বৃষ্টিস্নাত_ভোর #পর্ব_০২

0
391

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্ব_০২
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

_________
আমি ধীর কদমে বাইরে বের হলাম। হঠাৎ কারোর ভেজা শরীরে ধাক্কা খেলাম। পড়েই যাচ্ছিলাম কিন্তু তার পূর্বেই কেউ আমায় ধরে ফেলল। কারো বাহুডোরে আমি বন্দি হয়ে পড়লাম। চোখ ভয়ে বন্ধ করে ফেলেছিলাম। যখন দেখলাম পড়ে যাচ্ছি না, তখন পিটপিট করে চোখ খুললাম। সামনে এক সুদর্শন মুখাবয়ব প্রতীয়মান হলো। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মায়াময় মুখশ্রী, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা পানি আর চুল বেয়ে টপ টপ করে পানি ফোঁটায় ফোঁটায় আমার মুখে পড়ছে। সবটা মিলিয়ে *বৃষ্টিস্নাত ভোরে* কোনো এক অজানা ঘোরে হারিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেতেই ছিটকে সরে এলাম তার নিকট হতে। সেও খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে উঠল,

‘ আ’ম রিয়েলি ভেরী স্যরি। ‘

‘ ইটস ওকে। ‘ প্রীতিকর হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললাম।

‘ আসলে বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছি। ‘

‘ জি তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা আপনি এতো বৃষ্টির মাঝে বের হতে গেলেন কেন? ‘ কৌতূহল বশত উক্ত উক্তিটি মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।

‘ একজনকে দেখতে এসেছিলাম। কাল অনেক রাত অবধি এখানে তার ফ্যামিলির জন্য অপেক্ষা করেছি। কিন্তু হঠাৎ জরুরি কল চলে আসায় তাদের সাথে দেখা করতে পারিনি। তাই ভোরেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। বাসা থেকে খুব একটা দূরে না বিধায় হেঁটেই আসছিলাম। কিন্তু মাঝ রাস্তায় বৃষ্টির সম্মুখীন হতে হলো। ‘ বিশাল এক উক্তি শেষ করে তিনি থামলেন অবশেষে।

‘ ওহ্ আচ্ছা। ‘ বলে মিহিরের কেবিনের দিকে ফিরে যাচ্ছিলাম। একটু হাঁটার উদ্দেশ্য থাকলেও বর্তমানে সেই চিন্তা বদলে গেছে। এর চেয়ে মিহিরের কেবিনে ফিরে যাওয়াটাই সমীচীন মনে হলো।

‘ এই যে মিস! ‘ পিছু ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকালাম। চোখের ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলাম ” কী “?

‘ আপনার নামটা তো জানা হলো না! ‘ মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বললেন তিনি।

‘ আমি মেহুল তানজুম। আপনি? ‘ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম।

‘ আমি নেহাল হাসনাত। আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল। ‘

এই নামটা শোনা মাত্রই ডক্টরের বলা সাংবাদিকের নাম মনে হলো। তৎক্ষণাৎ শিরা উপশিরা বেয়ে শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। কৃতজ্ঞতায় নেত্রযুগল নোনাজলে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। আমি ঢোক গিলে শুকিয়ে যাওয়া গলা ভিজিয়ে বললাম,

‘ আপনি কী মিহির তানজুম, ভিক্টিমের সাথে দেখা করতে এসেছেন? ‘

‘ জি কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? ‘ চোখে বিস্ময়ের ছাপ তার।

‘ আপনি সাংবাদিক নেহাল হাসনাত তাই না? ‘

‘ হ্যাঁ কিন্তু… ‘ দ্বিতীয় দফায় অবাক হয়ে কথাগুলো বলছিলেন তিনি কিন্তু আমি তার বলা বাক্যটিকে পূর্ণ করার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলাম,

‘ আমি ভিক্টিমের বোন। ‘

‘ ওহ্ আচ্ছা। ‘

বেশ অনেকটা সময়জুড়ে চলল নিরবতা। কারোর কাছে কথা বলার কোনো ভাষা নেই। তারপর নিরবতা ভেঙে আমি অশ্রুসজল চোখে বলে উঠলাম,

‘ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে আমার বোনকে হয়তো বা খুঁজে পেতাম না। আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? ‘

‘ এভাবে বলবেন না প্লিজ। বলে ফেলেন কী অনুরোধ। ‘ অভয় দিয়ে বললেন নেহাল।

‘ আমি চাই আমার বোনের প্রতি যারা অবিচার করেছে তাদের যথাযোগ্য শাস্তি হোক। তাদেরকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলাতে চাই। যাতে ভবিষ্যতে এহেন অপরাধ করতে সকলের রূহ কাঁপে। আপনি কী আমায় চলার পথে ন্যায় বিচার পেতে সাহায্য করতে পারবেন? ‘

‘ আমি একজন ক্রাইম রিপোর্টার। সমাজের সকল স্তরের অন্যায়কে তুলে ধরাই আমার কাজ। আপনি চিন্তা করবেন না অপরাধী যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, আমরা সত্যের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। ‘ আত্মবিশ্বাসী হয়ে বললেন নেহাল।

‘ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ‘ কৃতজ্ঞচিত্তে বললাম।

‘ ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবেন না। আচ্ছা মিহিরের কী জ্ঞান ফিরেছে? ‘

‘ নাহ্ এখনো ফেরেনি। ‘ কথাটা বলার পরপরই আম্মুর চিৎকার শুনতে পেলাম। আম্মু নার্স আর ডক্টরকে ডাকছেন। আমরা তৎক্ষণাৎ মিহিরের কেবিনে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, মিহির অচেতন অবস্থাতেই হাত-পা নেড়ে কাতরাচ্ছে। যেন কারো কাছ থেকে নিজেকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থা দেখে আম্মু কান্নায় ভেঙে পড়লেন আর আওরাতে লাগলেন,

‘ জা*য়ারগুলো আমার ফুলের মতো মেয়েটার একি হাল করেছে? ‘

নেহাল আমায় শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আমার সারা শরীর কাঁপছে। বোনের যন্ত্রণা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি নাহ্। হঠাৎ করে আমি উদ্ভ্রান্তের মতো নেহালের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। নেহাল যে আমার নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন ব্যক্তি একথাটা যেন মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। আব্বু আম্মুকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। ততক্ষণে নার্স, ডক্টর চলে এসেছেন। নেহাল আমাকে নিজের সাথে চেপে ধরে রেখেছেন। চেকআপ করে ডক্টর বললেন,

‘ মিহির মেন্টাল ট্রমায় রয়েছে। আজকে হয়তো ওর জ্ঞান ফিরে আসবে। তবে ওর স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হবে। আপনারা ভেঙে পড়লে ও কিছুতেই সুস্থ হতে পারবে না। তাই নিজেদের শক্ত করুন। ‘

আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিলাম। ডক্টর চলে গেলেন। নেহালের নিকট থেকে দূরে সরে এলাম। নেহাল চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘ আপনি ঠিক আছেন মেহুল? ‘

‘ হুম। আপনি নিউজ করার ব্যবস্থা করেন প্লিজ। ‘ কম্পনরত গলায় বললাম।

‘ আপনি শান্ত থাকুন। আমি দেখছি কী করা যায়। আমি রায়হানকে একটা কল করি। ‘ আমাকে আশ্বস্ত করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন নেহাল।

___________

৩.

দুই দিন পর,

প্রতিটি খবরের চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ আকারে প্রচারিত হচ্ছে, ” রাজধানীতে কলেজ ছাত্রী ধ*ন। প্রতিবাদে সহপাঠীদের বিক্ষোভ। আসামী হিসেবে বিশিষ্ট শিল্পপতির ছেলেসহ মোট পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ভিক্টিমের পরিবারের মামলা। ”

খবর প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে আমাদের কাছে নামে বেনামে নানাবিধ হুমকি, চাপ আসতে থাকে। থানায় মামলা করতেও প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে। নেহাল হাসনাত ছিলেন বলেই সবটা করতে পেরেছি। নতুবা ক্ষমতাশালীদের ক্ষমতার দাপটে এতটা পথ অগ্রসর হওয়া কল্পনাতীত ছিল আমার জন্য। মিহিরকে হসপিটাল থেকে গতকাল রিলিজ দিয়েছে। মেয়েটা খাওয়া-দাওয়া অবধি ছেড়ে দিয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকাতে পারি না। কাছে গেলে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোনো কথা বলে না, যেন নিস্তেজ, নিস্তব্ধ বোবা প্রাণী। যেই মেয়েটা কথা বলে বাসার সবাইকে মাতিয়ে রাখত সেই মেয়েটির এমন চুপসে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না। তবে ও জ্ঞান ফেরার পর ওর সাথে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনার বর্ণনা করেছে। বিশিষ্ট শিল্পপতি আফসার মির্জার বখে যাওয়া সন্তান শিহাব মির্জার নামসহ ওর সাথে অবিচার করা প্রতিটা মানুষের নাম উল্লেখ করেছে। নেহাল সবটাই রেকর্ড করে নিয়েছে। আশ্চর্য হলেও সত্য এই তিন দিনের পরিচয়ে নেহাল আমাদের পরিবারের জন্য অনেকটা করেছে। মিহিরকে নিজের বোন হিসেবে নায্য বিচার পাইয়ে দিতে সাধ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন উনি।

লোকটাকে যত দেখছি তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ততই বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ডোরবেলের শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হলো। এই ভর দুপুরে কে এলো? হঠাৎই অজানা আশঙ্কায় হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেল। আচ্ছা আমাদের ক্ষতি করতে কারো আগমন ঘটেনি তো? আব্বু বাসায় নেই, আম্মু কোনো দরকারে বাইরে বেরিয়েছেন, মিহির ঘুমাচ্ছে। বাসায় শুধু আমি আর মিহির। ভয় লাগছে খুব। আবার ডোরবেলের শব্দ। ভয় এবার জাঁকিয়ে বসেছে মনে। সাহস সঞ্চয় করে দরজার দিকে এগুতে গিয়েও কিছু একটা মনে করে ছুটে গেলাম রান্নাঘরে। ফল কাটার ছুরি হাতে নিয়ে দরজায় গেলাম। লুকিং গ্লাস দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না। দরজা খুলব কী খুলব না, এই সমীকরণের দোটানায় পড়ে গেলাম। মন বলছে খুলে দেখতে কিন্তু মস্তিষ্ক বারংবার সতর্কবার্তা পাঠাচ্ছে দরজা না খোলার জন্য। অবশেষে মনের কথা রাখতে দরজা খুলেই দিলাম। খুলে দেখতে পেলাম নেহাল একগাঁদা বাজার আর আম্মুকে নিয়ে এসেছে। আমার হাত থেকে স্বশব্দে ছুরিটা মাটিতে পতিত হয়ে শব্দ তরঙ্গের সৃষ্টি করল। আম্মু দ্রুত কদমে দরজা ছেড়ে রুমে প্রবেশ করলেন। নেহাল বাজার নিয়ে রুমে ঢুকেই মেইন দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমার হাত-পা অনবরত কাঁপছে। কেন কাঁপছে তাও ঠিক স্পষ্ট নয়! আম্মু কিছু বলছিলেন যা আমার কর্ণগোচর হচ্ছিল না। হঠাৎ চোখে সবটা ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। নেত্রযুগল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে নেহালকে দেখলাম হাতের বাজারের ব্যাগগুলোকে ফেলে আমার নিকট ছুটে আসতে। অতঃপর আর কিছু দেখতে পাইনি, আমার আর কিছু মনে নেই।

__________

#চলবে_ইনশাআল্লাহ…

#NUSRAT_TABASSUM_METHILA

[ রিচেক হয়নি। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here