির জন্য একেবারেই উপযুক্ত স্থান।
আশিকের অফিসে এসে মীরা আর শুভ দেখল মারুফ আর রিপনও চলে এসেছে। তিনজনের মধ্যে সিডি বিষয়ক তুমুল আলোচনা চলছে। শুভকে দেখে ওরা খুশি খুশি গলায় বলল
-শুভ দেখতো, কোনটা কোরলে ভালো হয়?
শুভ নির্বিকার ভাবে বলল
-তোদের যেটা ভালো লাগবে সেটাই হবে। আমি এখন যাই।
– আরে বস না। চা খেয়ে যা।
-নারে। কয়েকটা ইম্পোর্টেন্ট ইমেইল করতে হবে
-আচ্ছা যা। চিন্তা করিস না ,মিরাকে আমরা হলে পৌঁছে দেব।
শুভ বিদায় নেবার পরও মীরা দাঁড়িয়েই রইল। সামনের রুমটাতে দুটো কম্পিউটার ডেস্ক আছে। এখনো কম্পিউটার বসানো হয়নি। ভেতরের ঘরটাতে একটা বড় গোল টেবিল, চারপাশে চেয়ার দেয়া। মিটিং এর জন্য একেবারে আদর্শ। সবাই ওখানেই বসে আলোচনা করছিল। আশিক ল্যাপটপে সবাইকে ডিজাইন দেখাতে দেখাতে বলল
-মিরা বসে পরো। আজকে তোমার অংশটাই মেইন। স্টেজটা ফাইনাল করে ফেলতে হবে তারপর আমরা বাকি কাজ শুরু করব।
মীরার ডিজাইন দুটোকে ব্লেন্ড করে একটা ফাইনাল করেছে আশিক। পুরোটাই কম্পিউটারে ফটোশপে নামিয়ে নিয়েছে। মীরা কারেকশন গুলো দেখিয়ে দিচ্ছিল। আপাতত রিপন আর মারুফের কোন কাজ নেই। ওরা দুজন বলল
-তোরা থাক, আমরা একটু নিচে থেকে সিগারেট খেয়ে আসি
প্রায় ঘন্টা খানেক চলে গেল ডিজাইন ফাইনাল করাতে। শেষ করে আশিক বলল
-দারুন হয়েছে
মিরা অবশ্য তখনো স্যাটিস্ফাইড হতে পারেনি। বলল
-আর একটু ঠিক করতে হবে
– আপাতত এখানেই থাক। কাল বাকিটা করব। তুমি অনেক কষ্ট করলে মিরা। চা খাবে?
-এখানে চা কোথায় পাবেন?
-রান্নাঘরে চায়ের সরঞ্জাম আছে। চুলা নেই তবে একটা ওয়াটার হিটার আছে। আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
-আপনি বসেন। আমি বানাচ্ছি।
– রান্নাঘরে চা পাতা, দুধ, চিনি সবই পাওয়া গেল। মিরা ঝটপট চা বানিয়ে কাপে ঢালতেই হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল । আশিক ঘর থেকেই বলল
– সাবধান মীরা হাত পুড়িয়ে ফেলো না।
মীরা সাবধানে মগ দুটো নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ইউপিএস না থাকায় কম্পিউটারের আলোটাও বন্ধ হয়ে গেছে। পুরো ঘর জুড়ে আবছা অন্ধকার। আশিক কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে চমকে গেল। কে এটা!? মিরা!?
চলবে……….
আজকে দুটো পর্ব একসঙ্গে দিলাম। অনেক অনেক সুন্দর সুন্দর কমেন্ট চাই।