অপেক্ষার_প্রিয়_প্রহর #পর্বঃ০২ #সাদিয়া_ইসলাম

0
412

#অপেক্ষার_প্রিয়_প্রহর
#পর্বঃ০২
#সাদিয়া_ইসলাম

স্ত্রী রাফার প্রশ্নের উত্তরে পরশ পাশ ফিরে শুয়ে বললো,

‘ তোমার বোন আগে কেমন ছিলো! আর এখন কেমন হয়েছে? একটু চিন্তা করো, বুঝতে পারবে।’

পরশ ঘুমানোয় চেষ্টায় চোখ বন্ধ করে নেয়। রাফা পরশের দিকে এক পলক তাকিয়ে হতাশ হয়ে নিঃশ্বাস ফেলে। ঠিকমতো শুয়ে নিজেও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টায় মত্ত হয়। আগের ওয়াজিহা আর এখন কার ওয়াজিহাকে এক করতে গেলে আকাশ-পাতাল তফাৎ ব্যতিত কিছুই খুজে পাবে না। তাই এই বৃথা চেষ্টা না করাই ভালো।

সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেলো ওয়াজিহার। বিছানা হাতরে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে। আটটা বেজে গেছে। ফজর নামাজ আদায় করে ঘুমিয়েছিলো একটু। এছাড়া তো রাতজাগা তার নিত্যসঙ্গী। সময় দেখে বিছানা ছাড়ে ওয়াজিহা। পায়ে স্যান্ডেল চালিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে বার কয়েক হাই তুলে হাত উচু করে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে মিষ্টি করে হাসলো। এরপর আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির উপরই হাত বুলিয়ে আনমনে বিরবির করে বললো,

‘দিনদিন তোর সৌন্দর্য ফিকে পরে যাচ্ছে জিহা৷ নিজের প্রতি এতটা কেয়ারলেস! এমন টা তো হওয়ার কথা ছিলো না! তবে এমন কেনো হলো? নে চল শুরু করে দে ভালো থাকার নাটকীয় আরও একটি দিন।’

ওয়াজিহা ওয়াশরুমের দিকে পা চালালো। ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে পা দিতেই তার কোমড় আকড়ে জড়িয়ে ধরলো ছোটো দু’টো হাত। ওয়াজিহা হেসে মাথা নিচু করে নিচ দিকে তাকালো। তাকে জড়িয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে তার বোনের ছেলে অলি আহাদ। ওয়াজিহা তাকে ছোট্ট করে অলি-ই ডাকে। সে অলিকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে জিগাসা করে,

‘আব্বু, আপনার স্কুল নেই আজ?’

অলিকে নার্সারিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকাল সকালই সে স্কুলে চলে যায়। এজন্য অলিকে বাসায় দেখে প্রশ্নটা করে ওয়াজিহা। অলি খালামনির গলা জড়িয়ে আনন্দে গদগদ হয়ে বলে,

‘আজ দাদু-দাদী আসবে জিহামনি। তাই আমি স্কুলে যাবোনা আজ।’

অলির জবাব শুনেই ওয়াজিহার মনের মাঝে ধ্বক করে উঠলো। অলি কথা বলা, ডাক দেওয়া শেখার পরপরই ওয়াজিহা অলি যেনো তাকে জিহামনি ডাকে, শিখিয়ে দিয়েছিলো। ডাক-টা তার ভীষণ পছন্দের। এজন্য অলি ওয়াজিহাকে খালামনি কম, জিহামনি-ই বেশি ডাকে। অলির দাদু-দাদী মানে তো তার দুলাভাইয়ের বাবা মা। আজ আর বাসায় থাকা যাবেনা। ওয়াজিহা দ্রুতপদে ডাইনিং রুমে এসে বোনকে চেঁচিয়ে ডাকলো। অলিকে এক চেয়ারে বসিয়ে দিলো। এরপর দুগাল টেনে খালা-ভাগ্নে মনখুলে হাসলো। একমাত্র অলির সামনেই ওয়াজিহা যা একটু মনখুলে হাসে। এছাড়া তো হাসি! লোক দেখানো হাসি হাসে সে। রাফা দুহাতে নাস্তা এনে বোনের দিকে এক নজর তাকিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,

‘চেচাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে?’

ওয়াজিহা চেয়ার টেনে বসতে বসতে শান্ত গলায় বললো,

‘অলি বললো তাউই-মাউই নাকি আসবে আজ!’

‘হ্যাঁ।’

‘সে-ও আসবে নাকি আপা?’

ওয়াজিহার কথার এ পর্যায়ে রাফার হাত থেমে গেলো। বোনকে নাস্তা সার্ভ করে দিচ্ছিলো সে। বোনের প্রশ্নে হাতের কাজ বন্ধ করে চেয়ার টেনে পাশে বসলো৷ বোনকে যে বিষয়-টা জানাতে চায়নি! ঠিক সেটাই হলো। পরশ সকালে অফিসের জন্য বেরুনোর আগে অলির সামনেই তার বাবা-মা আসার কথা জানিয়ে গেছে। অলিও দাদী পাগল ছেলে, খুশির চোটে হয়তো ওয়াজিহাকে জানিয়ে দিয়েছে। ওয়াজিহা পরোটা ছিড়ে মুখে পুরে খেতে খেতে ফের প্রশ্ন করলো,

‘ কি হলো! উত্তর দিচ্ছো না?’

‘ আসলে কি তুই আর আজ বাসায় আসবি না নাকি?’

ওয়াজিহা রাফার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। কাঁপা ঠোঁটে উত্তর দিলো,

‘ কি দরকার আপা কাটা ক্ষতে লবণের ছিটা নিজে আগ বাড়িয়ে গ্রহণ করা? কোনো দরকার আদৌও আছে?’

‘কিন্তু কতদিন আর পালিয়ে বেড়াবি সবার থেকে?’

‘পরশ ভাই যে আমার জন্য এত করেছে! এই তো অনেক আপা। থাকুক না, সবার শান্তিই বজায় থাকুক।’

‘ সবার থেকে পালিয়ে বেড়ালেই সব শান্তি বজায় থাকবে? ওনারা এসে তোকে না দেখলেও তো কথা উঠবে।’

‘সামলে নিস। আমি আসছি, আর বাসায় না ফিরলে বুঝে নিস সেখানেই গিয়েছি।’

ওয়াজিহা কথাটুকু বলেই একগ্লাস পানি খেয়ে ডাইনিং টেবিল ছাড়লো। রুমে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাগে ভরে বেরিয়ে পরলো ভার্সিটির উদ্দেশ্য। মাস্টার্সে পড়াশোনা করছে সে। ওয়াজিহা ড্রইং রুম থেকে অলি এবং বোনকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। রাফা শুধু বোনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এছাড়া যে তার আর কিছু করার নেই।

🌸🌸🌸
সকাল সকাল অফিসের কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে না গিয়ে ভার্সিটির সামনে একটা চা-স্টলে দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে ইরাদ। চা খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে অবশেষে সিগারেট কিনে সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে শুরু করেছে। কিছু কিছু বদ অভ্যাসের মাঝে সিগারেট খাওয়া তার একটা বদ অভ্যাস। দারুণ বেখেয়ালি মেয়ে তো! এত সময় লাগে ভার্সিটি আসতে! সিগারেটে লাস্ট টান দিয়ে ছুড়ে মারতেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির পাদচারণা নজরে পরলো ইরাদের। বোরখা হিজাবে সজ্জিত মানুষটিকে আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দেখতে। চোখের চশমা-টা বারবার বিরক্তি নিয়ে ঠিক করতে করতে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে সে। ইরাদ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কখন যে তার চোখের আড়াল হলো! বুঝতে পারলো না ইরাদ। ইশশ আজও কথা বলা হলো না। কথা বলার মতো সাহস টুকু ইরাদের হয় না। ওমন সুন্দর রুমণীর পাশে তারমতো শ্যাম পুরুষকে কি মানাবে! এই বিষয় নিয়ে ভীষণ ভীত-সশস্ত্র থাকে ইরাদ। ২টা বছর হলো মেয়েটিকে আড়ালে আড়ালে অনুসরণ করে লুকিয়ে চুপিয়ে ভালোবেসে চলছে সে। কিন্তু তার জীবনে এত বাজে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে গেছে! মনে পরতেই বুকের মাঝে কেমন একটা চিঁনচিনে ব্যথা অনুভব করলো ইরাদ। ঐ ঘটনাগুলোই তো! ঐ ঘটনাগুলোর জন্যই তার আর এই লুকোনো ভালোবাসার মাঝে এত বাঁধা। সরাসরি বিয়ে করে আগলে নেওয়ার মাঝে তার মা মানতে পারবেনা সেই দেওয়াল হয়ে দাড়িয়েছে বাজে কিছু ঘটনা। কিন্তু ঘটনাগুলোর জের ধরে পিছিয়ে আসার তো মানে হয়না! এবার একটু সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটার সামনে দাড়ালে মেয়েটি কি তাঁকে ফিরিয়ে দিবে? “উফ ইরাদ! রাস্তায় দাড়িয়ে কি সব ভাবছিস!” নিজের চিন্তাভাবনা দেখে নিজেই নিজেকে মৃদু ধমকে কথাটা বলে ইরাদ। চায়ের দোকানের বিল মিটিয়ে পা বাড়ায় নিজের কর্মস্থলের দিকে। তখনই পকেট থাকা ফোন টা বেজে উঠে ইরাদের। পকেট থেকে বের করতেই দেখে তার বাবার নাম্বার ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করছে। বাবার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ইরাদের। তার মা যেমন সামান্য বিষয় নিয়ে রাগারাগি করেন, তার বাবা তেমন নয়। তবুও গতরাতের বিষয় টা নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পরলো ইরাদ। তার মা কি তবে তার বাবাকে বিষয়টা অবগত করেছেন! এজন্যই কি তার বাবা কল করলো! ইরাদের বাবা ফজলু শেখ প্রবাসী মানুষ, কাতার থাকেন। ইরাদ নিজে সামলম্বী হওয়ার পরও বাবাকে রাজী করিয়ে দেশে আনতে পারেনি। কত্তদিন হলো বাবাকে জড়িয়ে ধরা হয়না! ফোন হাতে নিয়ে আনমনা হয়ে বাবার কথা চিন্তা করতে করতেই কলটা কেটে গেলো।

‘আরে ইরাদ ভাই! আপনি এখানে! ফোন বাজছিলো আপনার, কেটে গেলো তো। মন কোথায় রেখে এসেছেন! রাস্তায় দাড়িয়ে একধ্যানে একদিকে তাকিয়ে আছেন যে!’

আচমকা কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে নিজের সামনে দেখে হকচকিয়ে গেলো ইরাদ। ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে বোকা বোকা চাহনীতে হাসলো। মৃদু হেসে বললো,

‘এমনিই এদিকে একটু কাজ ছিলো। মাথা ধরেছিলো একটু, তাই চা স্টল দেখে চা খেয়ে নিলাম। কেমন আছেন ওয়াজিহা?’

ওয়াজিহাও মৃদু হাসলো ইরাদের প্রশ্নে। দুহাত দুহাতে কচলে আলতো স্বরে জবাব দিলো,

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?’

‘আমিও আছি হয়তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো-ই।’

‘হয়তো কেনো?’

‘না কিছু না এমনি। আপনার ক্লাস আছে না? এ সময় ভার্সিটি ছেড়ে বাইরে যে!’

‘ক্লাস আছে, তবে একটু দেরিতেই। একজন আসবে, তার অপেক্ষা করতে করতে বাইরে আসলাম। আপনাকে নজরে পরলো। তাই এদিকে আসা।’

‘ওহহ, কার অপেক্ষা করছেন?’

চলবে?

আসসালামু আলাইকুম, ভুলগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here