#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ছোয়া নিজের মতামত সবার সামনে উপস্থাপন করল। নিজের চাচার উদ্দ্যেশ্যে সে বলল,
‘বড় আব্বু, আমাদের হয়তো তোমাদের মতো এত বেশি সহায় সম্পত্তি নেই, কিন্তু আত্মসম্মানটা যথেষ্টই আছে। আমার আব্বু আমাকে শিখিয়েছে যেখানে কোন সম্মান নেই, সেখানে থাকারও কোন প্রয়োজন নেই। আমিও কথাটা মানি। তাই আমি আর চাইনা এখানে থাকতে।’
শাহাদ হোসেনের বুক গর্বে ফুলে উঠল নিজের মেয়ের কথা শুনে। তিনি তো এটাই শুনতে চেয়েছিলেন। একপর্যায়ে নিজের ভাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বলেন,
‘শুনলে তো ভাইয়া আমার মেয়েটা কি বলছে। আমি আমার মেয়ের অমতে কিছু করতে চাইনা। ও যখন এখানে আর থাকতে চায়না তখন ফিরে চলুক আমার সাথে।’
এই কথার পর কেউ আর আপত্তি করতে পারলো না। শাহাদ হোসেন ছোয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
বাড়ি থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিলো তারা। শাহাদ হোসেন ছোয়াকে বলল,
‘এখন তুই কি করতে চাস? বাড়ি ফিরে যাবি নাকি এখানে কোন হোস্টেলে থাকবি।’
ছোয়া তার বাবাকে জানায়,
‘সামনে আমার পরীক্ষা আব্বু। তাই এই সময় বাড়িতে যেতে পারবোনা। তুমি একটা কাজ করো আমাকে কোন হোস্টেলে ভর্তি করে দাও। আমি আমার একটা বান্ধবীর সাথে কথা বলে রেখেছি। সে একটা হোস্টেলও দেখে রেখেছে।’
শাহাদ হোসেন আপত্তি করলেন না। ছোয়ার কথামতো তাকে সেই হোস্টেলেই নিয়ে গেলেন। ছোয়াকে ভর্তি করে দিলেন সেখানে। অতঃপর ছোয়াকে বললেন,
‘আশা করি এখানে থাকতে তোর আর কোন অসুবিধা হবে না। আমি এখন আসছি। বাড়িতে ফিরতে হবে। তুই সাবধানে থাকিস।’
ছোয়া তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বরাবরই বাবারা মেয়েদের কাছে ভরসাস্থল হয়। ছোয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। শাহাদ হোসেনের কাছে থাকলে তার মনোবল যেন অনেক বেশি বেড়ে যায়। শাহাদ হোসেন ছোয়াকে হোস্টেলে রেখে বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেন। ছোয়া হোস্টেলে সবকিছু গুছিয়ে রাখছিল। হঠাৎ করে সে নিজের ব্যাগের মধ্যে একটি গোলাপ ফুল আর চকলেট পায়। ছোয়া খুব অবাক হয় এটা ভেবে যে এগুলো তার ব্যাগে কে রাখল। ছোয়া চকলেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখে সেখানে লেখা,
‘এটা আমার প্রিয় আপাই এর জন্য। তুমি যেখানেই থাকো, তোমাকে আমার তরফ খুব ভালোবাসা।’
ছোয়া বুঝতে পারে এগুলো আলিয়া তাকে দিয়েছে। মেয়েটা তাকে খুব ভালোবাসে। শুধু আলিয়া কেন ঐ বাড়ির সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। শুধু আমানই কেন জানি তাকে সহ্য করতে পারে না। ছোয়া আর বেশি কিছু ভাবল না। চকলেটটা খেয়ে নিয়ে গোপাল ফুলটা নিজের ডায়েরির মধ্যে রেখে দেয় যত্ন সহকারে।
৩.
আমান নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। তার মন মেজাজ একদম ভালো নেই। সিড়িতে দাড়িয়ে থেকে আমান ছোয়া ও তার বাবার সব কথা শুনেছে। আমান নিজের সব রাগ উড়তে দেয় দেয়ালের উপর। দেয়ালে একটার পর একটা ঘু’ষি দিতে থাকে। এভাবে এক সময় তার হাত বেয়ে তরল রক্তের স্রোত নামে। আমান তবুও ক্ষান্ত হয়না। নিজের আহত হাতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
‘এই আঘাত তো কিছুই না। আমার মনে যেই আঘাত লেগেছে যেই ক্ষত তৈরি হয়েছে তার উপশম কোথায় পাবো আমি? তুই আমার মনের কথা বুঝতে পারলি না ছোয়া। কখনো বোঝার চেষ্টাও করলি না।’
আমান নিজের মানিব্যাগ থেকে ছোয়ার একটা ছবি বের করে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘মেয়েরা নাকি অনেক বেশি সজাগ হয়। তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নাকি অনেক বেশি শক্তিশালী তাহলে তুই ব্যতিক্রম হলি কেন ছোয়া? আমার বয়সন্ধিকাল থেকে যখন থেকে প্রেম-ভালোবাসা এগুলো বুঝতে পেরেছি তখন থেকেই তোকে যে আমি বড্ড ভালোবাসি। শুধুমাত্র তোর জন্য ঘনঘন ছুটে যেতাম গ্রামের বাড়িতে। তোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম অমিনেষ। তুই কি আমার সেই চাহনির মানেও বুঝতে পারিস নি?’
কথাগুলো বলে অতঃপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ে আমান। ছোয়ার ছবিটা নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়।
বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে গত কয়েকদিনের কথা। দুদিন আগেই নিজের বাবা আব্দুল হোসেনের আদেশ মোতাবেক ছোয়াকে গ্রাম থেকে শহরে আনার জন্য এসেছিল আমান। গ্রামে এসে সে অনেক বেশি খুশি ছিল। কারণ সে আজ অনেক দিন পর তার হৃদয়হরণী ছোয়াকে দেখতে পারবে। আমানের খুশির আরো বড় কারণ ছিল ছোয়া এখন থেকে তাদের বাড়িতেই থাকবে। অর্থাৎ সে সবসময় ছোয়াকে দেখতে পারবে এই নিয়ে আমানের খুশির শেষ ছিল না।
আমানকে গ্রামে আসার পর ছোয়ার বাবা শাহাদ হোসেন ও মা মতিয়া বেগম তার অনেক আদর আপ্যায়ন করে। তবেই আমানের চোখ তো কেবল ছোয়াকে খুজছিল। কিন্তু বরাবরের মতোই ছোয়া তার সামনে আসে না। এতে অবশ্য আমান খুব একটা অবাক হয়না।
কারণ আমান জানে ছোয়া তাকে ভয় পায়। আমরা যাকে ভালোবাসি তাকেই তো সবথেকে বেশি শাসন করি। ছোয়ার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আমান ছোয়াকে অনেক বেশি ভালোবাসে জন্য যখন থেকে ছোয়ার প্রতি নিজের ভালোবাসা বুঝতে পেরেছে তখন থেকেই ছোয়াকে শাসন করত, একটু বকাবকি করত। সবটা অবশ্য তার ভালোর জন্যই। কারণ গ্রামে এলেই আমান দেখতে পারত ছোয়া পড়াশোনায় একেবারে অমনোযোগী। সারাদিন শুধু গ্রামে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। এসবই আমানের সহ্য হতো না। তাই সে ছোয়াকে বকাবকি করত।
৪.
অবশেষে আমানের অপেক্ষার অবসান ঘটেছিল। ছোয়া শরবতের গ্লাস নিয়ে এসেছিল আমানকে দিতে। আমানের দিকে গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলেছিল,
‘ভাইয়া এই নাও তোমার শরবত। আম্মু পাঠিয়েছে।’
আমান ছোয়ার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু ছোয়া ভয়ে মাথা নিচু করে থাকায় আমানের সেই দৃষ্টি তার আড়ালেই থেকে যায়। আমান শরবতের গ্লাস হাতে নিতেই ছোয়া তড়িঘড়ি করে চলে যায়। আমান সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
‘অবশেষে তোমাকে দেখার তৃষ্ণা আমার মিটল।’
এভাবে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। সেদিন রাতটা আমানকে ছোয়াদের বাড়িতেই থেকে যেতে বলেন ছোয়ার বাবা শাহাদ হোসেন। আমানও রাজি হয়ে যায়। কথা ছিল পরের দিন ছোয়াকে নিয়ে আকাশ শহরে তাদের বাড়িতে ফিরবে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমান তার জন্য বরাদ্দ করা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। তার পাশেই ছিল শাহাদ হোসেন ও মতিয়া বেগমের ঘর।
আমান নিজের কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিল। হঠাৎ চিৎকার চেচামেচির শব্দে কান থেকে হেডফোন নামিয়ে নেয় আমান। তখন সে শুনতে পায় পাশের রুম থেকে মতিয়া বেগম বলছেন,
‘মাইয়াটাকে পড়াহুনার জন্যে শহরে পাঠানোর দরকার কি কও তো? মাইয়া মানসের এত পড়াশোনা দিয়া কি হবে? তার থাকি বিয়া সাদি দিয়া দিলে ভালো হইত। গেরামের চেয়ারম্যানের পোলা তো বিয়ার প্রস্তাব দিয়াছেই।’
মতিয়া বেগম গ্রামের আর পাচটা মহিলার মতোই চিন্তাধারা রাখেন। কিন্তু শাহাদ হোসেন একজন শিক্ষিত মানুষ। তাই তিনি শিক্ষার মর্যাদা জানেন। তিনি মতিয়া বেগমকে বলেন,
‘আমার মেয়েকে আমি লেখাপড়া করাবো। এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছা। আমার মেয়েকে নিজের পায়ে দাড়ানো দেখব তারপর ওর বিয়ের কথা ভাবব। আর আমি তো চেয়ারম্যান সাহেবের প্রস্তাবে রাজি আছিই। তিনিও বলে দিয়েছেন ছোয়ার পড়াশোনা নিয়ে তার আপত্তি নেই। চেয়ারম্যানের ছেলে জাহিদ ছোয়াকে পছন্দ করে। তার জন্য কয়েক বছর অপেক্ষা করবে জন্যেও জানিয়েছে। তাই তুমি আর এসব নিয়ে তর্ক করো না। আমার মেয়েটা শহর থেকে পড়াশোনা শেষ করে এলেই আমি ওর বিয়ে দেব।’
এই কথাগুলো শুনে আমানের প্রচণ্ড রাগ হয়। সেই কবে থেকে সে ছোয়াকে ভালোবাসে। অথচ তার সাথে কিনা অন্য একজনের বিয়ে হবে। এই কথাটা কিছুতেই মানতে পারে না আমান। পরের দিন যখন ছোয়াকে নিজের সাথে করে নিয়ে আসে তখন ছোয়ার দিকে তাকাতেই তার রাগ হচ্ছিল। সেই রাগ থেকে রাস্তার মধ্যেই গাড়িতে ছোয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলে আমান। পরে অবশ্য বাড়িতে পৌছানোর পর একটু আফসোস হয়। কিন্তু সেদিন রাতে যখন আলিয়ার রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমান আলিয়া ও ছোয়ার কথোপকথন শুনতে পায় তখন তার রাগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর কারণ ছোয়া আলিয়াকে বলছিল,
‘কি জিজ্ঞেস করছিলে তুমি? প্রেমের ব্যাপারে। না আমার প্রেম করার কোন ইচ্ছা নেই। শহরে শুধু পড়াশোনা করতেই এসেছি। আমার বিয়ে তো ঠিক হয়েই আছে। আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে। এখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে ফিরেই আমাদের বিয়েটা হবে।’
এই কথাগুলো আমানকে অনেক বেশি রাগিয়ে দিয়েছিল। সারারাত ভালো করে ঘুমাতে পারে নি আমান। সেই কারণেই তো আজ সকালে ছোয়ার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিল। আর তারপর এতকিছু হয়ে গেল।
পুরাতন স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আমান বলে,
‘সবাই শুধু বাইরের টাই দেখে, ভেতরের অবস্থাটা কেউ দেখার চেষ্টা করে না।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨