#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৪
“তিস্তা আপু ফোনে তুমি দুলাভাইয়ের ছবি দেখছ? শুনো বিয়েটা করলে শীতে করে ফেলো। তুমি বলতে না পারলে আমি বলে দিচ্ছি।” কাঁথা মুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উপস্থিত হলাম তিস্তা আপুর ঘরে। হাতে চায়ের কাপ। ট্রেতে তিনটা কাপ রয়েছে। শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে সে। আমার কথায় সৌজন্য হাসল। আমিও হাসলাম। চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে রাখলাম। উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বলে, শুনলাম অপূর্ব ভাই তোকে জোর করে গোসল করিয়েছে। এই পৌষ মাসেই এই অবস্থা, মাঘে কী করবি তুই?”
“মাঘের শীত বাঘের গায়ে। পৌষ আমার কাছে শীত লাগে।”
“তাহলে তো, পৌষের শীত তুষের গায়ে।” আপুর কথাতে আমি পড়লাম ফ্যাসাদে। আপু হেসে বলে, “কাছে আয় পাকা বুড়ি।”
আমি ধপাস করে বসলাম পাশে। ঠোঁট উল্টে বললাম, “এখন কাছে ডাকছ, আসছি। পরে কিন্তু দুলাভাই ছাড়া কাউকে কাছে ডাকবে না। মনে থাকবে?”
“ঠিক আছে।” আপু সাথে শান্ত কণ্ঠে বললেন। আমি পুনরায় বললাম, “তোমার প্রয়াস ভাইকে কেমন লাগে? আমার কিন্তু হেব্বি লাগে। যেন নব্বই দশকের জীবন্ত সালমান শাহ্। কিন্তু তার ভাই পিয়াস, শা/লা শ/য়/তা/নের হাড্ডি। ইচ্ছে করে শেওলা গাছের পে/ত্নির মতো ঘাড় ম/টকে দেই।”
তিস্তা আপু বললেন, “কাল রাতে জব্বর দিয়েছিস, কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছে। আমাদের বাড়িতেই ছিল। আজ ভোরে গেছে।”
ফট করে বললাম, “মানে?”
“মানে আবার কী? ঠান্ডায় কাঁপছিল, বাবা চাচারা যেতে দেইনি। সকালে গেছে। পিয়াসের চুল একভাবে টাক। আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবি.. কথাটা অসমাপ্ত রেখেই থেমে গেলেন তিস্তা আপু। চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে রইলাম। আপু নিজেকে সামলে বললেন, “আমাদের লজিং মাস্টার আছে না? কিছুদিনের জন্য তিনি বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। আমি তাঁকে ভালোবাসি। তিনিও আমাকে ভালোবাসে। আমাদের মতো বড়লোক নয় তাঁরা, গরীব ঘরের সন্তান। যদি বাড়ির সবাই রাজি নাহয়, এই ভয়ে কাউকে বলতে পারছি না।”
এজন্যই তিস্তা আপুর মন ভালো নেই। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “মামারা অনেক ভালো, তুমি আগে বলে দেখো আপু।”
“না আরু, আমি পারব না। তাঁরা যদি আমাদের ভালোবাসা অস্বীকার করে আর সুজনকে পড়ানো থেকে ছাড়িয়ে দেয়। তখন? তখন ওর পরিবার না খেয়ে ম/র/বে। ভালোবাসি বলে এতবড় স্বার্থপর হতে পারব না।”
আমি নিচু হয়ে থাকলাম। অপূর্ব ভাইকে জানালে তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। তিনি তো মনের ডাক্তার। তিনদিন পর শহরে ফিরে যাবেন। তার আগেই জানাতে হবে। আমি উঠলাম। তিস্তা আপু হাত ধরে বলে, “কোথায় যাচ্ছিস?”
“অপূর্ব ভাইকে জানাতে।” তিস্তা আপু হাতটা ছেড়ে বললেন, “দিব্যি রইল আরু। প্লীজ বলবি না। যা।”
চায়ের ট্রে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তিস্তা আপুর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। ইঙিয়ে বিঙিয়ে হোক অপূর্ব ভাইকে বোঝাতেই হবে। মায়ের ঘরে গেলাম। মাকে বিছানায় হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে। ফুল নামক মেয়েটা ফোনে কথা বলছে। আমি ঘরে ঢুকে ডাকলাম, “আপনার চা।”
টেবিলের উপর রেখে মায়ের দিকে তাকালাম। বয়সের সময় দেখতে হেব্বি ছিল। কিন্তু এখন? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে গেল বলে। পা বাড়ানোর পূর্বেই ফোন রেখে মেয়েটি আমাকে ডাকল, “আরু, আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো। তুমি কি একটু তোমার মায়ের কাছে থাকবে?”
“হম। আমার মায়ের কাছে আমি থাকব না।” মেয়েটি চলে গেল। আমি মায়ের কাছে গেলাম। মাকে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে রইলাম। আবদার করে বললাম, “মা, আমাকে দুই টাকা দিবে?”
আরু শেফালীকে দেখতাম এভাবে মামিদের কাছে আবদার করতে। মামি মাছ কাট/ত আর ওরা আবদার করত। কখনো হয়তো মায়ের মুখে শুনতে পারব না আরু ডাকটা। কখনো হয়তো মায়ের আঁচলে মুখ মোছা হবে না। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম, “মা তোমার চার ভাই আমাকে আগলে রাখছে। ভাগ্য করে এমন ভাই পেয়েছ।”
ফুল মেয়েটা চলে এসেছে। চায়ের কাপ নিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের ঘরে গেলাম। ফোন দেখে দেখে বিছানায় শুয়ে কাগজে লিখে চলেছেন কিছু। আমাদের বাড়িতে দুই ভাইয়ের স্মাটফোন রয়েছে। মহিলা বা মেয়েরাদের ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। তবে বাড়িতে একটা পুরোনো ল্যান্ডফোন রয়েছে। প্রয়োজনে এটা ব্যবহার করা যায়। চায়ের কাপ সামনে দিয়ে বললাম, “আপনার চা।”
“তুই খেয়েছিস?”
“না, রঙ চা খেলে গায়ের রং কালো হয়ে যায়।” অপূর্ব ভাই একগাল হাসলেন। তার গালে টোল পড়ল। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। আড়চোখে আমার পানে চেয়ে টেনে চা শেষ করলেন। আমার ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন হলো। হা করে দেখলাম। দ্রুতি কণ্ঠে বললাম, “আস্তে জিভ পু/ড়ে যাবে।”
ট্রে-তে কাপ রেখে বললেন, “এটা আর চা নেই, দিঘির পানিতে রঙ ও চিনি মেশানো শরবত মনে হচ্ছে।”
ঠিকই তো! এতক্ষণে এমন হওয়ারই কথা। মৃদু স্বরে বললাম, “আরেক কাপ করে আনব?”
আদেশ করে বললেন, “না। বস।”
বলেই সবকিছু গুছিয়ে রাখলেন। দু’দিন পর এই ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। বিষাদময় নিঃশ্বাস নিলাম। অপূর্ব ভাই তার ট্রাভেলিং ব্যাগ বের করলেন। একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। খুলে দেখলাম তিনটা টুথপেস্ট, টুথব্রাশ আর কয়েকটা সাবান। আমার ছোটো করা মুখ দেখে বললেন, “এগুলো তোর জন্য এনেছি। ছাপ্পান্ন পাটির দাঁতগুলো ঘসে ঘসে পরিষ্কার করবি আর সাবান মাখবি। তোর শরীর থেকে ভেড়া ভেড়া গন্ধ আসে।”
সবকিছু ফেলে ছুটে এলাম ঘরে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে পড়লাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমি কী ইচ্ছে করে এই দাঁত উঠিয়েছি না-কি? উঠে গেছে। এই দাঁতের জন্য আমি অনেক অ/পমান সহ্য করেছি আর নয়। এবার এগুলোকে জীবনের মতো শেষ করে দিবো।
বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। ড্রয়ার খুঁজে নাইলন সুতা নিলাম। মাছের জাল বুনতে ব্যবহার করা হয়। ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে তিনটা দাঁত ফেলে দিলাম। প্রথম দাঁতে পেঁচিয়ে টান দিতেই ফিকনি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করল। ব্যথায় চোখে পানি এলো। দাঁত ছিটকে পড়ল নিচে। মাথা ধরে গেল। ক্ষোভের কারণে শরীরকে তোয়াক্কা করলাম না। আরও দু’টো দাঁত ফেলে দিলাম। ব্যথায় নিজেকে সামলাতে কিংবা কথা বলতে পারছি না। মাথায় হাত দিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শরীরটা অবস হয়ে আসছে ক্রমশ।
রাতে শরীর কাঁপিয়ে প্রচণ্ড জ্বর এলো। ব্যথায় কাতর শরীর নিয়ে ঘুম এলো অতিদ্রুত। গোঙানির শব্দ পৌঁছে গেল অন্যদের কর্ণপথে। রাতে শেফালী আমাকে ডাকল। জ্বর শরীর নিয়ে নিভু তাকালাম। শেফালী কপালে হাত দিয়ে বলে, “আরু তোর শরীরে প্রচুর জ্বর, কীভাবে এসেছে?”
কথা বলার শক্তি পেলাম না। তুর উঠেছে বিছানা ছেড়ে। শেফালীকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তুই ওকে দেখ, আমি মাকে ডেকে আনছি।”
শেফালী চাপা রাগ নিয়ে বলে, “এজন্য বলি প্রতিদিন গোসল কর। মাসে একদিন গোসল করিস। এজন্যই জ্বর এসেছে।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]