#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ছোয়া নিজের বিয়েতে রাজি না থাকলেও আজ হঠাৎ করেই আবার সবার সাথে স্বাভাবিক হয়েছে। রাত পোহালেই ছোয়ার বিয়ে হওয়ার কথা। সবাই ভেবেছিল ছোয়া বোধহয় এরমধ্যে বড়সড় কিছু একটা করবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছোয়া স্বাভাবিক ভাবে নিজের কাজিনদের সাথে খোশগল্প করছে। যা দেখে অবাক প্রত্যেকে। তবে মতিয়া বেগমের মুখে খুশির আমেজ। তিনি নিজের বড় ভাই মোজাম্মেল হক’কে বললেন,
‘দেখলা তো ভাইয়া আমার মাইয়ার বিয়াতে কোন অসুবিদা নাই। আমি তো কইছিলামই মাইয়ারা এমন ঢং করেই। এহন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেলেই আমার শান্তি।’
অন্যদিকে ছোয়ার মনে অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে মূলত আমানের কথাতেই সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে মিশছে। কিন্তু কেন এমন করতে হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না। আমানের উদ্দ্যেশ্য ছোয়ার কাছে পরিস্কার নয়। কিন্তু এই মুহুর্তে আমানের কথা শোনা ছাড়াও তার আর কিছু করার নেই৷
ছোয়ার মামাতো বোন নিলিমা তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘শুনলাম তুই বিয়েতে রাজিই ছিলিস না। এখন হঠাৎ সবকিছু মেনে নিচ্ছিস কেন?’
ছোয়া কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘আমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখছি। তিনি যা চান তাই হবে। আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কিছুই ঘটতে পারে না৷ আমি জানি তিনি আমার সাথে খারাপ কিছু হতে দেবেন না। আমি অবশ্যই নিজের বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারব।’
আলিয়া ছোয়ার হাত ধরে বলে,
‘এসো তোমাকে আজ মেহেন্দি পড়িয়ে দেই। গ্রামে মনে হয় এসব রিচুয়াল নেই কিন্তু আমি দেখেছি শহরে কারো বিয়ে হলে বিয়ের আগের দিন হাতে মেহেন্দি পড়ানো হয়।’
আলিয়া ছোয়ার হাতে মেহেন্দি পড়ানো শুরু করে। একপর্যায়ে বলে,
‘তোমার হবু বরের নাম যেন কি আপুনি?’
ছোয়া ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘জাহিদ।’
আলিয়া ছোয়ার হাতে জাহিদের নাম লিখতে যাবে তখনই হঠাৎ আমান এসে তাকে থামতে বলে। আলিয়া ভ্রু কুচকে আমানের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমাকে তুই এভাবে থামতে বললি কেন?’
আমান ছোয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে অতঃপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
‘ছোয়ার হবু বরের পুরো নাম আতিকুল কবির জাহিদ। তাই তুই ওর হাতে J না লিখে A লিখ। বুঝলি?’
আলিয়া বলে,
‘আচ্ছা আমি তাই লিখছি।’
ছোয়া হতবাক নয়নে আমানের দিকে তাকায়। আমানকে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার হবু বরের নাম আপনি কিভাবে জানলেন?’
‘বিয়ের কার্ডে দেখেছি।’
আর কোন প্রশ্ন করে না ছোয়া। এই ব্যাপারটা নিয়ে সে আর তেমন মাথাও ঘামায় না। আমান নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে,
‘তোর হাতে আমার ছাড়া অন্য কারো নাম আমি লিখতে দেইনি। ঠিক তেমনি তোকে আমি ছাড়া আর অন্য কারো হতে দিবো না ইনশাআল্লাহ।’
১৩.
সকাল থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। আজ রাতেই ছোয়া ও জাহিদের বিয়ে হওয়ার কথা। সময় যত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ছোয়ার বুক ধড়ফড়ানি ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার মনে নানা সংকোচ কাজ করছে। আজ সকাল থেকে আমানকে দেখে নি ছোয়া। তাই বেশ চিন্তার মধ্যে আছে সে। ছোয়ার বারবার মনে হচ্ছে আমান তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে চলে যায়নি তো। এমন সময় আমানের করা খারাপ ব্যবহার গুলোর কথা ছোয়ার মনে পড়ে। ছোয়া নিজের কপাল চাপড়ে বলে,
‘আমান ভাইয়াকে বিশ্বাস করাই আমার উচিৎ হয়নি৷ উনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন না। তাই তো আমি ভাবি উনি কেন আমায় সাহায্য করতে চাইবেন। নিশ্চয়ই উনি আমার সাথে নাটক করেছেন। উনি চান যেন আমার বিয়েটা হয়ে যাক। তাই আমাকে স্বাভাবিক হতে বলেছেন। না আমার এভাবে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। নিজের বিয়ে আমার নিজেরই ভাঙতে হবে।’
ছোয়া ভাবতে থাকে কিভাবে বিয়েটা ভাঙবে। কিন্তু তার মাথায় কিছু আসে না। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায় কিছু দিন আগে একটা সিনেমায় দেখেছিল নায়িকা নিজের এক বান্ধবীকে নিজের ঘরে বসিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। ছোয়ার মাথাতেও সেই বুদ্ধি আসে। ছোয়া তৎক্ষণাৎ নাদিয়াকে কল করে। নাদিয়া ফোন রিসিভ করতেই ছোয়া বলে,
‘এই নাদু কই তুই?’
নাদিয়া দাত কটমট করে বলে,
‘তোকে কতবার বলেছি না আমাকে এই বিশ্রী নামে ডাকবি না। আর তুই আমার খবর জিজ্ঞেস করছিস কোন মুখে? তোর নিজেরই তো কোন খবর নেই।’
‘তুই তো জানিস আব্বুর মৃত্যুর ব্যাপারে। আমি এখন গ্রামেই আছি। আজ আমার বিয়ে আর,,,,’
ছোয়া নিজের কথা সম্পূর্ণ করার আগেই নাদিয়া বলে ওঠে,
‘কি বললি তুই? আজ তোর বিয়ে! লাইক সিরিয়াসলি! তোর বিয়ে আর আমি জানি না। আমাদের এত বছরের বন্ধুত্ব আর তুই নিজের বিয়েতে আমাকে ইনভাইটও করলি না। এক মিনিট এক মিনিট, তোর আব্বুর মৃত্যুর বেশিদিন এখনো তো হয়নি তাতেই তুই বিয়ে করবি?’
ছোয়া বলে,
‘সেসব অনেক বড় গল্প। এত কথা ফোনে বলার সময় নেই। তুই এক কাজ কর এক্ষুনি আমাদের গ্রামের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দে। আমি ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোকে আমার খুব প্রয়োজন নাদু।’
‘আবার নাদু,,,’
‘সরি ভুল হয়ে গেছে। তুই চলে আয় বোন। তোকে ছাড়া আমার চলবে না। তুই এখন আমার একমাত্র ভরসা।’
নাদিয়ার ভ্রু কুচকে যায়। সে বলে,
‘আমাকে এত পাম দেওয়ার কারণ কি? নিশ্চয়ই তোর মনে কিছু চলছে। যাইহোক আমি আসছি। তুই ঠিকানা টেক্সট করে পাঠিয়ে দে।’
১৪.
ছোয়া বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে। ২ ঘন্টা বাদেই তার বিয়ে। এখনও নাদিয়ার কোন দেখা নেই। এদিকে বিয়ে বাড়িতে অনেক মানুষের ভিড় লেগে গেছে। ছোয়া নাদিয়াকে বারবার ফোন করছে কিন্তু তার ফোনও বন্ধ দেখাচ্ছে। ছোয়া মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে।
‘আল্লাহ তুমি আমায় সাহায্য করো। প্লিজ নাদিয়াকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও। এখন ও ছাড়া যে আমার আর কোন ভরসা নেই।’
ছোয়া নাদিয়ার ভাবনাতে ব্যস্ত ছিল এমন সময় আমান ছোয়ার রুমে প্রবেশ করে। ছোয়া আমানকে দেখে রাগী গলায় বলে,
‘কোথায় ছিলেন সারাদিন? খুব তো বলেছিলেন আমার বিয়ে আটকাবেন। আপনার উপর ভরসা করাই আমার ভুল হয়েছে। আমি জানি আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন। আপনি চান এই বিয়েটা হোক।’
আমান সবেমাত্র বাড়িতে ফিরেছে। এখনো হাফাচ্ছে ছেলেটা। আজ সারাদিন ছোয়ার বিয়েটা আটকানোর জন্য কত কি করল। অথচ সেই ছোয়াই তাকে এভাবে বলছে। সহসাই আমানের মেজাজ গরম হয়ে গেল। ছোয়াকে নিজের শক্ত বাহুডোরে নিয়ে বলল,
‘চুপ আর একটা কথাও বলবি না। আমি নিজের কথা রাখি। আমি যখন একবার বলেছি তোর বিয়ে আটকাবো মানে আমি সেটা আটকাবোই। তোকে আমার উপর ভরসা রাখতেই হবে।’
কথাগুলো বলে আমান রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ছোয়া বিড়বিড় করে বলে,
‘আমি আর তোমার উপর ভরসা করছি না। যা করার এবার আমার নিজেকেই করতে হবে। এই নাদিয়াটা আসছে না কেন।’
এমন সময় ছোয়া কিছু কাজিন এলো তার ঘরে। তাদের দায়িত্ব ছোয়াকে বউয়ের সাজে সাজিয়ে দেওয়া। গ্রামের দিকে মূলত পার্লার থেকে সাজানোর নিয়ম তেমন নেই। সেখানে কাজিন,পাড়া প্রতিবেশীরাই সাজিয়ে দেয়।
ছোয়ার কাজিনরা মিলে তাকে বিয়ের সাজে সাজিয়ে দিল। সবাই তার বেশ প্রশংসা করছিল। নিলিমা বলে,
‘আজ দেখিস তোর বর তোর থেকে চোখই সরাতে পারবে না।’
বাকি সবাইও তালে তাল মিলিয়ে ঠাট্টা করছিল। ছোয়ার এসব একদম ভালো লাগছিল না। সে তো কেবল নাদিয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
ছোয়ার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নাদিয়ার আগমন ঘটে। নাদিয়া ছোয়ার রুমে এসে বলে,
‘অনেক খুজে তোদের বাড়িতে আসলাম।’
নাদিয়াকে দেখামাত্রই ছোয়া তার কাজিনদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘ও আমার বান্ধবী। ওর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। তোমরা একটু বাইরে যাও।’
ছোয়ার কথামতো সবাই বাইরে চলে যায়। ছোয়া ঘরের দরজা ভালো করে বন্ধ করে। নাদিয়া বলে,
‘দরজা বন্ধ করছিস কেন? কি বলবি বল।’
ছোয়া বলে,
‘আমার হাতে বেশি সময় নেই। তুই নিজের জামা খুলে আমায় দে। আর আমার শাড়িটা পড়ে নে।’
‘মানে কি বলছিস এসব তুই?’
‘প্লিজ বেস্টু আমার অনুরোধ টা রাখ। তুই শুধু এক ঘন্টা বউ সেজে বসে থাক। বিয়ের আগে নিজের মুখ দেখাবি সবাইকে তাহলেই হলো। প্লিজ আমার এইটুকু উপকার কর। আমি বিয়েটা করতে চাইনা। আমার আব্বুর শেষ ইচ্ছা আমার পূরণ করতে হবে।’
নাদিয়া প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। ছোয়া অনেক কষ্টে তাকে রাজি করায়। অতঃপর নাদিয়ার ড্রেস নিজে পড়ে নেয় এবং নাদিয়াকে বউয়ের সাজে সাজিয়ে দেয়।
ছোয়া মুখে ওড়না পেচিয়ে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। সবাই ভাবে সে ছোয়ার বান্ধবী তাই কেউ কিছু বলেও না। ছোয়া খুব সাবধানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨✨