#অপেক্ষার_প্রিয়_প্রহর
#পর্বঃ৬
#সাদিয়া_ইসলাম
সন্ধ্যাবেলায়,
ওয়াজিহা এবং রাবিয়া ক্লান্ত শরীরে বাসায় ঢুকলো দুজনে ঘোরাঘুরি, নিজেদের মতো আড্ডা দিয়ে। দুজনে ঘরে ফিরতেই মিসেস আমেনা বললেন,
‘হলো তাহলে মহারানীদের ঘোরাঘুরি। এবার যদি একটু বাসায় থেকে মায়ের রাতের রান্নায় সাহায্য করে উদ্ধার করে দিতেন! তবে ভালো হতো।’
রাবিয়া অলস ভঙ্গিতে পায়ের জুতো খুলতে খুলতে শু-কেবিনেটে রাখতে রাখতে বললো,
‘উফ মা, আসার সাথেই তোমার ক্যাসেট বাজিও না তো। আমার ভালো লাগেনা।’
‘তা লাগবে কেন! আমার একটা মাত্র মেয়ে, আরেক টা মেয়ে-কে বাসায় এনে একটুও আমার সাথে সময় কাটানোর ফুসরত পাচ্ছে না? নিজেদের মাঝে সময় কাটিয়ে হুশ পাচ্ছে না। তবে তাদের আর কি বলবো?’
ওয়াজিহা মা-মেয়ের তর্কাতর্কি বাড়াতে দিতে চাইলো না। মিসেস আমেনার উদ্দেশ্যে বললো,
‘আম্মা, তুমি যাও কিচেনে সব গুছিয়ে নাও। আমরা ফ্রেশ হয়েই আসতেছি।’
মিসেস আমেনা মাথা হেলালেন। ওয়াজিহার কথা মেনে নিয়ে কিচেনে চলে গেলেন। রাবিয়া কটমটিয়ে ওয়াজিহার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এখন এই ক্লান্ত শরীরে কাজ করবো?তোর এনার্জি থাকে তো তুই কর৷ সারা বিকেল লেকে হাঁটাহাটি করে আমার পা নেই হয়ে গেছে।’
ওয়াজিহা এবং রাবিয়া গিয়েছিলো ধানমন্ডি লেকে। সেখানেই দুজনে অনেক-টা হাঁটাহাটি করেছে। যার ফলে এখনই দুজনের পায়ে ভীষণ ব্যথা হয়েছে। ওয়াজিহা রাবিয়ার পিঠে কিল বসিয়ে বললো,
‘তোর মতো অলস দুই টা নাই। বেডি ফাজিল। আম্মার একটা মাইয়া তুই। মায়ের দরদ তুই না করলে কি আমি করবো? একটু সময়ই তো চায় আম্মা। সেটা যদি না দিই! উনারা একাকিত্বে ভুগবে না?’
‘যাদের নিজেদের জীবন-ই একাকিত্বে ভুগে, তারা আর অন্যের একাকিত্ব কি করে দূর করে!’
‘বাদ দে, চল ফ্রেশ হই।’
ওয়াজিহা রাবিয়াকে টেনে নিয়ে রুমে নিয়ে যায়। দুজনে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে আসে। মিসেস আমেনা ওয়াজিহার পছন্দের ডাল, আলু ভর্তা, ডিম ভাজি, সবজি, ছোটো মাছের ভর্তা করার আয়োজন করে ফেলেছেন। সব দেখে ওয়াজিহার অবস্থা বেহাল। এত আদর, এত ভালোবাসা! তার কপালে সইবে তো? সে তো হাত দিয়ে যা ছোয়, তা দুঃখ হয়ে প্রকাশ পায়। সে মিসেস আমেনার গলা জড়িয়ে আদুরে কান্না কান্না কণ্ঠে বললো,
‘আমি বোধ হয় তোমার-ই মেয়ে গো। এত আদর, এত স্নেহ, এত খেয়াল তো মা ছাড়া কেউ রাখে না।’
মিসেস আমেনা ঘুরে দাড়ালেন। ঠাস করে ওয়াজিহার গালে হালকা থাপ্পড় লাগিয়ে বললেন,
‘তুই আমার মেয়ে, এটা নিয়ে তোর কোনো সন্দেহ আছে?’
ওয়াজিহা গালে হাত দিয়ে ফিক করে হেস ফেললো। রাবিয়া গাল ফুলিয়ে বললো,
‘ মা-মেয়ে ভালো-ই আড্ডা দিচ্ছো। আমি বোধ হয় বানের পানিতে ভেসে আসছি। ভালোই তো, আড্ডা ক্যারি অন।’
রাবিয়া ফ্রিজ খুলে আপেল বের তাতে কামড় বসিয়ে কথাটা বললো। মিসেস আমেনা বললেন,
‘ তুই আমার পেটে থেকেও আমারে যা না বুঝিস! ওয়াজিহা তার থেকে ১০০গুণ ভালো বুঝে।’
রাবিয়া মুচকি হাসলো। মায়ের গলা জড়িয়ে বললো,
‘ও তোমায় হাজার গুণ ভালো বুঝুক। ওকে কখনও মায়ের অভাব বুঝতে দিও না।’
ওয়াজিহার খুশিতে চোখে পানি এসে যায়। দু মা-মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। মিসেস আমেনা বললেন,
‘হলো অনেক ইমোশনাল হলে দুজনে। এবার রান্না শেষ করতে সাহায্য করো।’
ওয়াজিহা এবং রাবিয়া মায়ের কথায় হেসে ফেললো। মিসেস আমেনার হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিতে শুরু করে দুজনই। দেড় ঘন্টার মাঝে সব কাজ শেষ হওয়ায় রাবিয়া এবং ওয়াজিহা দুজনই রুমে এসে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পরে। হায় গরম রে বাবা। এই গরমের মাঝে তাদের মা কষ্ট করে রান্না খাওয়ায় তিনবেলা। মায়েদের এত কষ্ট হয়, অথচ হাসিমুখে সবই মেনে নেয় তারা। মুখ ফুটে অভিযোগ করেন না। ফ্যানের বাতাসেও গরম যেনো কমছেনা দুজনের। এরমাঝেই ওয়াজিহার ফোন বেজপ উঠে। হাত বারিয়ে ফোন হাতে নিতেই বুক কেঁপে উঠে ওয়াজিহার। পরিচিত, চিরচেনা সেই নাম্বার। যেই নাম্বার থেকে কল।বসলে একসময় ওয়াজিহার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠতো। আজ কেবল ব্যথা জেগে উঠছে। ওয়াজিহাকে ফোনের দিকে এক নাগারে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাবিয়া হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
‘কিরে, কল রিসিভ না করে বোবার মতো তাকিয়ে আছিস কেনো?’
ওয়াজিহা চমকে উঠে। রাবিয়ার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে,
‘সেই মানুষ টারে রাবু। যার কল আমায় মনে করায় আমার বিষাক্ত অতীতের অপমানের কথা।’
‘কিন্তু এটা কে? ১ম কষ্ট দানকারী! নাকি ২য় জন?’
‘২য় জন তো পরশ ভাইয়ার জোড়াজুড়িতে জীবনে বসার একটা সুযোগ পেয়েছিলো। তাকে আমি কখনও ভালোবাসিনি। কিন্তু যাকে ভালোবেসেছি! তাকে পেতে পেতে হারিয়েছি।’
ওয়াজিহা মৃদু হেসে কথা-টা বললো। এরমাঝে কল এসে কেটেও গেলো। রাবিয়া বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘নাম্বারটা ব্লক কর। তা তো করিস না। কতবার বললাম সীম পাল্টা। সেটাও করিস না।’
‘থাক বাদ দে।’
ওয়াজিহা জবাব দিতেই আবারও ফোন টা বেজে উঠলো। ওয়াজিহা শেঅ থেকে উঠে বসলো। এবার কল টা রিসিভ করলো। রিসিভ করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বরাবরের মতো সালাম দিলো। ওপাশ থেকে সালামের জবাব আসার পর প্রশ্নও আসলো। ওয়াজিহাকে ফোনের ওপর পাশ থেকে প্রশ্ন ছুড়ে বলা হলো,
‘আমায় আজও ভয় পাও? আমি আসায় বাসা ছেড়ে আবারও চলে গেছো? ‘
‘আমায় আপনি করে বলবেন। একদম তুমি করে নয়।’
‘গলায় তেজ-টা রয়ে গেছে দেখছি।’
‘তা তো বরাবরই রয়। কি মনে করে ফোন দিলেন?’
‘দেখো যা অতীত, তা তো অতীতই। আমি এসেছি বলে বাসা থেকে কোথায় না কোথায় থাকছো গিয়ে!, তার দরকার নেই।বাসায় আসো। ভাবী তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করে।’
‘সাথে আপনার মা কটু কথাও শোনায়। যা শোনার ধৈর্য আমার বোনের থাকলেও আমার নেই।’
ওয়াজিহার এই কথায় ফোনের ওপর পাশের ব্যক্তি দমে গেলো
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘একটা ২য় সুযোগ গত ৭টা মাস হতে চেয়ে আসছি। দেওয়া যায় না?’
‘আমার জীবনে ২য় সুযোগ বলে কোনো শব্দ জানা নেই মিঃ ফারহাদ। ভালো হয় আপনি কল না দিলে।’
‘নাম্বার টা ব্লকে ফেললেও পারো ‘
‘হাত টা কাপে ইদানিং। যত হোক একসময় এই নাম্বার থেকে কল আসার অপেক্ষায় গুজরে মরতাম।’
ফারহাদ মৃদু হাসলো। নিস্তেজ কণ্ঠে বললো,
‘মন থেকে উঠলেও মস্তিষ্ক থেকে উঠিনি। ওখানেই জিইয়ে রেখেছো আমায়!’
‘হয়তো রেখেছি। আপুকে চিন্তা করতে মানা করবেন। সময় টা উপভোগ করুন পরিবারের সাথে। আল্লাহ হাফেজ।’
ওয়াজিহা কল কাটলো। ফারহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একটু আগে ভাইয়ের বাসায় ফিরে ভাবীর কাছে ওয়াজিহার খোজ করে না পেয়ে কল দেয়। সে বরাবরের মতোই তেজ দেখিয়ে অস্বীকার করা! অবশ্য দোষ টা তো তারই। অলি এসে পরায় ওয়াজিহার চিন্তা বাদ দিয়ে ভাইপোর আবদার মেটাতে ব্যস্ত হলো ফারহাদ।
এদিকে ফোনটা বুকে জড়িয়ে নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টায় মত্ত হলো ওয়াজিহা। হাসফাস লাগছে কেমন একটা। ফোনের ওপর পাশের মানুষ টা ছিলো ফারহাদ, ওয়াজিহার বোনের দেবর। যাকে একসময় পাগলের মতো ভালোবেসে ওয়াজিহা। কিন্তু ফারহাদ কি করলো! তাকে বিয়ের ঠিক আগের দিন বিয়ে করবেনা বলে নিষেধ করে দিলো সবার সামনে। বিয়ের শপিং, মানুষজনকে দাওয়াত সবই করা হয়েছিলো। বিয়ে-টা গ্রামে হতো। বিয়ের আগেরদিন রাতে তো গ্রামের মানুষজন গীত গায়, পান খেতে আসে। আনন্দ-হাসি মজা, সবাই গোল হয়ে বসে আদা, রসুন, পেয়াজের খোসা ছাড়ানো, জিরা মশলা শিল-পাটায় বাটা! এসবের মাঝেই আনন্দ করে রাত জাগে। সেই আনন্দের রাত টা ফারহাদের একটা কথায় শোকে পরিণত হয়েছিলো৷ দোষ-টা অবশ্য ওয়াজিহার ঘাড়েই পরেছিলো। কি আর করার! যত দোষ, সবই তো নারীর। সম্পর্ক জনিত যেটাই হোক! সব দোষ নারীর-ই। সেই ধারা বজায় রেখে সেবার দোষ টা ওয়াজিহার-ই হয়েছিলো। সে নাকি নিজের রুপ দিয়ে ফারহাদকে ফাসিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। ওয়াজিহার জোড়াজুড়িতেই ফারহাদ রাজী হয়েছে। সে আদৎ এ ওয়াজিহা কে বিয়ে করতে চায় না। যার ফলাফল গ্রামে টিকে থাকা মুশকিল হয়েছিলো তার৷ ইশশশ কি ভাগ্য রে। ভালোবাসার মানুষ আর কিছু ঘন্টার পার্থক্যে নিজের করে পাওয়ার বদলে চিরকালের মতো হারিয়েছিলো ওয়াজিহা। আবার পরশ যখন তার বোন, তাকে নিয়ে শহরে এসে ২য় বার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো! ফারহাদ নিজ দায়িত্বে ওয়াজিহার নামে বদনাম করে বিয়ে-টা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিলো। ওয়াজিহার ২য় বার বিয়েতে তেমন আগ্রহ ছিলো না। হলে হবে! না হলে নাই টাইপ। এজন্য ফারহাদ বিয়ে ভেঙে দিলেও সে কষ্ট অনুভব করেনি। কিন্তু মহল্লার মানুষ জনের কাছে যে অপমান টা সে সহ্য করেছে! এমন অপমান অন্য কোনো নারী পেলে হয়তো নিজেকে শেষ করে দিতো। তার ধৈর্য শক্তি একটু বেশি বলে হয়তো নিজেকে সামলে নিয়েছে ওয়াজিহা। কিন্তু ফারহাদ এমন কেনো করেছিলো! তার উত্তর আজও মেলেনি ওয়াজিহার কাছে। কিন্তু জানার আগ্রহও কেন জানি হয়না তার। অতীতের ক্ষত চোখের সামনে ভেসে উঠতেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো তার ওষ্ঠাধরে। যেই মানুষ তাকে অপমান করে ছেড়েছিলো! সে আজ ২য় সুযোগ চায়! মানুষ বড্ড অদ্ভুত প্রাণী। থাকতে মূল্য দেয়না, হারিয়ে গেলে পারলে পাতালে গিয়েও খুজে বের করার চেষ্টা করে। কি আজব নিয়ম মানুষের। ওয়াজিহা হাটু মুড়ে বসে দুহাতে হাঁটু আকড়ে রুমের সিলিং এর দিকে তাকিয়ে নিজের তিক্ত অতীতের এক পাতা উল্টিয়ে স্মৃতিচারণ করে ফেললো যেন। নিজেকে সামলাতে পারছেনা। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু কিছু করার নেই। নিজেকে সামলাতেই হবে৷ রাবিয়া শুয়ে শুয়ে ওয়াজিহাকে দেখছে। ওর হাসফাস করা দেখে নিজের বুকের ভেতর টায় হাহাকার অনুভব করে রাবিয়া। এই মেয়েটার কষ্ট তারই সহ্য হয়না। মেয়ে টা যে কি করে সহ্য করে! চিন্তা করে সারতে পারেনা রাবিয়া।
চলবে?
আসসালামু আলাইকুম, ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ রইলো।