#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
চোখের সামনে চাচা-চাচিকে এভাবে কাঁদতে, কষ্ট পেতে দেখে রুহানী তাদের থামাতে চাইল। বরাবরের মতো কথা বলতে না পারার দরুণ তার অন্তঃস্থল থেকে তপ্ত নিঃশ্বাসই নির্গত হলো। রুহানী ছাদের পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিয়ে, চাচির অশ্রুধারা মুছিয়ে দিয়ে ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলছে। অতঃপর চাচার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার পায়ের কাছে বসে মাথা নাড়িয়ে দুঃখ করতে নিষেধ করছে। রহমত শেখ রুহানির মাথায় হাত রেখে নিজের ব্যার্থতা লুকানোতে ব্যাস্ত। তখনি ওদের ড্রাইভার শফিক এসে হড়বড়িয়ে বলে,
“স্যার, রিহা মেম এসেছেন?”
‘রিহা’ নামটা শোনামাত্রই রহমত শেখ ও তার স্ত্রী হকচকিয়ে উঠে। জাহানারা শেখ অবাক কণ্ঠে বলে ওঠেন,
“এত বছর পর রিহা কেন এসেছে? তাও সিলেটে কেন? এখানে কেন এসেছে? ”
শফিক মাথা নিচু করে বলে,
“জানিনা বড়ো ম্যাডাম। আমি ওনাকে একটা গাড়ি থেকে নামতে দেখে এখানে দৌড়ে এসেছি। ”
জাহানারা শেখ ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও রহমত শেখ কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন। তিনি শফিককে বলেন,
“তুমি যাও শফিক। আমরা দেখছি। ”
শফিক চলে গেলে রহমত শেখ যেখানে বিয়ের কার্যকর্ম চলছিল সেখানে যেতে নিলে জাহানারা শেখ ডেকে ওঠেন,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
“কোথায় আবার! ছেলে পক্ষকে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে তো। তাছাড়া তোমার মেয়ে এতো বছর পর কেন এসেছে? সেটাও তো জানতে হবে। ”
স্বামীর কথার প্রত্যুত্তরে জাহানারা শেখ কিছুই বললেন না। হ্যাঁ, রিহা রুহানীর চাচাতো বোন। রহমত শেখ ও জাহানারা শেখের মেয়ে। রিহা রুহানির থেকে বছর তিনেকের বড়ো।
জাহানারা শেখ রুহানীকে নিয়ে স্বামীর পিছু পিছু যেতে লাগলেন।
রহমত শেখ বিয়ের স্টেজের কাছে পৌঁছানো মাত্রই বর পক্ষের লোকজন যেন তে”ড়ে এলো। জিহানের চাচা-মামারে এসে ক্ষী”প্ত কণ্ঠে পালাক্রমে জিজ্ঞেসা করছেন,
“রহমত সাহেব, আপনি আমাদেরকে জানাননি কেন যে আপনার ভাতিজি কথা বলতে পারে না! সে বো*বা!”
“আপনি কি বিষয়টা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে আপনাদের বো*বা, লা*চার মেয়েকে আমাদের ছেলের কাঁধে গছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? আপনি তো বিয়ের নামে আমাদের সাথে ধোঁ*কা করছিলেন রহমত সাহেব!”
রহমত শেখ মাথা নিচু করে মৌন রইলেন। তিনি যে সত্যিটা লুকিয়ে অন্যায় করেছেন তা তিনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু নিজের ভাতিজির প্রতি অসীম স্নেহের দৌলতেই যে তিনি এসব করছিলেন!
জিহানের চাচা আবার বলে ওঠলেন,
“আমরা আপনাদের সাথে ব্যবসায়িক বন্ধুত্বকে আত্মীয়তার রূপ দিতে চেয়েছিলাম। আর আপনি আমাদের সাথে এতো বড়ো ধোঁ*কা করলেন! আপনি এটা কিভাবে করতে পারলেন রহমত সাহেব? আমাদের ভাগ্য ভালো যে কেউ একজন চায়নি, আপনি আমাদের সাথে ধোঁকা করতে সফল হোন। তাই তো তখনই আমাদের ড্রাইভারের মারফত একটা চিঠির মাধ্যমে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাদেরকে সত্যটা অবগত করিয়েছেন।”
জিহান এতটা সময় চুপ থাকলেও এখন সে উঠে এসে রুহানীর সামনে দাঁড়ায়। অতঃপর রুহানীকে জিজ্ঞাসা করে,
“এই কারণেই তোমাকে যখন আমি কালকে গায়ে হলুদের সময় বলেছিলাম, রাতে আমাকে কল করবে। কিন্তু তুমি কল করোনি। এই কারণেই তাহলে? আমাকে সত্যটা বললে না কেন?
রুহানীর লজ্জায় মাথা নিচে করে নেয়। সে তো জানতো না যে তার চাচা তার থেকে লুকিয়ে বরপক্ষকে সত্যিটা না জানিয়ে বিয়েটা ঠিক করেছেন।
রুহানীর চুপ থাকার মধ্যেই কমিউনিটি সেন্টারের মূল ফটক থেকে কারো কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
“ও কিভাবে জবাব দিবে মিস্টার জিহান আহমেদ? আপনি তো আপনার প্রশ্নের মধ্যেই বলে দিলেন বা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন যে ও কথা বলতে পারেনা। ও বোবা! তাহলে ওর কাছে প্রশ্ন করে আপনার কী লাভ বলুন তো? এমন কারো কাছে প্রশ্ন করবেন, যার কাছ থেকে আপনি জবাব পাবেন।”
সেন্টারে উপস্থিত সকলে সদর দরজার দিকে তাকায়। দেখে একটা মেয়ে দাঁড়ানো। মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মডার্ন। তার বাহ্যিক সাজজ্জায় পরিলক্ষিত সে কোন উচ্চবিত্ত পরিবারেরই মেয়ে।
জিহান ভ্রু কুচকে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো
“এক্সকিউজ মি, আমি কাকে কী জিজ্ঞেসা করব, সেটা কী আপনাকে বলে করতে হবে? কে আপনি? এখানে কিভাবে ঢুকলেন?”
জিহানের প্রশ্নে যেন মেয়েটির কাছে রম্যাত্নক ঠেকল। মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে হাসল। অতঃপর বলল,
“ভালো প্রশ্ন করেছেন। কে আমি? কী আমার পরিচয়? ওয়েল, আপাততো আমি আপনার কেউ নই। কিন্তু এখানে কয়েকজন আমার রক্তের সম্পর্কের!”
মেয়েটির ভণিতা দেখে জিহান কিঞ্চিত বিরক্ত হলো। সে বলল,
“যা বলার ক্লিয়ারলি বলুন। এতো সাসপেন্স বোঝার মতো টাইম এন্ড ইনটেনশন আমাদের কারোই নেই।”
মেয়েটি বাঁকা হেসে বলল,
“আচ্ছা! তবে আর সাসপেন্স রাখলাম না। আমি আমার পরিচয়টা তবে দিয়েই দেই। মাইসেল্ফ রিহা শেখ, ডটার অফ রহমত শেখ এন্ড জাহানারা শেখ। আরও ফারদার ইন্ট্রোডাকশন বলতে গেলে, আমি ‘আর ব্রাদার্স’ কম্পানির ইটালির ব্রাঞ্চের সিইউ! ওই ব্রাঞ্চের সব কিছু আমার আন্ডারে।”
মেয়েটির পরিচয় শুনে উপস্থিত তিনজন বাদে সকলে হতবাক হয়ে যায়। সবার এই হতচকিত দৃষ্টি দেখে রিহা বেশ মজা পেল। রিহা এবার তার বাবার দিকে তাকায়। রহমত শেখের দৃষ্টিতে সন্তুষ্টির লেশমাত্র নেই। তাতে অবশ্য রিহার কিছু যায় আসে না। সে তার বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে আহ্লাদে জড়িয়ে ধরল। আর বলল,
“হাউ আর ইউ ড্যাড?”
রহমত শেখ বিরক্ত হয়ে রিহাকে নিজের থেকে কিছুটা রূঢ়ভাবে সরিয়ে নিয়ে নিচু আওয়াজে শুধালেন,
“তুমি এখানে কেন এসেছো রিহা? তোমাকে কে বলল আমরা সিলেটে আছি?”
রিহা কণ্ঠে আহ্লাদ এনে নিচু কণ্ঠে বলল,
“ওহ ড্যাড! তুমি তবে তোমার মেয়ের ভালোবাসা বুঝতেই পারোনি। তোমরা যতই আমার থেকে আড়াল করে যাই করো না কেন, আমি কোনো না কোনো সূত্রতে ঠিক জেনে যাব।”
“ওহ! তবে তুমিই ওদেরকে রুহানীর ব্যাপারে জানিয়েছ? অবশ্য তোমার দ্বারাই এসব সম্ভব!”
“উম! তুমি না বলতে, রুহানী অনেক সৎ! তা তোমার সৎ ভাতিজির বিয়েটা তুমি অসৎ উপায়ে দিচ্ছিলে ড্যাড? এটা কি ঠিক বলো? উঁহু, একদম ঠিক না। এমনটা হলে তো তোমার আদরের ভাতিজির সততায় প্রশ্ন উঠতো! তাই নয় কি? সেই সাথে তোমারও নাম খারাপ হতো।”
রহমত শেখ তাচ্ছিল্য হাসলেন। তিনি বললেন,
“তুমি আমার কথা, রুহানীর কথা এতো ভাবো? জানা ছিল না।”
রিহা তার বাবার কথায় পাত্তা দিল না। সে নিজের মতো পরিস্থিতি উপভোগ করতে লাগল। বর পক্ষ থেকে আবারও শোনা গেল,
“আমাদের যে এখানে এনে অপমান করলেন তার মূল্য কিভাবে চুকাবেন রহমত সাহেব? আমরা কিন্তু চাইলেই আপনার নামে ও আপনাদের কম্পানির নামে মানহা*নির মা*মলা দিতে পারি। এতে করে কিন্তু আপনাদের কোম্পানির মার্কেট ভ্যালু অনেক নেমে যাবে।”
রিহা বলে ওঠল,
“সরি, আমি এই একটা ইস্যুর জন্য আমার কম্পানির আই মিন আমাদের কম্পানির এতো বড়ো লস করতে পারব না। আপনারা যা বলবেন আমরা তাতেই রাজি। কতো এমাউন্ট লাগবে? নাকি অন্যকিছু?”
বর পক্ষ থেকে জিহানের চাচা বলে ওঠলেন,
“টাকা আমাদেরও কম নেই মিস শেখ। আমরা তো একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক চেয়েছিলাম। আমার ভাই-ভাবী, ভাতিজা লন্ডনে আমাদের কম্পানির ব্রাঞ্চ দেখাশোনা করেন। দেশের মধ্যে কোনো ব্যাবসায়িক সম্পর্ককে আত্মীয়তায় রূপান্তর করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আপনারা তো ফ্র*ড করলেন।”
রিহা যেন এমনটাই শুনতে চাইছিল। সে সুযোগের সৎ ব্যাবহার করে নিল। সে বলল,
“আপনারা চাইলে এখনো আপনাদের সেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক থেকে আত্মীয়তার সম্পর্কে যেতে চাওয়ার ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারেন!”
“আমাদের কোন আপত্তি নেই। আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমরা আগে বাড়তেই পারি।”
রিহা এবার তার বাবার দিকে মুচকি হেসে তাকালো। রহমত শেখ মেয়ের এই হাসি দেখে মেয়েকে কিছু কড়া কথা বলতে নিবেন তখনি রুহানী এসে উনার হাত ধরে বসলো। রুহানী ইশারায় মাথা নাড়িয়ে তার চাচাকে কিছু বলতে নিষেধ করছে। রহমত শেখ অসহায় দৃষ্টিতে ভাতিজির দিকে তাকালেন। রুহানি তারপরও ইশারায় নিষেধ করছে। শেষমেশ রহমত শেখ হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে রইলেন।
জিহানের পরিবার ও রিহার মতামতের উপর ভিত্তি করে জিহান ও রিহার বিয়ের কার্যকর্ম শুরু হলো। রিহা রুহানীকে টেনে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে বরপক্ষ থেকে আনা শাড়িটা বাদে সব গহনাগাঁটি খুলে নিল। অতঃপর সেসব দিয়ে রুহানীর সামনেই নিজের সাজসজ্জা করল। তারপর আয়নায় নিজেকে বধূবেশে দেখতে দেখতে আত্মাভিমানী কণ্ঠে রুহানীকে শুধাল,
“দেখ তো, আমায় কেমন লাগছে? তোর থেকেও সুন্দর লাগছে না? স্মো*কি, বো*ল্ড ব্রাইড!”
রুহানী মলিন হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।
জানিনা আপনাদের কেমন লাগবে। তাও কমেন্টে আপনাদের অনুভূতি জানাবেন।