প্রেমের_পরশ #পর্বঃ১৭

0
220

#প্রেমের_পরশ
#পর্বঃ১৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ছোয়াকে আব্দুল হোসেন পুনরায় জিজ্ঞেস করেন,
‘তুমি যা বলছো ভেবে বলছ তো? আমানের জন্যে তোমার মনে সত্যিই কি কোন অনুভূতি নেই?’

ছোয়া আবার নেতিবাচক ভাবে মাথা নাড়ায়। আব্দুল হোসেন আর জল ঘোলা করতে চাইলেন না। তাই তিনি বললেন,
‘আমি শুধু তোমার মতামতটাই জানার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিছু মনে করো না। তুমি যখন আমানকে পছন্দ করো না, তখন এই নিয়ে আমি আর ঘাটবো না।’

আব্দুল হোসেন একবুক হতাশা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। তিনি যাওয়ার পর ছোয়া আলগোছে দরজাটা বন্ধ করে দিল। অতঃপর ভাবতে লাগল, আসলেই কি তার মনে কিছু আমানের জন্য? সব ভাবনা যেন তার বৃথা গেল। কারণ সে কিছুই ঠাহর করতে পারল না৷ অগত্যা, হতাশ মন নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।


আমান নিজের রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে, অতঃপর হাতের নাগালে যা পেয়েছে সেটাই ছু’ড়ে মে’রেছে মেঝেতে। এভাবে যেন নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে সে! কিন্তু এই রাগ কি এত সহজে সামলানো যায়? আমান পারছে না নিজের অসীম রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ছোয়ার বলা কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে। যা তার মনকে বিশাল আঘাত দিচ্ছে। কত কি ভেবে রেখেছিল সে ছোয়াকে নিয়ে। একটা সুখের সংসারের স্বপ্ন ছিল আমানের। কিন্তু সেই স্বপ্নটা যেন ছোয়া যত্ন করে ভেঙে দিল!

আমান নিজের আবেগকে আর নিজের বশে রাখতে পারল না৷ মেঝেতে লুটিয়ে কাদতে লাগল অনবরত। ছোয়ার প্রত্যাখ্যান কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। আমান আনমনেই ছোয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলতে লাগল,
‘এমন কেন করলে তুমি? আমাকে একটু ভালোবাসলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত?’

আব্দুল হোসেন আমানের সাথে কথা বলার জন্য তার রুমের বাইরে দাড়িয়ে আছেন৷ বাইরে থেকে ভাঙচুরের শব্দ শুনে তিনি আর ঘরের দিকে পা বাড়ানোর সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই জোগাতে পারেন নি। তাই অপেক্ষা করছেন সঠিক সময়ের। আমানের রাগ কিঞ্চিৎ কমলেই রুমে প্রবেশ করবেন বলে ভেবে রেখেছেন তিনি। কারণ এই সময় ভেতরে গেলে হয়তো আমান আরো বেশি রেগে যাবে।

৩৩.
নানান ভাবনার শেষে অবশেষে মনে সাহস জুগিয়ে নিজের ছেলের রুমে প্রবেশ করলেন আব্দুল হোসেন। রুমে এসেই প্রথমে লক্ষ্য করলেন সেখানকার বিধ্বস্ত অবস্থা। ফুলদানি, পারফিউমের বোতল সহ আরো অনেক কিছু মেঝেতে সরিয়ে ছিটিয়ে আসে। রুমের এই রূপ অবস্থা দেখে তিনি তপ্ত শ্বাস ফেললেন। অতঃপর আমানের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
‘তুই কি এখনো ছোট বাচ্চা আছিস আমান? এটা কি অবস্থা করেছিস রুমের? সবকিছু ঠিক করে নে।’

আমান নিদারুণ কষ্ট জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,
‘এই রুমকে ঠিক করে কি হবে আব্বু? আমার মনটাই তো ঠিক নেই। তুমি এই রুমে পড়ে থাকা ভাঙা ফুলদানিটা দেখতে পাচ্ছ? এইরকম ভাবে আমার মনটাও ভেঙে গেছে!’

আব্দুল হোসেন বলে উঠলেন,
‘আমি সব বুঝতে পারছি। কিন্তু তুই তো বড় হয়েছিস। তোর বোঝার বয়সও হয়ে গেছে৷ তোর থেকে এরকম ছোট বাচ্চার মতো আচরণ আশা করিনি আমি।’

‘তুমি এটা বুঝবে না আব্বু। আমার কষ্টটা তুমি কোন ভাবেই অনুভব করতে পারবে না৷ কারণ তুমি আমার মতো পরিস্থিতি দিয়ে কখনো যাওইনি।’

আব্দুল হোসেন মৃদু হেসে বললেন,
‘তুই আমার ছেলে, আমি তোর বাবা। আমি তোর সম্পর্কে সব জানলেও তুই আমার ব্যাপারে কিছুই জানিস না। তাই হয়তো এত বড় একটা কথা এত সহজে বলে দিলি!’

‘মানে কি বলতে চাইছ তুমি আব্বু?’

‘মন ভাঙার কষ্টটা আমিও বুঝি রে! তুই তো তবু এমন একজনকে হারাতে চলেছিস যে তোকে ভালোবাসেনি, আর আমি তো এমন একজনকে হারিয়েছি যে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আমায় ভালোবাসতো!’

আমানের কৌতুহল হয় খুব তার বাবার অতীত সম্পর্কে জানার জন্য। এই কৌতুহলকে দমন করতে না পেরে সে প্রশ্ন করেই বসে,
‘তুমি কি নিজের অতীত সম্পর্কে আমাকে বলবে আব্বু?’

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আব্দুল হোসেন কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন৷ আবেগের বসে নিজের ছেলের সামনে কিসব বলে ফেললেন! এখন তার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। আব্দুল হোসেনকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে আমান পুনরায় বলে,
‘প্লিজ আব্বু, আমাকে বলো৷ আমার এই মুহুর্তে খুব জানতে ইচ্ছা করছে। হয়তো তোমার অতীত বর্তমানে আমাকে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে দুঃখটা ভোলার জন্য।’

আব্দুল হোসেন ভাবলেন এবার নিজের ছেলেকে নিজের অতীতের ব্যাপারে বলবেন। এত দিন তো খুব যত্নে নিজের মধ্যে সবটা লুকিয়ে রেখেছিলেন। এখন না হয় বলেই দিক। এতে হয়তো তার মনটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও হালকা হবে।

৩৪.
আব্দুল হোসেন আমানকে তার অতীত সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন,
‘আমি ছিলাম আমার বাবা-মায়ের বড় সন্তান। দুই ভাইয়ের মধ্যে আমিই ছিলাম বাবা-মায়ের বেশি আদরের। কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটি উঠতেই আমার সাথে পরিচয় হয় জান্নাতুলের সাথে। মানে তোমার মায়ের সাথে। আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্ব ছিল। তবে তোমার মা হয়তো মনে মনে আমাকে পছন্দ করতো। যদিও কখনো সে এই ব্যাপারে আমায় কিছু বলে নি আজ অব্দি। তবে আমি পছন্দ করতাম অন্য একজনকে। আমার চাচাতো বোন নূর জাহানকে। শুধু আমি একা নই নূর জাহানও আমায় পছন্দ করতো। এমনকি পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়েও ঠিক হওয়া ছিল। কথা ছিল আমি পড়াশোনা শেষ করে কোন চাকরি পেলেই নূর জাহানকে বিয়ে করবো। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। এরমধ্যে একবার ঈদের ছুটিতে জান্নাতুল আমার কাছে বায়না করে সে আমার গ্রামে আসতে চায়। কারণ সে নাকি আগে কখনো গ্রামে ঈদ সেলিব্রেট করে নি৷ আমি যদিওবা প্রথমে রাজি ছিলাম না কিন্তু সে এত বার করে রিকোয়েস্ট করে যে আর ফেলতে পারে নি। সেইবার ঈদে আমি জান্নাতুলকে নিয়ে গ্রামে যাই। জান্নাতুল শহরের মেয়ে ছিল তাই গ্রামের নিয়ম কানুন ওতো বুঝতো না। আমার মা-বাবা অবশ্য আধুনিকমনা ছিলেন তাই তারা এ নিয়ে কিছু মনে করতো না কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেক কিছু বলতো। এমনকি নূর জাহানের মা-বাবাও জান্নাতুলকে ভালো নজরে দেখতো না। ঈদের পরের দিন জান্নাতুল আমার কাছে বায়না করে সে গ্রাম ঘুরে দেখতে চায়৷ সেদিন আকাশ মেঘলা ছিল জন্য আমি ঘুরতে চাই নি কিন্তু জান্নাতুল নাছোড়বান্দা ছিল। আমার আম্মুও আমাকে বলে ওকে যেন গ্রাম ঘুরিয়ে আনি। তাই আমিও বাধ্য হই। ঘুরতে ঘুরতে আমরা গ্রামের শেষ সীমানায় চলে যাই। এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। উপায়ন্তর না পেয়ে আমরা গ্রামের শেষ প্রান্তে থাকা পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেই। বৃষ্টির মরশুম ছিল। তার উপর ঘুরতে ঘুরতে আমরা দুজনেই ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম। আমি জমিদার বাড়ির মেঝেতেই শুয়ে পড়ি। অতঃপর ঘুমে তলিয়ে যাই। ঘুম ভাঙে মানুষনের কোলাহলে, ঘুম ভাঙতেই দেখতে পাই জান্নাতুল আমার কোলেই শুয়ে আছে।হয়তোবা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার ছিল এটাই যে গ্রামের কিছু কৃষক হয়তো আমাদের মতোই বৃষ্টির জন্য এখানে আশ্রয় নিতে আসে৷ আমাদের এই অবস্থায় দেখে হয়তো তারা খারাপ কিছু ভাবে। গ্রামে কোন কথা ছড়াতে সময় লাগে না। এই কথাটাও দ্রুত ছড়িয়ে যায়। গ্রামে বিচার সভা বসে আমাদের নিয়ে। অভিযোগ আমরা নাকি ব্যভিচার করেছি! আমার আব্বু গ্রামে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি ছিল। কিন্তু সেদিন সবার সামনে তাকে অনেক অপমানিত হতে হয়। বিচারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আমাদের বিয়ে দেওয়ার! নচেৎ আমার পুরো পরিবারকে গ্রামছাড়া হতে বলা হয়! আমি গ্রাম ছাড়তে প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু এই অন্যায় প্রস্তাব মানতে নয়। আমার আব্বু সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে, গ্রাম্য সালিশের বিচার মেনে নিলেন। কেননা, তিনি এই গ্রাম ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না। সবকিছু আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আমি আর কোন উপায় দেখতে না পেয়ে নূর জাহানের সাথে দেখা করি। নূর জাহান আমাকে জানায়, সে আমাকে বিশ্বাস করে কিন্তু তার পারিবার আমার থেকে দূরে থাকতে বলেছে৷ তবুও সে আমাকেই চায়। আমিও সিদ্ধান্ত নেই নূর জাহানকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার। এর মাঝে বাধা হয়ে দাড়ায় আম্মু। তিনি আমাকে নিজের নামে কসম করিয়ে বলেন জান্নাতুলকে বিয়ে করতে। কারণ এমনটা না হলে নাকি আব্বুর আত্ম*হ*ত্যা ছাড়া কিছু করার থাকবে না। সেদিন আম্মুর কথা রাখতে গিয়ে আমি হারিয়ে ফেললাম নিজের ভালোবাসাকে! জান্নাতুলের সাথে আমার বিয়েটাও হয়ে গেল। এরপর থেকে আমি শহরে সেলেট হই। খুব কমই যাই গ্রামে। এরমধ্যে একদিন খবর পাই নূর জাহান আর নেই! ওর পরিবার ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মদ্যপ লোকের সাথে টাকার জন্য ওর বিয়ে দিয়েছিল। সেই শ*য়তানটাই ওকে শে’ষ করে দিয়েছে। এভাবে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলি নূর জাহানকে। শেষবারের মতো ওকে দেখতেও পাইনি।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here