বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৪৭.
মীরা আশিকের সঙ্গে চেঁচামেচি করে ওয়াশরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো, তারপর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখল আশিক ভেজা পাঞ্জাবী পাল্টে টি শার্ট পরেছে। ওয়াটার হিটারে কফির জন্য জল চাপিয়েছে। মিরাকে দেখে হালকা গলায় বলল
– কফি খাবে মীরা?
– না, এই রাত্রেবেলা কফি খাবো কেনো? এখন কফি খেলে ঘুম আসবে না
– তুমি তো এমনিতেও ঘুমাচ্ছ না
– আমি ঘুমাচ্ছি না অন্য কারণে
– কি কারণ?
– এত আলোতে আমি ঘুমাতে পারি না
– ও তাহলে আমি পাশের ঘরে গিয়ে কফি খাচ্ছি। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো
আশিক কফির মগ হাতে পাশের রুমে যেতে উদ্যত হলো।
– শুনুন, আপনার অ্যান্টিবায়োটিক খাবার সময় হয়ে গেছে
– ও আচ্ছা খাচ্ছি
– আগে কিছু খেতে হবে। কি খাবেন বলেন আমি এনে দিচ্ছি
– এতসব ঝামেলা করার দরকার নেই
– দরকার আছে। খাবারের পর খেতে বলেছে কি খাবেন বলুন?
– একটা কিছু হলেই হবে
– মুড়ি মাখিয়ে দেই?
– এত রাতে ঝামেলা হবে
– না, ঘুগনি করাই আছে। আমি নিয়ে আসছি।
মিরা ঝটপট মুড়ি মাখা বানিয়ে ফেললো। যত্ন করে বাটিতে ঢেলে উপরে ধনেপাতা কাঁচামরিচ দিয়ে গার্নিশ করল। আশিকের জন্য কিছু করতেও খুব ভালো লাগে। ও কি আশিককে একটু বেশি যত্ন করছে? আচ্ছা, এমন নয় তো যে ও আশিকের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে? আরে ধুর! মিরা মাথা নেড়ে হাসলো আপন মনেই। আগেও তো এমন ভাবেই করতো। মীরা ট্রেতে করে খাবারের বাটি, পানির গ্লাস নিয়ে উপরে চলে এল। ঘরে ঢুকে দেখল আশিক দুই মগ কফি বানিয়েছে। ওকে দেখে হালকা গলায় বলল
-একা একা খেতে ইচ্ছা করছিল না, তাই তোমার জন্য ও করলাম। তোমারটা
ডি-ক্যাফিনেটেড, ঘুমের সমস্যা হবে না।
মীরার অবশ্য এমনিতেই ইচ্ছা করছিল একটু আশিকের সঙ্গে থাকতে, তাই ও আর উচ্চবাচ্য করল না। কফির মগ নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। একটা চুমুক দিয়েই বুঝতে পারল বেশ ভালো ব্র্যান্ডের কফি। কেমন ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখল আশিক আয়েশ করে মুড়ি মাখা খাচ্ছে। ধূসর রংয়ের টি-শার্টটা এত মানিয়েছে ওকে। মীরা তাকিয়ে রইল। আশিক খেতে খেতে বলল
– মিরা, মুড়ি মাখানোর কোন কম্পিটিশন হলে তুমি নির্ঘাত চ্যাম্পিয়ন হতে
মিরা জবাব দিল না। ওর কেমন ঘুম ঘুম লাগছে। চা কফি খেলে মানুষের ঘুম পালিয়ে যায়, অথচ ওর মনে হচ্ছে চায়ের বদলে আফিম খেয়ে ফেলেছে। মীরা কফির মগ সাইড টেবিলে রেখে পা তুলে বিছানায় বসলা, তারপর বালিশে মাথা রেখে বলল
– আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি একটু ঘুমাই
আশিক ব্যস্ত হয়ে বলল
– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই লাইট বন্ধ করে দেবো? আমি পাশের ঘরে চলে যাই?
– না সমস্যা নেই
– আচ্ছা ঠিক আছে, সিলিং লাইট বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জেলে দিচ্ছি।
মীরা জবাব দিতে পারল না, তার আগেই গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে গেল। টেবিল ল্যাম্পের নরম আলোয় ওর মায়াবী মুখটা আরো মায়া-ময় লাগছে। আশিক চোখ ফেরাতে পারলো না। অপলক চেয়ে রইল।
৪৮.
– কিরে এরকম প্যাঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কেন? এখন তো মুখ থাকবে অল টাইম গ্লোয়িং।
মীরা জবাব দিলো না। মুখ ভার করে বসে রইল। মিরা হলে এসেছিল ওর কিছু জিনিসপত্র নেবে বলে। টুম্পা কে ও আসতে বলেছিল। কাল একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান। সাদা কালো শাড়ি পরতে হবে। মিরার কোন সাদা কালো শাড়ি নেই। কদিনের ব্যস্ততায় আর বেরোতে পারেনি। আজকে না কিনলেই নয়। একটু দেখেশুনে বেছে কিনতে হবে।সকাল সকাল ভালো মুডে বের হচ্ছিল, কিন্তু আসার আগেই মন মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে গেল।
– কি হল, কথা বলছিস না কেন?
– কিছু না, মাথা ধরেছে
– কেন
– ঘুম হয়নি
– এখন ঘুম না হওয়াটাই তো স্বাভাবিক
মীরা টুম্পার রসিকতা ধরতে পারল না, আনমনে বলল
-হু
– স্বীকার করছিস তাহলে ?
মীরা এবার বুঝতে পারল। কেন যেন ওর রাগ হচ্ছে না, অসম্ভব মন খারাপ লাগছে। আজ সকালে যখন ওর ঘুম ভেঙেছে কোথাও আশিককে খুঁজে পায়নি। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে বলে মিরা ঝটপট রেডি হয়ে নিচে গিয়ে দেখল তখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। হয়তো আফসিনের পরীক্ষা শেষ, তাই রোজিনা আর সকাল সকাল উঠে খাবার তৈরি করেনি। ভেবেছে আশিকে অসুস্থ তাই সবাই ঘুমিয়ে আছে। মীরা তাড়াতাড়ি দুজনের জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেলল। খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল আশিক সবে ছাদ থেকে নেমে এসেছে। মীরা বলল
– তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন, ওষুধ খেতে হবে
আশিক আর কিছু বলল না, চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগলো। মিরা যতক্ষণ কাছে থাকে ততক্ষণই ভালো লাগে। কে জানে আর কতদিন থাকবে। মিরাকে তৈরি হতে দেখে আশিক একটু অবাক হয়ে বলল
– তুমি কি কোথাও যাচ্ছ?
-জি, একটু হলে যাব, কয়েকটা জিনিস আনতে হবে। তারপর একটু মার্কেটে যাবো।
– মার্কেটে? একা যাবে?
– না, টুম্পাকে আসতে বলেছি, ওর সঙ্গে যাব
– আমি তোমার সঙ্গে যাই?
মীরা এগিয়ে এসে ওর কপালে হাত রাখলো। তারপর বলল
– আপনার জ্বর আছে, তা না হলে আপনার সঙ্গেই যেতাম। আপনি বাসায় রেস্ট নিন। কালকের অনুষ্ঠানে না হলে সমস্যা হয়ে যাবে। আমি শাড়িটা কিনেই চলে আসব। দেরি হবে না।
– শাড়ি?
– হ্যাঁ, কালকের অনুষ্ঠানের জন্য সাদাকালো শাড়ি লাগবে।
– ও আচ্ছা
বেরোনোর সময় আশিক একবার ডাকলো। মিরা এগিয়ে এসে বলল
– কিছু বলবেন?
আশিক একটু অস্বস্তি দিয়ে বলল
– আমি যদি তোমাকে শাড়ি কেনার টাকাটা দেই তুমি কি কিছু মনে করবে?
মীরা হেসে ফেলল। বলল
– মনে করব কেন?
আশিক কেমন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিল। উঠতে গেলে মীরা বলল
– কোথায় আছে বলুন, আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি
– টেবিলের উপর আমার ওয়ালেটে আছে। যা আছে নিয়ে যাও।
মিরা ওয়ালেট খুলে হতভম্ব হয়ে গেল। ভেতরে একটা মেয়ের ছবি। বিষন্ন দুটি চোখ, হাসিটা খুব মিষ্টি, কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মীরার বুক ধক করে উঠলো। চোখে জল এসে গেল। কোনোমতে চোখের জল লুকিয়ে ও বেরিয়ে গেল।
আশিক তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসে। এজন্য টুম্পাকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাহলে ওকে কেন বিয়ে করল? এমনই তার অপরাধবোধ?
– কিরে, কথা বলছিস না কেন?
মীরা মুখ তুলে তাকালো। টুম্পা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। মিরর হঠাৎ করে কেমন কান্না পেল। হাঁটুতে মুখ গুজে ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। হঠাৎ করে এভাবে কেঁদে ওঠাতে টুম্পা প্রথমে কেমন হকচকিয়ে গেল, তারপর কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বলল
– কি হয়েছে? বল না আমাকে
মীরা মুখ তুলে, চোখ মুছে বলল
– উনি অন্য কাউকে ভালোবাসে
– কি? কে বলেছে তোকে আশিক ভাই?
– না
– তাহলে?
– আমি ওনার ওয়ালেটে ছবি দেখেছি।
– আরে ধুর ওয়ালেটে কেউ গার্লফ্রেন্ডের ছবি রাখে? দেখতে কেমন?
– শাড়ি পরা, মাঝখানে সিঁথি করা, পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
মীরার হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতন মনে পরল। এই ওয়ালেটটাই উনার হাতে ছিল সেদিন। অফিসের ছাদ বারান্দায় উনি কাঁদছিলেন। মিরা থেমে থেমে বলল
– এটা নিশ্চয়ই উনার মায়ের ছবি
– এইযে দেখলি তো, হুদাই ফ্যাচফ্যাচ করছিলি
মিরা চোখ মুছে বলল
– আচ্ছা টুম্পা, সেদিন কার্জন হলে উনি তোকে কি বলেছিলেন?
– উনি গে এই কথা বলেননি। ইম্পোটেন্ট এই কথা ও বলেননি কাজেই তুই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস। অবশ্য উনি যে ইম্পোটেন্ট না এর প্রমাণ নিশ্চয়ই এতদিনে পেয়ে গেছিস।
মীরা জবাব দিল না, তাকিয়ে রইল। টুম্পা গা দুলিয়া হাসতে লাগলো।
চলবে………