বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৩৫.

0
334

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৫.

মীরা মোবাইল বের করে সুমনাকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-এই কি সে?
– হ্যাঁ ইনিই তো। তুমি চেনো?
মীরা জবাব দিল না, তবে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন মানুষ হলে হয়তো ও এতটা নিশ্চিন্ত বোধ করতো না। এই মুহূর্তে ও বিয়ের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সকালে শুভর সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। শুভ ওর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তাতে অন্তত বিয়ের কথা বলার মতন রুচি ওর হয়নি। আর সবার মত শুভও ওর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সবার মতো সেও বিশ্বাস করেছে, ওর আর আশিকের মধ্যে কোন কিছু চলছে এবং এই কারণেই ও শুভকে বিয়ের জন্য মানা করে দিয়েছিল। মীরা ঠিক করেছিল মরে গেলেও শুভকে বিয়ের কথা বলবে না। কিন্তু বিকেলে যখন মা সৌরভের সঙ্গে বিয়ের কথা বললেন, তখন মীরা ওর সমস্ত আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে শুভকে ফোন করেছিলো। নিজের জন্য নয়, সৌরভের জন্য। মীরা জানে সৌরভ মরে গেলেও বড় চাচার মুখের উপরে কথা বলবে না, কিন্তু সারা জীবন কষ্ট পাবে। মীরা নিজেও কি কষ্ট কম পাবে? সৌরভকে বিয়ে করার কথা ও ভাবতেও পারে না। এমন নয় যে শুভর জন্য ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে শুভর আচরণগুলো ওকে অবাক করেনি, তবে সৌরভের সঙ্গে বিয়ের কথা শুনে ও এতটা কুৎসিত আচরণ করবে, এটা আশা করেনি মীরা। শুভ বলেছে, ও এরকম ছেলেই ডিজার্ভ করে। শুভকে বিয়ে করার কোন যোগ্যতা ওর নেই; আর আশিক শুধু ওকে নিয়ে ফুর্তি করবে, বিয়ে কোনদিন করতে আসবে না। আর সেই আশিক ভাই এখন ওকে বিয়ে করতে এলেন। কি অদ্ভুত! এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্য কোন ছেলে হলে মীরা হয়তো বিয়ের জন্য রাজি হতো না। কিন্তু আশিক নিশ্চয়ই ওর অবস্থাটা বুঝতে পারবে। ও তো সবই জানে, তারপরও কেন বিয়ে করতে চাইছে? অপরাধবোধ থেকে?

মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমনাকে বলল,
-বাইরে যা।
-কেন, তোমার কোন সাহায্য লাগবে না?
-কি সাহায্য করবি তুই?
-এমনি, একটু কুচিটা ধরে দিলাম..
-দরকার নেই।
– তবু একটু থাকি। একটু পর তো চলেই যাবে। সুমনার গলা ধরে এলো।
-আচ্ছা থাক।
মীরা বেশি সময় নিল না তৈরি হতে। মাগরিবের নামাজের পর ওকে নিচে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেই বিয়ে পড়ানো হবে। হালিমা বেগমের চাইতে নাসিমাকে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা গেল। মীরা স্বাভাবিকভাবেই সই করল। কারো দিকে তাকালো না। কবুল বলার সময় একবারের জন্যও ওর গলা কাপলো না।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে বেশি সময় লাগলো না। এজাজ সাহেব খুব করে চাইছিলেন আজকের রাতটা যেন সবাই এখানেই থেকে যায়, কিন্তু আরিফ সাহেব রাজি হলেন না। অনেকটা পথ যেতে হবে। উনি বললেন,
-মেয়েটাকে বাড়িতে একা রেখে এসেছি। তা নাহলে নিশ্চয়ই থাকতাম।

বিদায়ের সময় মীরা একটুও কাদলো না।। ঢাকা থেকে আসার সময় যে ব্যগটা নিয়ে এসেছিল, সেটাই গাড়িতে তুলে দেয়া হলো।

রফিক আরেকটা গাড়ি নিয়ে এসেছ। মারুফ, রফিক আর আরিফ সাহেব ওই গাড়িতেই যাচ্ছেন। আশিক আর মীরা অন্যটাতে। পুরোটা পথ মীরা একটা ঘোরের মধ্যে রইলো। একবারও চোখ তুলে তাকালো না। একটা কথাও বলল না। শেষের দিকে একটু ঝিমুনির মতন এসে গেছিল। গাড়ি যখন থামলো, একটা আলতো ঝাঁকুনিতে ওর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে ও একটু লজ্জা পেল। আশিকের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। আশিক কিছু বলল না, গাড়ি থেকে নেমে দরজা ধরে দাঁড়ালো। মীরার ঘুম তখনো কাটেনি। বাড়ির ভেতরে ঢুকে ও আশ্চর্য হয়ে গেল। একটু পুরোনো দিনের দোতলা বাড়িটা বেশ সুন্দর আর বড়। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই রোজিনা আর আফসিন ছুটে এলো। আফসিন ওর মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। ওকে না নিয়ে ওর একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। একদিকে ভাইয়ের বিয়ের আনন্দ, অন্য দিকে ওকে না নিয়ে যাওয়ার অভিমান। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল নতুন ভাবির আগমন।

ভেতরে ঢুকেই আরিফ সাহেব ঘোষণা দিলেন,
– কোন কিছু আগে থেকে ঠিক করা ছিল না, তাই তোমাদেরকে নিয়ে যেতে পারিনি। রিসেপশনের সময় সবকিছু তোমরাই করবে। এখন নতুন ভাবিকে ঘরে নিয়ে যাও।

মীরাকে আশিকের ঘরে নিয়ে বসানো হল। আফসিন আর রোজিনা ঘরে এসে ওদের কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে গেল, যদিও আরিফ সাহেব বলেছিলেন মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে এসেছে বিরক্ত না করতে। কিন্তু ওদের অতি উৎসাহে ভাটা পড়ল না। মীরার খারাপ লাগছিল না। ওরা দুজনেই ভীষণ আন্তরিক। আফসীনকে ভালো লেগে গেল মীরার। মেয়েটার ব্যক্তিত্ব একেবারেই ওর ভাইয়ের বিপরীত। খুব মায়া কাড়া এবং আদুরে স্বভাবের একটা মেয়ে। মীরার ক্লান্ত লাগছিল না, তবে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা বাড়িতে, অচেনা একটা ঘরে বসে থাকতে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আরিফ সাহেব এসে ওদের বিদায় দিলেন। মীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরিফ সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
-তোমাকে কয়েকটা কথা বলি মা। আমি জানিনা অশিক সম্পর্কে তুমি কতটুকু জানো, তবে এটুকু বলে রাখি, ও খুব চাপা স্বভাবের আর ভীষণ অভিমানী একটা ছেলে। নিজের কষ্ট কখনো কারো সঙ্গে শেয়ার করে না। ওর আশেপাশে এত বন্ধুবান্ধব থাকলেও ছেলেটা ভেতরে ভেতরে ভীষণ একা। তোমার কাছ থেকে আমার একটাই চাওয়া, চেষ্টা করো ওর বন্ধু হতে।

মীরা মাথা নিচু করেই বলল,
-জি।
আরিফ সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন,
– ঠিক আছে মা , তুমি রেস্ট নাও।
আরিফ সাহেব চলে যাবার পর মীরা চারপাশে তাকালো। ঘরটা অনেক সুন্দর এবং বড়। মীরা ব্যাগ থেকে সাধারণ সুতির সালোয়ার কামিজ বের করল। হাত মুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে নিল।

মীরার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে কিন্তু এভাবে ঘুমিয়ে পড়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। ও আশিকের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিছুতেই ঘুম ভাবটা কাটছে না। মীরা আস্তে আস্তে বারান্দার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দাঁড়াল। এত সুন্দর বারান্দা ও শুধু নাটক সিনেমাতেই দেখেছে। অনেক রকম গাছ রাখা এক পাশে। অন্য পাশে বেতের চেয়ার ছোট টি-টেবিল। মীরা ওর ক্লান্ত শরীর চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বসলো, আর ঠিক তখনই ফোনটা এলো। অচেনা নাম্বার দেখে প্রথমে ও ভাবল ধরবেনা। পরবর্তীতে মনে পরল, বড় চাচা সুমানাকে নতুন ফোন কিনে দিয়েছেন। তাড়াহুড়ায় নাম্বারটা নেয়া হয়নি। হয়তো ওই ফোন করেছে। আসার সময় খুব কাদছিল ও।

মারুফ আর সুমন ছাদে দাড়িয়ে গল্প করছিল। সুমন বাড়ি গিয়েছিল। আজ দুপুরেই ফিরেছে। ফোনে বিয়ের খবর জানতে পেরে সরাসরি বাসায় চলে এসেছে। আশিক আর রোজিনা খাবার ভর্তি ট্রে নিয়ে ছাদে উঠে দেখল ওরা বেশ হাসাহাসি করছে। আরিফ সাহেব বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করেছেন। কাচ্চি বিরিয়ানি আর বোরহানি। আশিক মীরাদের ওখানে খেতে পারেনি, কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। হঠাৎ করে ওর মনে হলো তাহলে নিশ্চয়ই মীরারও খিদে পেয়েছে।
ছাদে একটা সিরামিকের টেবিল বানানো। খাবার গুলো টেবিলের উপর রাখতে রাখতে আশিক রোজিনাকে বলল,
-তোর ভাবিকে জিজ্ঞেস করিস তো ও কিছু খাবে কিনা। লাগলে দিয়ে আসিস।
রোজিনা মাথা নেড়ে চলে গেল। সুমন মারুফের পেটের মধ্যে একটা খোঁচা দিয়ে বলল
-দেখছিস আমাদের ভাইয়ের ভাবীর জন্য কত চিন্তা।
মারুফ এগিয়ে গিয়ে খাবার নিতে নিতে বলল,
-কিসের ভাই? কিসের ভাবি? শোন আশিক মীরা কিন্তু আমার এলাকার ছোট বোন। সেই হিসেবে আমি কিন্তু তোর সম্বন্ধি। একটু রেস্পেক্ট দেখাইস ।

আশিক হাসতে হাসতে বলল,
-আচ্ছা? তুই আমার সম্বন্ধি? তাই না! যা ভাগ তুই আমার শালা। দুলাভাইয়ের প্রতি একটু রেসপেক্ট দেখা।
সুমন গ্লাসে বোরহানি ঢালতে ঢালতে বলল,
– আচ্ছা আচ্ছা, দুলাভাই শালাদের ট্রিট দিচ্ছেন কবে?

খাওয়া-দাওয়ার পর গল্প চলল বেশ কিছুক্ষণ। এক সময় মারুফ আশিকের পিঠ চাপড়ে বলল
-যান দুলাভাই, আমাদের আপা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
আশিক একটু হাসলো। কিছু বলল না। মারুফ আর সুমনকে বিদায় দিয়ে ও আস্তে আস্তে নিজের ঘরে ঢুকলো। মীরাকে অনেক কিছু বলার আছে। মীরা কি ওর কথা শুনবে? আশিকের খুব ইচ্ছা ছিল বিয়ের আগে একবার জিজ্ঞেস করার, যে ওর কোন আপত্তি আছে কিনা। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি। এখন এসব প্রশ্ন করা অর্থহীন, তবু অনেক কিছু জানার আছে ওর থেকে। অনেক কিছু বলার আছে। আশিক ঘরে ঢুকে দেখল মীরা বিছানার উপর বসে আছে। দরজা বন্ধ করে পেছন ফিরতেই মীরা তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

– খবরদার আমার কাছে আসবেন না। আপনি একটা ভন্ড মিথ্যাবাদী।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here