বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৬২
ছাদে জমজমাট লুডু খেলার আসর বসেছে। দল করে খেলা হচ্ছে, এক দলে মিরা আর আফসিন, আর অন্য দলে আশিক আর সুমনা। কি করে যেন আশিকের দল জিতে যাচ্ছে। মীরা এত ভালো খেলছে এত ভালো দান পরছে তবুও মিরাদের দল কিছুতেই জিততে পারছে না। পাশেই মীরার মোবাইল রাখা একটু পর পর টুং টাং শব্দে মেসেজের আগমন জানান দিচ্ছে। মিরা পাত্তা দিচ্ছে না। একটু পরে আশিক বলল
-মীরা মেসেজ আসছে দেখো
– পরে দেখব
একসঙ্গে টুং টুং করে অনেকগুলো মেসেজ এলো। মিরার ছক্কা পড়েছে, এরপর যদি চার বা তার বেশি আসে তাহলেই ওরা জিতে যাবে। আফসিন উত্তেজিত হয়ে বলল
– ভাবি তাড়াতাড়ি মারো
আবার দুইবার টুং টুং করে শব্দ হলো। মীরা বোর্ডের উপর গুটি ফেলল , চার। আফসিন আর সুমনা ইয়াহু বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আশিক অবাক হয়ে বলল – -সুমনা তুমি না আমার দল, তাহলে ওরা জেতায় এত খুশি হচ্ছ কেন? নিশ্চয়ই তুমি ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ। বলো, বলতেই হবে।
মীরার ফোনে আবারো শব্দ হচ্ছে। আশিক বিরক্ত হয়ে বলল
-মীরা দেখো, কেউ বোধহয় জরুরী মেসেজ করছে
মীরা ফোন নিয়ে উঠে গেল। মোট সাতাশটা মেসেজ এসেছে। সবগুলোই শুভর। কেউ দেখে ফেললে কি অবস্থা হতো? শুভ বোধহয় ইচ্ছে করেই এমন করছে। মিরা টুম্পাকে একটা ফোন দিল। ও ঢাকার বাইরে না থাকলে আরো আগেই ওর সঙ্গে কথা বলত। টুম্পা ফোন ধরে ক্লান্ত গলায় বলল
-একটু আগেই ফিরছি দোস্ত। ভীষণ টায়ার্ড
– সরি, খুব জরুরী একটা দরকার ছিল
– বল না। তুই না হয় অন্য কেউ হলে ধরতামই না
– তোকে মেসেজ করেছিলাম না, ওইটাই
– কি হয়েছে? ওই হারামজাদা আবার ঝামেলা করছে ?
– হ্যাঁ
– ব্লক করে দে
– কি করে যেন করে?
– তোকে নিয়ে আর পারিনা। আরো আগেই করা উচিত ছিল
টুম্পা ব্লক করার নিয়ম বলে দিলো। মীরা নাম্বার ব্লক করে, মেসেজগুলো ডিলিট করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নিচে থেকে খেতে ডাকছে। সুমনারা কাল চলে যাবে। এই উপলক্ষে আরিফ সাহেব বাইরে থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি আনিয়েছেন। আরো অনেক ধরনের খাবার আনানো হয়েছে। সুমনার জন্য স্পেশালি ম্যাপল ওয়ালনাট আইসক্রিম এসেছে। এই আইসক্রিম ও আগে কখনো খায়নি, এবারই ঢাকায় এসে প্রথম খেলো এবং ঘোষণা করলো এটা ওর জীবনে খাওয়া সবচাইতে মজার আইসক্রিম। অদ্ভুত ভাবে রাশভারী আরিফ সাহেবের সঙ্গে সুমনার খুব ভাব হয়ে গেল এ কদিনে। সেদিন বিকেলে মীরা আরিফ সাহেবকে কফি দিতে গিয়ে দেখল চেম্বারে বসে দুজন গল্প করছে। সুমনা মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে
– চাচা আমি যদি আপনাকে আগে দেখতাম, তাহলে ডাক্তার হবার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে লইয়ার হতে চাইতাম
– সেটা তুমি চাইলে এখনো হতে পারো
– কিভাবে?
– এটাই মজা বুঝলে, তুমি চাইলেই ডাক্তারের পাশাপাশি ওকালতিও করতে পারো কিন্তু আমি এখন চাইলেই তো মা ডাক্তার হতে পারবো না। তাই অসুখ হলে তোমার কাছেই ছুটতে হবে।
মীরার মনটাই ভালো হয়ে গেল।সুমনা যদি সত্যি সত্যি এখানে এসে পড়াশোনা করে তাহলে খুব ভালো হবে। কাল ও চলে যাবার পর বাসাটা কেমন খালি খালি হয়ে যাবে।
বড় চাচার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও আরিফ সাহেব উনাকে বাসের টিকিট কাটতে দিলেন না। গাড়ি করে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। ওনার খুব ইচ্ছা ছিল মীরাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার। মীরার মা অনেকদিন ধরেই ওকে দেখতে চাচ্ছে। আরিফ সাহেব আশ্বস্ত করলেন আশিকের আর একটা পরীক্ষা আছে, এটা শেষ হলেই ওরা ময়মনসিংহ থেকে ঘুরে আসবে। বিয়ে তো হয়েই গেছে, কাজেই রিসেপশনের আগে গেলেও ক্ষতি নেই।
সুমনারা পরদিন সকাল সকালই রওনা হয়ে গেল। আশিক আজকে আর অফিসে গেল না। শেষ পরীক্ষার আরো তিন দিন আছে। পরীক্ষা শেষের দিকে এলে আশিকের।আর পড়তে ইচ্ছা করে না। এবারও তাই হয়েছে, আর পড়াশোনা করতে ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও পাহাড়, জঙ্গলে ঘুড়ে আসতে। ও ঠিক করে রেখেছে পরীক্ষার পর দিনই বেরিয়ে যাবে। মীরাকেএকবার জিজ্ঞেস করতে হবে ও কোথায় যেতে চায়। সেই হিসেবে টিকিট কাটতে হবে। আশিক ঘরে ঢুকে দেখলো মিরা টেবিলে বসে কিছু একটা লিখছে। ওকে দেখে চট করে কাগজটা ওর খাতার ভেতর লুকিয়ে ফেলল। আশিক একটু অবাক হলেও কিছু বলল না, ভাবলেও হয়তো কবিতা টবিতা কিছু লিখছে, ওকে দেখাতে লজ্জা পাচ্ছে। আশিক কাছে এসে বলল
– ছাদে আবে মিরা?
– চলেন যাই
ভালই হল। মীরা চাইছিল আশিকের সঙ্গে একটু ওর রিপোর্ট নিয়ে কথা বলতে, ঠিক সুযোগ হয়ে উঠছিল না। মীরা বলল
-আপনি যান, আমি চা নিয়ে আসছি
আশিক ওর একটা হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল
-চা লাগবে না, আমি কফি বানাচ্ছি
কফির মগ নিয়ে দুজন ছাদে উঠে গেল। রোদের তেজ নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। বসন্তের মৃদুমন্দ বাতস। কফির মগে চুমুক দিয়ে আশিক মীরার দিকে তাকাল। মিরাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? নাকি আপসেট? হয়তো সুমনারা চলে গেছে তাই।
– মিরা
– জি
– চল শুক্রবার আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি
– কোথায়?
– দূরে কোথাও। এই ধরো বান্দরবান, সাজেক বা কক্সবাজার। তোমার কোনটা পছন্দ?
মীরা একটু ভেবে বলল
– আমার খুব চা বাগান দেখার সখ
– তাহলে সিলেট যাই। বাসে যাবে না ট্রেনে?
– বাস জার্নি আমার ভালো লাগেনা
– তাহলে ট্রেনের টিকেট কাটি। কি বলো?
– আচ্ছা। এর পর একটু থেমে বলল, আপনাকে আমার একটা জরুরী কথা বলার ছিল
– হ্যাঁ বলো
মীরা কিছু বলছে না অস্বস্তি নিয়ে চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশিক একটু অবাক হয়ে বলল
-কি হয়েছে মিরা ?
মীরা জবাব দিল না। ওর ফোন বাজছে। ফোন ও ধরছে না।
-তোমার ফোন বাজছে মীরা
মীরা ফোনের দিকে এক পলক তাকিয়ে সেটা আশিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
-এটা আপনার ফোন। আমারটা বোধহয় ভূল কোরে নিচে ফেলে এসেছি।
আশিক ফোন রিসিভ করে হ্যলো বলে চুপ করে গেল। ভুরু কুচকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল
-আচ্ছা তোরা থাক, আমি আসছি
মীরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। আশিক চিন্তিত মুখে বলল
-রিপন একটা ঝামেলায় পরেছে। আমি একটু বেরুচ্ছি। ফিরতে হয়ত দেরি হবে। আসার সময় তোমার রিপোর্ট নিয়ে আসব।
-রিপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি
-কবে?
-গতকাল দুপুরে
-বলনি তো।
-বলতাম। সমস্যা নেই আপনি যান।
-তাহলে কালকে রিপোর্ট দেখাতে যাব সকালে
মীরা আর কিছু বলল না।আশিক বেরিয়ে যাবার পর ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরল। অবেলার ঘুম ভাঙল সন্ধার পর। আজ হঠাত করে মায়ের অভাব অনুভব করল খুব। কেমন নিঝুম বিষণ্ণ হয়ে আছে বাড়িটা। মা থাকলে বকত। সন্ধ্যা বেলা আলো না জ্বালালে রাগ করত, বেলা অব্ধি ঘুমিয়ে থাকলে ডেকে দিত। মীরা মাকে ফোন দেবে বলে ফোনটা হাতে নিয়ে চমকে গেল।
চলবে………