দরজায় জোড়ে লাথি দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে তৃপ্তির চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে ড্রয়িং রুমে আনলেন রাবেয়া বেগম, তৃপ্তির চুলগুলো নিজের পাঁচ আঙুলের ভাজে পেচিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বেশ উচ্চস্বরে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন..
-নবাবজাদি এতো বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমাবি বাড়ির সব কাজ কি আমি আর আমার মেয়ে করবো? মুখপুড়ি গত বছর নিজের বাবা-মা কে খেয়েছিলি এখন এসেছিস আমাদের হারমাস জ্বালিয়ে খেতে, বাবা-মা যখন মরেছে তোর মরণটা তখন হলেও ভালো হতো তাহলে অন্তত তোর মতো অপয়া, কুলক্ষীকে আমার স্বামী বাড়িতে এনে বাড়িটাকে অপবিত্র করতেন না।
রাবেয়া বেগমের এতোসময়ের হৃদয়ভেদ করা কথা অন্যদিকে চুলের টানে অসহ্যকর ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে মুখের গোঙানী আওয়াজ আর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে তৃপ্তির। তৃপ্তির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রাবেয়া বেগমের বড় মেয়ে রেজিয়া সুলতানা, মায়ের এমন কাজে বেশ মজা পাচ্ছিলেন তিনি যা তার মুখে লেগে থাকা পৈশাচিক হাসির মাঝেই বুঝা যাচ্ছিলো।
কিছুসময় পর রাবেয়া বেগম তৃপ্তির চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে কোমরের পাশে লাথি দিয়ে নিজের থেকে তৃপ্তিকে দূরে সরিয়ে দিলেন।হঠাৎ লাথির জন্য তাল সামলাতে না পেরে সোফার পাশে রাখা টি-টেবিলের কর্নারে গিয়ে মাথা ঠেকে তৃপ্তির। কপালের কিছুঅংশ কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে তৃপ্তির এতেও যেন মা মেয়ের কোনো হেলদোল হলো না। পাশ থেকে রেজিয়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন আর তার মাকে বললেন…
-মা আজ তোমার জামাই আসবে, আর এই অপয়াকে বলো ভালোভাবে রান্না করতে, ও আবার খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন খাবার না হলে খেতে পারে না।
রাবেয়া বেগম তৃপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেন..
-এসব ন্যাকাকান্না না করে যা গিয়ে ঘরের সব কাজ শেষ কর আর আমার মেয়ে জামাইয়ের জন্য ভালোভাবে রান্না করে রাখ, একটু ভুল করেছিস যদি তাহলে তোর কপালে যে কি পরিমাণ দুঃখ আছে তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না।
কথাগুলো বলে রাবেয়া বেগম ও তার মেয়ে রুমের ভিতরে চলে গেলেন। ড্রয়িং রুমের সোফার পাশে ব্যথায় জর্জরিত হয়ে আধোশোয়া অবস্থায় তখন ও পড়ে ছিলো তৃপ্তি। বাম হাত দিয়ে নিজের ওড়না নিয়ে কেটে যাওয়া অংশে আলতো করে ওড়নাটা চেপে ধরে রক্ত পরা বন্ধ করার বৃথা চেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত করে তৃপ্তি।
কিছুসময় এভাবেই বসে থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে চোখের কোনায় জমে থাকা পানিগুলো মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে রান্নাঘরে চলে আসে, ফ্রীজ থেকে সবজি বের করে কাটতে নেয় আর আনমনে নিজের অতীতের দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকে তৃপ্তি…
১ বছর আগে…
আমি তৃপ্তি, বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। বাবা প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন আর মা গৃহীনী ছিলেন। আল্লাহর রহমতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন কাটছিলো আমাদের। আমার আনন্দে ভরা জীবনে দুঃখের কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিলো সেদিন যেদিন আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়।
বেশ মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় বাবার স্বপ্ন ছিলো আমাকে ডাক্তার বানাবেন, বাবার স্বপ্ন পূরণের পথেই নিজেকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বেশ ভালো ফলাফলের সাথে আমি আমার এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিলাম। আমার এতো ভালো ফলাফলের জন্য হাস্যোজ্জ্বল মুখে বাবা আমাকে আর মা কে সাথে নিয়ে বিকালে ঘুরতে যাবেন বললেন।
আমি খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম বাবা আমার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে বললেন সবকাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি যেন মা কে নিয়ে তৈরি হয়ে থাকি, আমিও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই তারপর বাবা স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। আমার জীবনের শেষ হাসি যেন আমি সেদিনই হেসেছিলাম। মা খুব দ্রুততার সাথে নিজের সবকাজ শেষ করে নিলেন। আমিও গোসল করে নতুন জামা পড়ে চিরুনী ফিতা নিয়ে মায়ের কাছে আসলাম চুল বেধে নিতে। মা আমার মাথায় আলতো করে বারি দিয়ে বললেন..
-এতো বড় হয়ে গেছিস এখন ও নিজের চুল নিজে বাঁধতে শিখলি না।
মায়ের এমন মিষ্টি বকাগুলোর জন্যই আমি বারবার আসি তার কাছে চুল বাঁধার বায়না নিয়ে। মায়ের এমন কথা আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বলি..
-আমার তোমার থেকে চুল বেঁধে নিতেই ভালো লাগে মা।
চুল বাঁধতে বাঁধতে মা বললেন
-আমি যখন থাকবো না তখন কে তোকে এভাবে বারবার চুল বেঁধে দিবে শুনি!
মায়ের থাকবো না কথাটি শুনে আমি থমকে যাই পিছনঘুরে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ লুকিয়ে হুহু করে কেঁদে দেই। আমার এমন কান্ডে মা হকচকিয়ে উঠেন আর বলেন..
-এই পাগলী মেয়ে কান্না থামা, আমি তো মজা করে বলছি কোথাও যাবো না তোকে রেখে।
মায়ের এমন শান্তনামূলক কথা শুনে মুখ তুলে ঠোঁট উল্টিয়ে ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলি
-আর কখনও এমন কথা বলবা না যে তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে এই বলে দিলাম।
আমার এমন বাচ্চা বাচ্চা মুখের কথা শুনে মা মুচকি হেসে দুহাতে আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলেন আর বললেন
-আচ্ছা আমার পাগলী মেয়ে আর কখনও এমন কথা বলবো না।
মায়ের এমন আদুরেসুলভ কথায় আমার সব অভিমান এক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। তারপর মা আমার চুল বাঁধার কাজ শেষ করে বললেন..
-চল এখন দুপুরের খাবার খেয়ে নিবি।
-মা,, বাবা কই?
-অনাথ বাচ্চাদের আজ দুপুরে খাওয়ানোর জন্য আয়োজন করেছেন তোর বাবা সহ স্কুলের বাকি শিক্ষকরা মিলে। সেখানেই দুপুরে তিনিও খেয়ে নিবেন জন্য আমাদের খেয়ে নিতে বলেছেন।
-ওও আচ্ছা।
খাওয়া শেষ করে বাবার আসার জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুসময় পর বাবা বাসায় আসলেন, আমরা বেড়িয়ে পড়লাম বাসা থেকে ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় আসার পর বাবা একটি অটো ঠিক করলেন অটোতে উঠে আমি বাবা-মায়ের কাছে আমার গল্পের ঝুড়ি মেলে বসি। কিছু দূর যেতেই হঠাৎ সামনে লক্ষ্য করলে আমার নিঃশ্বাস আটকে আসার মতো অবস্থা হয়।
সামনে একটি ট্রাক বেসামালিত ভাবে এদিক সেদিক করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অটোচালক অটোটিকে ব্রেক করে সাইডে নেওয়ার সুযোগটুকুও পেলেন না ট্রাকটি হাইস্প্রিডে এসে আমাদের অটোটিকে ধাক্কা দেন। আমি “বাবা” বলে জোরে চিৎকার দিয়ে গাড়ির ধাক্কায় অটো থেকে ছিটকে পরে যাই রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে। মাথায় গভীর আঘাত পাওয়ায় ঝাপসা চোখে সামনে তাকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই আর সেখানেই স্যান্সলেস হয়ে যাই।
ঙ্গান ফিরতেই নিজেকে হাসপাতালের আইসিইউ এর বেডে আবিষ্কার করি। কিছুসময় স্তব্ধ হয়ে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নেই তখনই এক্সিডেন্টের কথা মনে পরে যায়, মুখের অক্সিজেন মাক্সটি একটানে খুলে ফেলে উঠে বসতে ধরেও উঠতে পারি না বেডে পরে যাই, জোড়ে চেঁচিয়ে বাবা-মাকে ডাকতে থাকি।
আমার এমন চিৎকারে রুমের বাহিরে থাকা ডাক্তার ও কিছু নার্স আমার কেবিনে প্রবেশ করে, চারপাশে এতো মানুষজন দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে যাই আমি। ভীর ঠেলে একজন মধ্যবয়সের আঙ্কেল আমার কাছে এসে বিছানার পাশে রাখা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন, ঠান্ডা গলায় আমাকে আসস্ত দিয়ে বলেন..
-ভয় পেও না মা,তোমার কিছু হবে না তুমি একদম সেইফ আছো।
ওনার এমন শান্তগলায় বলা কথা শুনে আমি চুপ হয়ে যাই। মাথা নিচু করে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলি
-আমি মা-বাবার কাছে যাবো, উনারা কোথায়?
আমার এমন প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার মাথায় হাত রেখে বলেন
-উনারা আর বেঁচে নেই।
উনার এমন কথায় আমি স্তব্ধ হয়ে যাই, মাথা তুলে উনার দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করি, চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়ছে নিজের কথা বলার সব শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। উনি আবারও বললেন…
#চলবে……
#গল্পঃ_অন্যরকম_প্রেমানুভূতী
#Maisha_jannat_nura(লেখিকা)
#পর্ব_১
[বি-দ্রঃ গল্পের শুরুটা পরেই দয়াকরে কেও বাজে মন্তব্য করবেন না। ধৈর্য নিয়ে পড়বেন, ধন্যবাদ সবাইকে হ্যাপি রিডিং, আসসালামু আলাইকুম]