বইছে আবার চৈতী হাওয়া ৬৩

0
297

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬৩

মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে অনেকগুলো মেসেজ। সবগুলোই এসেছে একটা অচেনা নাম্বার থেকে। মীরার শরীরে কেমন কাঁপুনি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে গাঁ কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। ও কম্বলটা টেনে নিয়ে আবার শুয়ে পরল। কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। শুভ ইচ্ছে করেই এইসব করছে। যদি এসব জানাজানি হয় তাহলে কি হবে? এই বাড়ীর সবাই ওকে ঘৃণা করবে।
এই বাড়িতে ও এসেছে দুই মাসের কিছু বেশি হবে। কিন্তু বাড়িটা ওর এত আপন লাগে। বিশেষ করে বাড়ীর মানুসগুলো। এসব জানলে নিশ্চই সবাই ওকে অন্য চোখে দেখবে। আর আশিক? ওকি আর আগের মতন ভালোবাসবে ওকে? মীরা একটু কেপে উঠল। এমনটা হলে ও মরে যাবে নির্ঘাত। আশিক ওর কাছ থেকে একটু দূরে থাকলেই কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে, আর যদি ওকে ছেড়ে চলে যায় তখন কি হবে?
মীরা এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে নিজেকে শক্ত করে, তারপর ফোনটা তুলে নেয়। অপর পাশ থেকে একটা আত্নবিশ্বাসী কন্ঠ ভেসে আসে
-মীরা
-জরুরি কথা আছে
-নাম্বার ব্লক করে লাভ হয়নি, তাইতো?
-তুই কিকরে বুঝলি?
-এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না ?
-তাই কি?
-হুম। তুই আশিক ভাই কে জানিয়েছিস?
-না
-কেন?
-আমার ভয় করছে। ও যদি রেগে গিয়ে আবার কোন ঝামেলা করে। যদি আবার মারামারি করে।
-ওই শালার একটু মার খাওয়ার দরকার আছে।
-সেটা আমি জানি, কিন্তু আমি ওকে কোন ঝামেলায় দেখতে চাই না। আগের কেসটাই এখনো শেষ হয়েনি। তাছাড়া পরীক্ষা চলছে। এর মধ্যে…
-হুম বুঝলাম। এখন কি নতুন নাম্বার থেকে কল দিচ্ছে?
-হ্যাঁ
-এর পর যদি আশিক ভাইকে ফোন দেয়, তখন কি করবি?
মীরা নিজের অজান্তেই কেপে উঠল। কম্বল সরিয়ে উঠে বসল। ওর সমস্ত শরীর ঘামছে? ও কাঁপা গলায় বলল
-এখন কি করব আমি?
-এত ভয় পাচ্ছিস কেন? তুই তোর নাম্বারটা চেঞ্জ করে ফেল। আর দুই দিন পরেই তো পরীক্ষা শেষ, তখন না বললি তোরা ঢাকার বাইরে যাবি, সে সময় বলে দিস। তবে একটা রিস্ক আছে। নাম্বার চেঞ্জ করলে সে আরো মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আশিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সমস্যা। তুই বরংএকটা চিঠি লেখ, আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো। শালাকে একটু ধুয়ে ও দিয়ে আসবো।
মীরা একটু আশ্বস্ত বোধ করল। বলল
-থ্যঙ্ক ইউ টুম্পা।
-এহ ঢং। হইসে এইবার ফোন রাখ। তোর জন্য এতক্ষন তুষারকে ওয়েটিং এ রাখলাম
-এই যাহ! সত্য? সরি দোস্ত।
-আবার সরি মারাস। যা ফোন রাখ।
মীরার মনটাই কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল। নিচে নেমে দেখল রোজিনা রাতের খাবা্রের আয়োজন করছে। আরিফ সাহেব রাতে রুটি খান, আফসিন মিল্ক সিরিয়াল অথবা ফ্রুট কাস্টার্ড এইসব খেয়ে থাকে। মীরার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। দুপুরে কেমন বমি বমি পাচ্ছিল তাই বিরিয়ানি খেতে পারেনি, এখনো খেতে ইচ্ছে করছে না । মজার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে। মীরা রান্নাঘরে উকি দিয়ে বলল
-আমার জন্য কয়েকটা রুটি বানিয়ে দেবে রোজিনা?
– বিরিয়ানি খাইবেন না ? দিনেও তো খাইতে পারলেন না
-খেতে ইচ্ছা করছে না
– রুটির সঙ্গে কি দিমু
-ডিম ভাজি
-বিরিয়ানির সাথে বোরহানি আর ফিরনি ও দিছিলো। আপনারা দেই?
– দাও
মীরা আয়েশ করে খেলো। সাধারণত রাতে ও এতটা খেতে পারে না। আজ কি যে হয়েছে। রাক্ষসের মতন খিদে পাচ্ছে।
খাওয়া শেষ করে মীরা ঘরে গিয়ে আশিককে ফোন দিল। আশিক সম্ভবত রাস্তায়। প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে, তেমন কিছুই শোনা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণের চেষ্টায় মীরা বুঝল ওর দেরি হবে। মিরাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলছে।
কপালে আলতো একটা স্পর্শে মীরার ঘুম ভাঙলো। আশিকের সদ্যস্নাত মুখটা দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেল ওর। আশিক আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল
-খেয়েছ রাতে?
-হু, আপনাকে খাবার দেই?
-না, আমি সন্ধ্যায় খেয়েছিলাম একটু, এখন আর খাব না ।
-কিছুই খাবেন না?
আশিক ফিচেল হাসি হেসে বলল, কিছুই খাবোনা সেটা ঠিক না।
************
আজ আশিকের পরীক্ষা শেষ। গত দুটো দিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে গেছে। এই পেপারের প্রিপারেশন ভালো ছিল না। দুদিন চোখ মুখ বন্ধ করে পড়তে হয়েছে। সকাল থেকেই অফিসে চলে আসতো। মিরাকে বারণ করে দিয়েছিল আসতে, তবু প্রতিদিন বিকেলেই ও খাবার নিয়ে এসেছে । টুকটাক গল্প করে ফিরে গেছে। এর মধ্যে আশিক ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রিপোর্ট দেখাতে কিন্তু ফোন করে জানা গেছে ডাক্তার এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে গেছে। ফিরলে তখন দেখাতে হবে।
আশিক পরীক্ষা শেষ করে অফিসে চলে এলো। অফিসের অবস্থা ভয়ংকর হয়ে আছে। চারিদিকে সিগারেটের টুকরো, এলোমেলো কাগজপত্্‌ টেবিলের উপর বই খাতা ছড়ানো। আশিক এলোমেলো জিনিস একেবারেই সহ্য করতে পারে না, কিন্তু এই দুইদিনে সময় করে উঠতে পারেনি। দ্রুত হাতে সব গোচ গাছ করতে লাগলো ও। কাল রাতের ট্রেনে ওরা সিলেট যাচ্ছে, আর হয়তো এর মধ্যে অফিসে আসা হবে না। একটু গুছিয়ে না গেলে খারাপ লাগবে।
টেবিলের উপর থেকে বইপত্র সরাতে সরাতে হঠাৎই খেয়াল করলো মীরার ডাইরিটা রাখা। কাল এসেছিল যখন সম্ভবত ফেলে গেছে। আশিক একটু কৌতুহলী হয়ে তুলে নল। প্রথম দুই এক পাতায় চোখ বুলালো। বিভিন্ন কবির কবিতা লেখা। হঠাৎ ডায়েরির ফাঁক গলে একটা কাগজ পরল মেঝেতে। আশিক তুলে নিয়ে দেখলো কাগজ নয় একটা চিঠি। একটু অবাক হয়ে ভাঁজ খুলল। কোন সম্বোধন নেই। হয়ত ওর জন্যই লিখেছে, এই জন্যই কি ফেলে গেছে ইচ্ছে করে। আশিক হাসলো একটু আপন মনে , তারপর পড়তে শুরু করল। প্রথম লাইনেই লেখা
তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলব ।
মীরা বলেছিল কোন বিশেষ দিনে ওকে তুমি বলবে । আজকে তবে সেই বিশেষ দিন ? আশিক আবারো পড়া শুরু করলো
ভেবেছিলাম সামনাসামনি বলবো কিন্তু সেটা আর ইচ্ছে হলো না। আমি আর এভাবে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোমার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধ ছিল তাই এতদিন চুপ করে ছিলাম, কিন্তু আর না। এবার একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে।
চিঠিটা পড়তে পড়তে আশিকের হাসিটা কেমন মিলিয়ে গেল। একরাশ বিষন্নতা এসে ঘিরে ধরল ওকে । মিরা তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে?
চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here