বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৭
– তুমি রাতে কিছু খেয়েছ মীরা?
মীরা মুখ তুলে আশিকের বুকের উপর চিবুক ঠেকিয়ে বলল
– না
– দুপুরে?
মীরা জবাব দিল না ওর বুকের মধে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে রইল।
– খাওনি তাই না?
– আপনি ও তো খাননি
আশিক অবাক হয়ে বলল
– তুমি কি করে জানলে?
– আমি জানি
– চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি
মীরা মুখ তুলে বলল
– এখন?
– কেন? সমস্যা কি?
– এখন রাত সাড়ে এগারটা বাজে। এই সময় বাইরে কোথায় যাব? এখন সব দোকান বন্ধ না?
– তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেটা সারারাত জমজমাট থাকে।
মীরা এক হাত দিয়ে আশিককে জড়িয়ে ধরে বলল
– আমার এখন কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না
– কেন? মন ভরেনি?
মীরা কিছু বলল না, আগের মতোই ওর বুকের মধে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে রইল। আশিক হাসতে হাসতে বলল
– ঠিক আছে ওখান থেকে ফিরে আসি, তারপর……
আশিক কথা শেষ করতে পারল না, মীরা এক হাতে ওর মুখ চেপে ধরে বলল
– এত খারাপ কেন আপনি?
– আরো খারাপ হবার আগেই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও
মীরা ভয়ে ভয়ে উঠে গেল। এই লোকের কোন ভরসা নেই। কখন কি বলে বসে আগে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই। মীরা উঠে আলমারি খুলল
– মীরা
– জি
– তোমার কোন কালো শাড়ি আছে?
– হ্যাঁ, কেন?
– একটা কালো শাড়ি পর তাহলে
– কালো শাড়ি কেন?
আশিক সিগারেটের প্যকেট হাতে বারান্দায় যেতে যেতে বলল
– আমার অমন টুকটুকে বউকে এই রাতের বেলা রঙ্গিন শাড়িতে বাইরে নেই কিকরে?
মীরা থমকে গেল। খুব ইচ্ছে হল দৌড়ে গিয়ে আশিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু সাহস হল না, আবার কি থেকে কি বলে বসে।
মীরা খুব যত্ন করে ধূসর পাড়ের কালো একটা সুতির শাড়ি পরল। ঘন করে কাজল দিল চোখে। ছোট্ট একটা কালো টিপ ও পরল। ভেবেছিল আশিক ওকে দেখে সুন্দর কোন মন্তব্য করবে, কিন্তু আশিক ওর দিকে ফিরেও তাকাল না। সাবধানে ওকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে, পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ছোট একটা গলি পার হলেই বড় রাস্তা। আশিক একটা রিক্সা নিয়ে নিল। রিক্সায় উঠে মীরা বলল
– ভাগ্যিস পেছনের দরজাটা ছিল। বাবা দেখতে পেলে ভীষণ রাগ করতেন।
– সমস্যা নেই। সেই স্কুল লাইফ থেকে আমি এই দরজা দিয়ে বাইরে বের হই। বাবা টের পান না।
– রাতের বেলা কেন বের হতেন?
– আমরা চার বন্ধু মিলে রাস্তায় হাটতাম। আমি, রাসেল, মামুন আর বাবু
– বাকীরা কোথায় এখন?
– মামুন দেশের বাইরে চলে গেছে আর বাবু খুলনা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মীরা হুট তুলে দেব?
– দিন
– একটা সিগারেট ধরালে কি তোমার কোন সমস্যা হবে?আশিক বাইরের দিকে তাকিয়েই জানতে চাইল।
– না, হবে না।
আশিক সময় নিয়ে সিগারেট ধরাল। তারপর বুক ভরে ধোয়া টেনে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলল
– কালো শাড়িতে তোমাকে এত সুন্দর লাগবে জানলে অন্য রঙ্গের শাড়ি পরতে বলতাম।
মীরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটার মধ্যে এত রহস্য কেন?
খাবারের দোকানে গিয়ে মীরা আরেক দফা আবাক হল। এত রাতে এত মানুষ কেন এখানে? মনেই হচ্ছে ন যে রাত। আশিক ওকে অবাক হতে দেখে বলল
– এত অবাক হচ্ছ কেন?
– এটা কোন যায়গা?
– কাজী আলাউদ্দিন রোড । হাজীর বিরিয়ানী । নাম শোননি?
– শুনেছি। কখনো দেখিনি।এত রাতে এখানে এত মানুষ আসে?
– এই পুরানো ঢাকা হল রাতের শহর কায়রোর মতন । রাত যত বাড়ে ততই জমে ওঠে। এখন কি খাবে বল?
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত শেষ হয়ে গেল। ভোরের আগে ওরা বাড়ী পৌছল,সেই পেছনের গেট দিয়েই। ক্লান্তিতে মীরার চোখ বুজে আসছিল। ঘরে ঢুকে ও শাড়ি না পাল্টেই শুয়ে পড়্ল, এবং কিছুখনের মধেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
মীরার যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষনে সূর্য অনেকটাই উপরে উঠে গেছে। ও সময় নিয়ে গোসল করল। নিচে যাবার আগে একবার লাইব্রেরী রুমে উকি দিল। টেবিলের উপর খাতায় কিছু লেখা। এই প্রথম আশিক কবিতা নয় নিজে থেকে কিছু লিখেছে। মীরা খাতাটা তুলে পড়ল।
“ গ্রুপ স্টাডি করতে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে। খেয়ে নিও। আমার বিরহে আবার না খেয়ে থেক না।”
মীরা কাগজটা তুলে গালের সঙ্গে ছোঁয়াল। এত খারাপ একটা লোক।
মিরার আজকে ক্লাস নেই। সারাদিন ও ঘর গোছাল, আফসিনের সঙ্গে গল্প করল টুকটুক রান্নাও করল একটু । চিকেন সমুচা আর ডালপুরি বানিয়ে ফেলল। দুপুরে আশিককে ফোন করে খোজ নিল খেয়েছে কিনা। আশিক জানাল হলে ভাত খেয়েছে , এখন ওর অফিসে আছে, পড়াশোনা করছে।
বিকেলের দিকে মীরা চিকেন সমুচা আর ডালপুরি সহ আরো কিছু খাবার ব্যগে ভরে আশিকের অফিসে চলে গেল। মজার ব্যপার হল আশিক ওকে দেখে একটু ও অবাক হল না। হাসতে হাসতে বলল
– তুমি এখানে?
– টেইলারের কাছে কাপড় দিতে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনাকে চা বানিয়ে দিয়ে যাই
– কোন টেইলার?
– কাছেই, রাস্তার উল্টোদিকে
– দিয়েছ কাপড়?
– হু
– ও আচ্ছা । বানাও চা, খাই তাহলে
মীরা চায়ের সঙ্গে খাবারগুলো বের করে সামনে দিল। আশিক আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সমুচা খেতে খেতে বলল
– তোমার টেইলারকে সমুচা না খাইয়ে আমাকে দিয়ে দিচ্ছ যে, টেইলার রাগ করবে না তো?
মীরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। টের পেল ওর চোখ ভিজে উঠছে। একটা মানুষের প্রত্যেকটা কথা কি করে এত ভাল লাগতে পারে? মীরা উঠে ছাদ বারান্দায় চলে গেল। রেলিঙে ভর দিয়ে দূরে লেকের স্থির জলের দিকে চেয়ে রইল। মীরা টের পেল আশিক ওর পেছনে এসে দাড়িয়েছে। আশিক ওকে ধরল খুব আলতো করে তারপর ওর চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বলল
– একটা কবিতা শুনবে মীরা?
মীরা সামনে ফিরে বলল
– শোনান
আশিক দুইহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে বলল
“আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভীরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশে মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করেছো অসীম।
বেদনা-মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনো ভাবি অপার্থিবা কিনা।
তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।
যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্ফুটে
অস্থির অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।”
চলবে…………
আজকের কবিতার নাম “তুমি” লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়