বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৪৬.
-কোথায় যাচ্ছেন?
– পাশের লাইব্রেরী রুমে, একটু পড়াশোনা করব
– এই জ্বর নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে না, ঘুমিয়ে পড়ুন। বারোটার সময় এন্টিবায়োটিকের ডোজ আছে, আমি ডেকে দেবো।
– আমি এখানে ঘুমালে, তুমি কোথায় যাবে?
– কোথায় আবার যাব? এখানেই থাকবো, রাতে যদি আবার জ্বর ওঠে।
– সমস্যা নেই, আমি ওষুধ খেয়ে নেব। তুমি ঘুমাও। তোমার উপর অনেক ধকল যাচ্ছে
– কিসের ধকল ?
– এই যে আমার জ্বরের জন্য ঘুমাতে পারছ না, এতসব রান্নাবান্না করছো।
– রান্নাবান্না আমি এমনিতেই করি, আমার ভালো লাগে, বাড়িতে থাকতেও করতাম।
– ও আচ্ছা
– শুয়ে পড়ুন। লাইট বন্ধ করে দেবো ?
আশিক আৎকে উঠে বলল
– না না, একেবারেই না
– আপনি এমন ভাবে ভয় পেয়ে গেলেন যেন মনে হল লাইট বন্ধ করলেই আমি আপনার ঘাড় মটকে দেব।
আশিক হেসে ফেলল। মীরা ও হাসলো। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের আর মাত্র দুই দিন বাকি। মীরা খুব করে চাইছে তার আগেই যেন আশিক সুস্থ হয়ে যায়। এই অনুষ্ঠানটার জন্য ও অনেক পরিশ্রম করেছে। পরিশ্রম মীরা ও করেছে কিন্তু আশিকের তুলনায় সেটা নগণ্য। তাছাড়া আশিকের এটা শেষ অনুষ্ঠান। আর একমাস পরেই ওর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু যেভাবে ও অবহেলা করছে তাতে সুস্থ হয়ে ওঠাটা মুশকিল।
– জ্বর আছে? মীরা জানতে চাইলো
– না, একেবারেই না
মিরা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ওর দৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আশিকের কথা বিশ্বাস করেনি। আসলেই করেনি, ওকে থার্মোমিটার বের করে আনতে দেখা গেল। আশিক অপ্রস্তুত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মীরা কাছে এসে বলল
– বসুন
আশিক বাধ্য ছেলের মতন বিছানায় বসলো। মীরার এই অধিকার ফলানোটা কেন যেন খুব ভালো লাগছে। মিরা জ্বর মেপে চিন্তিত কন্ঠে বলল
– ১০১। আবারো জ্বর উঠছে। আরেকটা জ্বরের ওষুধ খেয়ে নিন তো।
– আচ্ছা আমি খেয়ে নেব
– না, এখনই
– এখন না, আগে তুমি নিচে থেকে রাতের খাবার খেয়ে এসো।
মীরা কথা বাড়ালো না আবারও মনে করিয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর উপরে এসে দেখল, যা ভেবেছিল তাই ঠিক আশিক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে, এবং যথারীতি ওর জ্বর ১০৩ ছাড়িয়েছে। মীরা ওর কাপলে হাত রেখে বিরক্ত কণ্ঠে বলল
– শুনুন, ওষুধ খেয়েছেন?
আশিক অসফুটে কিছু একটা বলল বোঝা গেল না। মীরা আরো কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। আর কোন উপায় না দেখে জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আশিক এখনো প্রলাপ বকে যাচ্ছে। মীরার মাথায় হঠাৎ করেই প্রশ্নটা এলো। অনেকদিন থেকেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু ঠিক সুযোগ হচ্ছিল না। আচ্ছা, জ্বরের ঘোরে তো মানুষ মিথ্যা বলে না। মীরা একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
– শুনুন, আপনি আমাকে কেন বিয়ে করেছেন ?
আশিক আবারও বিড়বিড় করে কিছু বলল বোঝা গেল না। মীরা আরো একটু ঝুঁকে পড়ে বলল
– বলুন না
– উঁ
– কেন বিয়ে করেছেন আমাকে?
– কলঙ্ক হবে, কলঙ্ক হবে…
বলতে বলতে আশিকের গলা বুজে এলো। মীরা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। যদিও এটাই স্বাভাবিক ছিল, তবু কেন যেন মেনে নিতে পারল না। অবচেতন মনে কি ও অন্য কিছু আশা করেছিল? মীরার গলার কাছে একটা কান্না কেমন দলা পাকিয়ে উঠলো। বাম হাতে চোখ মুছে ও জলপট্টি দিয়ে যেতে লাগলো। জ্বর নামতে বেশি সময় লাগলো না। জ্বর নেমে গেলে আশিক কেমন যেন বিধ্বস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, এ কদিনে এটা বুঝে ফেলেছে মীরা।
হাতের কাজ গুছিয়ে মীরা বারান্দার চেয়ারে এসে বসলো হেলান দিয়ে। আজ আকাশে চাঁদ নেই, কেমন অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। মীরার বুকের ভেতরের অন্ধকারটা আরো জমাট বাঁধলো। তার মানে রাসেল ওকে মিথ্যে বলেছে। আশিক কখনো ওকে চায়নি। শুধু অপরাধবোধ থেকে, দয়া করে বিয়ে করেছে। মীরা প্রথমে মুখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। তারপর দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পরল।
মীরা কতক্ষণ কাঁদলো ও নিজেও জানে না। একসময় মুখ থেকে হাত সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আশিক চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। আশিক বিস্মিত কন্ঠে বলল
– তোমার কি হয়েছে মীরা? মন খারাপ?
মীরা জবাব দিল না। তাকিয়ে দেখল আশিকের পাঞ্জাবি ভিজে গেছে। বোধহয় জ্বর ছেড়েছে। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনার জামা ভিজে গেছে, চেঞ্জ করে নিন ঠান্ডা লেগে যাবে।
তারপর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে গেল । আশিক আর কিছু জানতে চাইলো না। এগিয়ে এসে বারান্দার চেয়ারে বসল। ঠান্ডা হাওয়ায় বসতে ভালো লাগছে। ঘরের ভেতর কেমন গুমোট, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মীরা আবার ফিরে এসে বলল
– চেঞ্জ না করে এখানে বসে আছেন যে। অসুখ না বাধিয়ে ছাড়বেন না, তাই না? তারপর রাগত কন্ঠে বলল
– যা ইচ্ছা করুন, আমার কথা কেন শুনবেন? আমি কে?
আশিক হতভম্ব হয়ে গেল। এই মেয়ের সমস্যা কি? আশিক বিড়বিড় করে বলল
– আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে,কলঙ্ক হবে তোর
কখন থেকে অকারণে এই লাইনগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছে। ধুর!
চলবে……….
আজকের কবিতার লাইনটা হেলাল হাফিজের হৃদয়ের ঋণ থেকে নেয়া।