বইছে আবার চৈতী হাওয়া
২৩.
আশিক বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যেটা দেখছে সেটা সত্যি! দুই হাতে চায়ের মগ নিয়ে, শাড়ি সামলে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছিল মীরার। মীরা বলল,
– আপনার এখানে মোমবাতি নেই, না হলে মোবাইলের টর্চটা জ্বালান।
আলো জ্বালানোর প্রয়োজন পড়লো না, তার আগেই ইলেকট্রিসিটি চলে এলো। আশিক তখনও ওই ভাবেই তাকিয়ে আছে। মীরা মগ দুটো টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল,
– আপনি কি অন্ধকারে আমাকে দেখে ভয় পেয়েছেন নাকি?
– হ্যাঁ?
মীরা হাসছে; ওর হাসিটা যে এত সুন্দর আগে কখনো লক্ষ্য করা হয়নি তো। আশিক চোখ ফিরিয়ে নিল। মীরা আশিকের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
আপনাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি আমার পেজ থেকে প্রথম অর্ডার হয়েছে এবং আজকে আরো দুটো অর্ডার পেয়েছি! আমার কি যে ভালো লাগছে; আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আশিক ভাই।
আশিক মলিন কন্ঠে বলল,
– বাহ! ভালই তো।
– আপনি এখানে কতক্ষণ আছেন?
– আমি? আছি বেশ কিছুক্ষণ, কেন?
– আসলে আমার পরশুদিন একটা পরীক্ষা আছে। আমার কাজগুলো যদি আজকেই শেষ করে ফেলতাম, তাহলে আর কালকে আসতে হতো না।
আশিকের কিছুই ভালো লাগছিল না; খুব করে চাইছিল মীরা যেন এখান থেকে চলে যায়, কিন্তু মুখের উপর এটা বলাও যাচ্ছেনা। আশিক মলিন কণ্ঠে বলল,
– আজকেই শেষ করে ফেলবে? আচ্ছা করো।
মীরা চেয়ার টেনে এগিয়ে এসে বসলো, তারপর কারেকশনগুলো দেখিয়ে দিতে লাগলো। আশিক যন্ত্রচালিতর মতন কাজ করে যাচ্ছে; খুব করে চাইছে যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে মীরাকে বিদায় দিতে। কিন্তু মীরার পছন্দ হচ্ছে না, বারবার চেঞ্জ করছে। স্টেজের ব্যাকগ্রাউন্ড এর কাজ শেষ করে মীরা বলল,
– আশিক ভাই সিঁড়িতে দুটো কালার ব্যবহার করলে কিন্তু খুব সুন্দর লাগবে।
– কিরকম?
– ফ্ল্যাট অংশটা হোয়াইট আর অন্যটা ব্ল্যাক এভাবে করলে খুব ভালো দেখাবে আর উপরের সাদা অংশটাতে আমরা কিছু আলপনা করে দেব ব্ল্যাক কালার দিয়ে, চমৎকার হবে।
– এত কিছু করতে হবে না; অনেকটা সময় নষ্ট হবে।
– করতে হবে; বেশিক্ষণ লাগবে না, আপনি দেখুন না একটু।
মীরা এগিয়ে এসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে কয়েকটা প্যাটার্ন দেখালো।
আচমকা আশিক একটা মিষ্টি গন্ধ পেল; কেমন বনফুলের মতন একটা গন্ধ, এই গন্ধটাই পেয়েছিল সেদিন। যখন রাস্তা পার হচ্ছিল দুজন, সেদিন মুখ দেখেনি ওর। অন্যদিকে চেয়েছিল, কিন্তু এই গন্ধটাই.. ঠিক মনে আছে আশিকের। আশিক আচমকা উঠে দাঁড়ালো, তারপর বলল,
– আজকে এই পর্যন্তই থাক, অনেক রাত হয়ে গেছে।
মীরা ঘড়ি দেখল; সর্বনাশ, সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। এখন আর হলে ফেরার উপায় নেই। আশিক বলল,
– চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মীরা আমতা আমতা করে বলল,
– এখন আর হলে যেতে পারবো না।
– তাহলে কোথায় যাবে?
– শ্যামলীতে আমার খালার বাসা আছে, ওখানে চলে যাব।
– আচ্ছা ঠিক আছে, চল আমি নামিয়ে দিচ্ছি।
মীরা উঠতে গিয়ে টের পেল, ওর শাড়ির আঁচলের ঝুল কিছু একটার সঙ্গে আটকে গেছে। অনেক রাত হয়ে গেছে; তাছাড়া ওর ফোনের চার্জও শেষ হয়ে গেছে। মীরা তাড়াহুড়ায় আঁচল ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আশিক ততক্ষণে দরজার কাছে পৌঁছে গেছে, পেছন ফিরে দেখল মীরা কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। মীরার ভীষণ লজ্জা লাগছে, এমনিতে ওর কারণে আশিকের এতটা সময় নষ্ট হল; এখন আবার এই শাড়ির আঁচল আটকে যাওয়ায় আরো দেরি হচ্ছে। আশিক এগিয়ে এসে বলল,
– কি হয়েছে?
মীরা জবাব দিল না। আচলের জট কিছুতেই খুলছে না; বিরক্ত লাগছে, ইচ্ছা করছে ছিড়ে ফেলতে। আশিক এগিয়ে এসে বলল,
– দেখি..
টেবিলের সাথে লেগে থাকা একটা পেরেকের সঙ্গে শাড়ির ঝুলটা আটকে ছিল। নড়বড়ে পিন; আশিক টান মেরে তুলে ফেলে বলল,
– এটা সহই নিয়ে যাও, পরে ছাড়িয়ে নিও।
দুজনে অনেকটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। আশিকের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে; মীরা দ্রুত শাড়ির আঁচল গুছিয়ে নিচ্ছে; অকারণে ওর জন্য আশিকের সময় নষ্ট হলো বলে খারাপ লাগছে। যদিও আশিকের জায়গায় অন্য কেউ হলে, ও এত রাত পর্যন্ত থাকত না। তবে আশিকের সঙ্গে কেন যেন অস্বস্তি হয় না।
হঠাৎ করে গেটের শব্দ পেয়ে দুজনেই চমকে তাকালো; দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাসেল। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে রহস্যময় হাসি। তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে আশিকের অস্বস্তি কমলো; সহজ কণ্ঠে বললো,
– আরে রাসেল এত দেরি করলি যে?
রাসেল মীরাকে দেখতে দেখতে বলল,
– সাউন্ড সিস্টেমের লোক পাইতে দেরি হয়ে গেল। নিচে আছে কথা বলবি?
আমি মীরাকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলাম। আচ্ছা দাঁড়া, কামাল চাচাকে ফোন দেই।
মীরা ততক্ষণে রেডি হয়ে গেছে; আশিক বলল,
– মীরা আর পাঁচ মিনিট সময় দাও, আমি ড্রাইভারকে আসতে বলেছি। তোমাকে গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে আসবে, সমস্যা হবে না।
আশিক ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেল। রাসেল মীরাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এত রাতে এরকম সাজসজ্জা করে এখানে আশিকের সঙ্গে কি করছিল, বোঝার চেষ্টা করছে। যদিও মুখে আন্তরিক হাসি ফুটিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। মীরা ওকে বিশেষ একটা পাত্তা দিল না; এমনিতেও এই ছেলের ভাবভঙ্গি ওর ভালো লাগে না। রাসেল একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলো; আশিকের সঙ্গে এত লদকা-লদকি, আর ওর সঙ্গে কথা বলতেও সমস্যা!
ড্রাইভার চলে এসেছে; কামাল আরিফ সাহেবের অনেক পুরনো আর বিশ্বস্ত ড্রাইভার; ওই বাড়িতেই থাকে। আশিক মীরাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে উপরে উঠে এলো। মীরাকে পৌছে দিয়ে গাড়ি আবার এখানেই আসবে; আশিককে বাড়ি নিয়ে যাবে।
সাউন্ড সিস্টেমের লোকের সঙ্গে কাজ শেষ করতে করতে ১১ টা বেজে গেল। আশিক ক্লান্ত কন্ঠে রাসেলকে বলল,
-তোকে নামিয়ে দিব?
– আরে আমার কি আর অত কপাল যে, গাছেরটাও খাব আবার তলারটাও কুড়াবো!
– মানে?
– মীরার কথা বলতেছি আর কি!
– কেন মীরা কি করেছে?
– যেখানে পাল্লা ভারী পায়, সেইখানেই ঝুইলা পড়ে…
আশিক থমথমে গলায় বলল,
– মীরা মোটেও ঐরকম মেয়ে না!
– কইছে তোরে, ফালতু শালী একটা! রাসেল ওর মনের রাগ উগড়ে দিল।
হঠাৎ করেই আশিকের মাথায় রক্ত উঠে গেল; রাসেলের কলার চেপে ধরে বলল,
– মীরাকে নিয়ে আরেকটা বাজে কথা বললে তোর মুখ আমি ভেঙ্গে দেব।
রাসেল হতভম্ব হয়ে গেল; আশিক ওর কলারে হাত দিয়েছে? ওর? তাও ঐ ফালতু মেয়েটার জন্য!
আশিক নিজেকে সামলে নিল; এতটা রিয়েক্ট করা বোধহয় উচিত হয়নি। রাসেল ওর ছোটবেলার বন্ধু। এটা সত্যি, ওর মুখ একটু খারাপ; কিন্তু ছেলে খারাপ না। কলার ছেড়ে দিয়ে বলল,
– সরি দোস্ত কিছু মনে করিস না, মাথাটা একটু গরম হয়ে আছে।
রাসেল রাগটা গিলে ফেলে মুখে একটা শুকনো হাসি ফুটিয়ে বললো,
– না ঠিক আছে।
মুখে একথা বললেও মনে মনে ঠিক করলো, এর শোধ ও তুলবেই তুলবে।
২৪.
এত রাতে মীরাকে দেখে ছোট খালা একটু অবাক হলেও খুশি হলেন ভীষণ। ছোট খালু অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গেছেন। ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে ছোট খালা একাই ছিল। মিরাকে পেয়ে ভীষণ ভালো লাগলো। মীরা এখানে প্রায়ই আসে তাই ওর কিছু জামা কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব সময়ই এখানে থাকে। ছোট খালা জানতে চাইল
-খেয়েছিস রাতে?
-না খালা , একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম
-চেঞ্জ করে আয়, ভাত দিচ্ছি
-তোমরা খেয়েছো ?
– হ্যাঁ, খাওয়া হয়ে গেছে
শাড়ি পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে সুতির সালোয়ার কামিজ পড়ে এলো মীরা। আসলেই ভীষণ খিদে পেয়েছিল, সেই কখন খেয়েছে মনে নেই; তার ওপর এতদিন পর বাড়ির খাবার। খেতে খেতে অনেক গল্প হলো ছোট খালার সঙ্গে। ছোট খালার সঙ্গে মীরার বয়সের পার্থক্য খুব বেশি নয় তাছাড়া সম্পর্কটাও বন্ধুর মতন। রেহানা বলল
– কিরে, সৌরভের শুনলাম বিয়ে ভেঙে গেছে? তোর মা তো চাইছে তোর সঙ্গে বিয়ে দিতে, তুই আপত্তি করছিস কেন?
-সৌরভ ভাই অন্য একজনকে পছন্দ করে। মা যে কেন বুঝতে চাইছে না
– তাই নাকি? ওই মেয়ে সৌরভের পছন্দের মেয়ে ছিল?
– হ্যাঁ তো
– তাহলে তো খারাপই হয়েছে। ছেলেটা নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ করেছে
-সে তো করেছেই। আমি ভেবেছিলাম বড় চাচি হয়তো ম্যানেজ করে নেবে কিন্তু মার সঙ্গে পেরে উঠছে না।
– ভাবি ফিরেছে বাপের বাড়ি থেকে?
– সেদিন তো শুনলাম সৌরভ ভাই নিয়ে এসেছে।
– তোর সঙ্গে মেজ আপার কথা হয় না?
– আমি ইচ্ছা করে করেই বলি না। সুমনার কাছ থেকে সব খবর নেই। মার সঙ্গে কথা বলতেই শুধু বিয়ের কথা বলে
– ঠিক আছে আমি বরং মেজ আপার সঙ্গে কথা বলব
– প্লিজ ছোট খালা একটু বলো না। সামনে আমার পরীক্ষা এর মধ্যে এসব ভালো লাগে বলো?
– তুই বরং এখানে এসে থাক
– আমি হলেই ঠিক আছি , এখান থেকে অনেক দূর হয়ে যায়। যাতায়াতে কষ্ট হয়। পরীক্ষা শেষ হলে আসব
ছোট খালার মেয়ে আনিয়ার বয়স দেড় বছর। শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে গেছে। ওদেরও আর ঘুমানো হলো না। চা নিয়ে বারান্দায় বসলো। গল্প চলল অনেক রাত পর্যন্ত। আনিয়া ঘুমানোর পর ছোট খালাও ঘুমাতে চলে গেলেন। মীরার ঘুম চটে গেছে। বারান্দায় বসে বসে ও ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আশিকের পেইজে ঢুকলো। একটু আগেই একটা কবিতা আপলোড করা হয়েছে। মিরা আগ্রহ নিয়ে পড়তে গিয়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
যখন আঁধারেরা নামে,
তোমার প্রতিক্ষার শোকগাথায়-
তখন আমি অর্ধনিমগ্ন ।
গলা চিপা ঘুপচি আঁধারে
স্মৃতির জাবর কাটি ।
ওই জনাকীর্ণ নিস্তব্ধতায়
তুমি মনে রেখো আমায় ।
আলোময় ওই বিশাল গোলকধাধায় হয়তো হারাবো
কিন্তু তুমি মনে রেখো আমায় ।
আবার যখন নিভে যাবে আলো ;
যখন ওই অলস আলোটাকে-
বুভুক্ষের মতো গিলবে আঁধার
“রাতজাগা পাখি”,
তুমি ভুলে যেয়ো না আমায় ।
যেদিন তোমার মনের চাতক পাখিটা
মুক্ত হয়ে উড়বে,
ওই সাদা মেঘেদের দলে-
তুমি মনে রাখবে তো আমায়!
গুটিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত
শামুকের মতো
হয়তো খোলসবন্দি হবো শীঘ্রই!
সেদিন
তুমি ভুলে যাবে নাতো আমায়?
চলবে………
আজকের কবিতার নাম “তুমি” লিখেছেন – রাজদ্বীপ দত্ত