বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৯
মীরা তাকিয়ে দেখল আশিক ঘরের ভেতর না ঢুকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ও কান থেকে ফোন সরিয়ে বলল
-শুনুন
আশিক ফিরে তাকাল, ঘরে ঢুকল না। মীরা ফোনের উপর হাত চাপা দিয়ে বলল
-আজকে সুমনার জন্মদিন। আপনি ওকে একটু উইশ করে দিন না। ও খুব খুশি হবে।
আশিক কিছুক্ষন বোকার মতন তাকিয়ে রইল। তারপর বলল
-তুমি সুমনার সঙ্গে কথা বলছিলে?
-হ্যাঁ, কেন আপনি কি ভেবেছেন?
-কিছুনা, দাও কথা বলি
আশিক ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।
মীরা ঘর থেকেই দেখল আশিক বারান্দায় হাটতে হাটতে কথা বলছে। হাসছে একটু পরপর। এত কিসের কথা সুমনার সঙ্গে? ওদের তো ঠিক মত পরিচয় ও হয়েনি। এর ও আরো অনেকক্ষণ পর আশিক ভেতরে এসে মীরার হাতে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বলল
-আজকে ওর জন্মদিন আগে বলনি কেন? আমরা কোন উপহার পাঠাতাম। যাক কালকে তো আসছেই তখন দিয়ে দিও। আমি গোসল করতে যাচ্ছি। তোমার কথা শেষ হলে রেডি হয়ে নিও।
মীরা হতভম্ভ হয়ে গেল। সুমনা কাল আসছে? কই ওকে তো একবার ও বলল না।
মীরা ফোন কানে ঠেকিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলল
-তোরা কাল আসবি আমাকে একবার ও বললি না তো।
-কি বলব? তুমি শুভ জন্মদিন বলেই, যে তোমার জামাইয়ের গল্প শুরু করলা আর চান্স কোথায় পেলাম।
-কি এত কথা বলছিলি তুই ওনার সঙ্গে?
-এহ! ওনার সঙ্গে? আপা আমি জীবনে অনেক বউ পাগল ছেলে দেখেছি কিন্তু তোমার মতো জামাই পাগলী মায়ে দেখিনি।
-কি সব ফালতু কথা বলছিস?
-মানলাম ভাইয়া একটু বেসিই হ্যন্ডসাম তাই বলে তোমার এই অবস্থা?
-তোর বেশি হাত পা গজিয়েছে সুমনা। আয় তুই এইবার।
-আমার হাত পা আগেই ছিল। তুমি জামাইয়ের প্রেমে অন্ধ তাই দেখতে পাওনি
-বেশি কথা ফুটেছে তাই না? আয় কালকে। চড় মেরে তোর সব দাত আমি খুলে ফেলব।
সুমনা কিছুক্ষণ ফিক ফিক করে হাসল। তারপর দুজন একসঙ্গে শব্দ করে হেসে উঠল। কতদিন পর এভাবে ঝগড়া করল। আগে প্রতিদিন ঝগড়া না করলে দুজনের ভাতই হজম হত না। মীরা আদুরে গলায় বলল
-তুই কার সঙ্গে আসবি রে? সৌরভ ভাইয়ের সাথে ?
-না , বড় চাচার সাথে
মীরার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। কি ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছিল বড় চাচাকে।
-কখন আসবি রে তোরা?
-নয়টার বাসে রওয়ানা দিব। বিকেলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসব।
মীরা ভুরু কুচকে বলল
-দেখা করতে আসব মানে? তোরা আমার এখানে উঠবি না?
-না, আমরা তো ছোট খালার বাসায় উঠছি।
-কেন? তোরা এখানে না উঠলে বাবা খুব রাগ করবে।
-আমার শশুর
-আপা, তুমি তো একেবারেই এই বাড়ির হয়ে গেছ।
-এই, হয়ে গেছি আবার কিরে? এটা তো আমারই বাড়ি। এখন ফোন রাখ। দেখি তোরা কেমন করে এখানে না উঠিস।
মীরা এক দৌড়ে নিচে চলে গেল। আজ ছুটির দিন বলে আরিফ সাহেব ঘরেই ছিলেন। মীরা দরজায় টোকা দিয়ে বলল
-বাবা আসব?
-হ্যাঁ মীরা এস।
এখন আর মীরার আগের মত আশস্তি হয়েনা। সম্পর্কটা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে।
-কিছু বলবে মা?
-জি বাবা। কাল বড় চাচা আর সুমনা আসবে বাড়ি থেকে
– এতো খুশির কথা। বিয়ের পর এই প্রথম আসছেন। আমি রফিক কে বলে দেব, গাড়ি নিয়ে চলে যাবে।
মীরা মন খারাপ করা গলায় বলল
-বাবা ওনারা এখানে উঠতে চাইছেন না। আমার খালার বাসায় উঠবেন বলেছেন
-সে কি? মেয়ের বাড়ি থাকতে অন্য জায়গায় কেন উঠবেন? ঠিক আছে আমি এজাজ ভাইয়ের সঙ্গে ফোন করে কথা বলব। তুমি চিন্তা করো না।
-থ্যঙ্ক ইউ বাবা। আসলে সামনের সপ্তাহে সুমনার মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা, এখানে থাকলে ওর পড়াশোনার খুব সুবিধা হত।
-বাহ! ঢাকায় চান্স পেলে এখানে থেকেই পড়তে পারবে। বেশ ভাল হবে।
ব্যপারটা চিন্তা করেই মীরার মনটা ভাল হয়ে গেল।
মীরার হাসি মুখ দেখে আরিফ সাহেবের খুব ভাল লাগল। মেয়েটা আসার পর বাড়িটা কেমন প্রান ফিরে পেয়েছে। মেয়েটা বড় লক্ষ্মী। উনি আবারো বললেন
-আশিক ফিরেছে? তোমরা বাইরে কোথাও যাবে না?
-জি বাবা । একটু পরেই বের হব
-যাও ঘুরে এস। আজকে একটা ভাল দিন
-আপনাকে কফি দেই?
-কফি দেবে? দাও।
মীরা শশুড়কে কফি দিয়ে ফিরে এসে দেখল আশিক তখনো গোসল সেরে বের হয়েনি। ও আলমারি খুলে শাড়ি বাছতে লাগল, এবং কিছুক্ষণ পরেই টের পেল আশিক এসে ওর পেছনে, একেবারে ওর গা ঘেঁসে দাড়িয়েছে। অবচেতন মনে মীরা অনেক কিছু ভেবে ফেলল। কয়েক মুহূর্ত ওই ভাবেই কাটল। মীরাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মীরার নিশ্বাস ভাড়ী হয়ে ওঠার আগেই আশিক ওর মাথার ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা শাড়ি টেনে নিয়ে বলল
-এটা পরলে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগবে।
মীরা কিছু বলল না। সামনের দিকে ফিরে আশিকের অনাবৃত বুকে মুখ রাখল। আশিক একটু চমকে গেল। মীরা সচরাচর এমন করে না। ও এক হাতে ওর কপাল গাল ছুঁয়ে বলল
-তোমার শরীর এত গরম কেন মীরা? তোমার কি জ্বর এসেছে?
মীরা জবাব দিল না। দুই হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় আশিকের বুকের মধ্যে একটা টলটলে স্বচ্ছ দীঘি আছে। যেখানে অজস্র পদ্ম ফুল ফোটে, যার ধার ঘেঁষে আছে নাম না জানা সব বুনো ফুলের গাছ। মাঝে মাঝেই মীরা সেই ফুলের গন্ধ পায়। ওর খুব ইচ্ছে করে একদিন সেই দীঘির জলে গা ভেজাতে।
আশিক জবাব না পেয়ে বিচলিত কন্ঠে বলল
-তোমার গা ভর্তি জ্বর। চল বিছানায় শোবে
মিরা জড়ানো কন্ঠে বলল
-থাকি না আর একটু। কি ঠান্ডা। খুব আরাম লাগছে।
আশিক কথা শুনল না। দুই হাতে ওকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। কিরকম পাখির মতো হাল্কা। মীরা কি বরাবরই এমন ছিল, নাকি এখানে এসে ওর এই অবস্থা হয়েছে। আশিকের নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হল। এখানে এসে অবধি মীরা সবার এত যত্ন করছে অথচ ওকে দেখার তো কেউ নেই। মীরার কি খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে? কদিন ধরেই ও খেয়াল করেছে মীরার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। কেমন ক্লান্ত দেখায়।
-ওষুধ খাবে মীরা ?
-না, ইচ্ছা করছে না।
আশিক আবারো ওর কপালে হাত রাখল। হাল্কা গরম, ঠিক জ্বর নয়। ও উঠে ঘরের পর্দা টেনে দিল। দরজা বন্ধ করে কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
-কষ্ট হচ্ছে মীরা?
-না, ঘুম পাচ্ছে
-তাহলে ঘুমাও
-বাইরে যাবেন না?
-তুমি উঠলে তারপর যাব
মীরা চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারছে না। এত রাজ্যের ঘুম কোথা থেকে এল ওর চোখে? কিছুতেই ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। কত কি প্ল্যান করে রেখেছিল। আশিকের সঙ্গে এটা ওর প্রথম বৈশাখ। কত কি ভেবে রেখেছিল। সব মাটি হয়ে গেল এই ছাতার ঘুমের জন্য।
মীরার যখন ঘুম ভাঙল তখন সারা ঘর জুড়ে অবছা অন্ধকার। আশিক ওর পাশেই ঘুমাচ্ছে। এক হাতে ধরে আছে আলতো করে। ঘুম হওয়াতে বেশ ঝরঝরে লাগছে। মীরা উঠতে গেলে আশিক ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলল
-ঘুম হয়েছে?
-হু, আমি আপনার পুরোটা দিন নস্ট করে দিলাম।
-নস্ট হবে কেন?
-কোথাও যেতে পারলেন না।
-এখন যাব। ভালই তো হয়েছে, দুপুরে অনেক গরম আর ভীড় ছিল। চল কোথাও খেতে যাই। তুমি তো কিছুই খাওনি।
-কে বলল?
-বলতে হবে কেন? আর শোন, কালকে তুমি আমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাবে।
-পরশু না আপনার পরীক্ষা? পরীক্ষার পরে যাই?
-না, কালকেই। তুমি ভীষণ অনিয়ম করছো। এইরকম করলে তোমার কঠিন শাস্তি হবে।
-আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন?
আশিক এই প্রশ্নের জবাব দিল না। বরং বলল
-আমাকে একটা কথা বলতো। আর কতদিন আমাকে আপনি বলবে?
মীরা একটু লজ্জা পেয়ে গেল
-কেন আপনার খারাপ লাগে?
-হু, মনে হয় তুমি আমাকে অনেক দুরের কেউ ভাবো
-তুমি বললেই কি খুব কাছে আসা যায়?
-হয়ত যায় না, তবু আমি চাই তুমি আমাকে তুমি করে বল। নাম ধরে ডাকো।
-আচ্ছা বলব। একটা বিশেষ দিন থেকে বলব।
-আজ সেই বিশেষ দিন না?
-উহু, আজ না ,তবে খুব তাড়াতাড়ি আসবে।
আশিক হেসে ফেলল। তারপর বলল
-আচ্ছা আমি সেই বিশেষ দিনের অপেক্ষা করব।
-আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-হু
-আপনি সত্যি আমাকে নিয়ে কবিটা লিখেছেন?
আশিক একটু ক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল
“আমি তোমাকে কবিতায় লিখিনা
গানেও লিখি না।
কেনো না আমার গান
আমার সকল কবিতা
তোমার জন্যই লেখা।
আমি তোমার জন্য লিখি কিন্তু
তোমাকে কখনো লিখি না”
মীরাকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসতে হাসতে বলল
-কি হল?
-এটা আপনি লিখেছেন?
-ধুর বোকা! এটা তো রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর লেখা
-তাহলে আপনার গুলা কখন শোনাবেন?
-শোনাব। পুরো খাতাটাই তোমাকে দিয়ে দেব।এখন উঠে তৈরি হয়ে নাও
-আপনি আগে যান
-আচ্ছা
আশিক উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। মীরার উঠতে ইচ্ছা করছে না। কেমন একটা মায়াবী মিস্টি অনুভুতি হচ্ছে। মীরা আবেশে চোখ বুজে রইল। বালিশের নিচে ফোন বাজছে । ধরতে ইচ্ছা করছে না। মীরা চোখ বুজেই ফোন কানে ঠেকিয়ে বলল
-হ্যালো
-কেমন আছো মীরা?
-কে?
-এখন কি আমার ভয়েস ও চিনতে পারো না?
-না, কে আপনি?
-আমি শুভ
চলবে……