#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩২
জাওয়াদ জামী
রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে ধরিত্রীর বুকে। শহিদ আহমেদ বাগানে পায়চারী করছেন। আজ রাতেও তিনি ঘুমাননি। সেদিন আইরিনের শেষ পরিনতি জানার পর থেকেই তার চোখের ঘুম উবে গেছে। নিজেকে বারংবার দোষী ভাবছে মন। বারবার মনে হচ্ছে সে পাপী। তার এই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে না পারলে ম’রেও শান্তি পাবেননা তিনি।
চারপাশে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি বাজতেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলেন শহিদ আহমেদ। সামনে তাকাতেই লক্ষ্য করলেন দারোয়ান মেইন গেইটের দিকে যাচ্ছে।
” এই ভোরে দারোয়ান কোথায় যাচ্ছে? মাত্রই তো আজান দিচ্ছে! ” নিজের সাথে কথা বলেই শহিদ আহমেদ দারোয়ানের দিকে প বাড়ান।
ততক্ষণে দারোয়ান গেইট খুলে দিয়েছে। আর ভেতরে ঢুকছে তার ছোট ছেলের গাড়ি। শহিদ আহমেদ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন গাড়ির দিকে। শুভ গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলে ওর সমানে যেয়ে দাঁড়ায় শহিদ আহমেদ।
” এত ভোরে তুমি কোথায় থেকে আসলে? কোথায় ছিলে সারারাত? ”
” উফ্ বাবা, বাসায় আসতে না আসতেই তুমি শুরু করে দিয়েছ? তোমার ঘ্যানঘ্যানানিতে বাসায় এসেও শান্তি নেই। জাষ্ট অসহ্য লাগে তোমার এমন গোয়েন্দাগিরি। সব সময় বাবা গিরি ফলিয়ে কি এমন শান্তি পাও? ” শুভ টলছে। ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা।
শহিদ আহমেদের বুঝতে বাকি থাকেনা, তার ছেলে নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে শহিদ আহমেদ কথা বলার ভাষা হারিয়েছেন। তার ছেলের এতটা অধঃপতন হয়েছে ভাবতেই তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। সেই সাথে রা’গও তরতর করে বাড়ছে। তিনি ছেলেকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে আসলেন। ভেতরে এসেই স্ত্রীকে চিৎকার দিয়ে ডাকতে থাকেন।
স্বামীর ডাক শুনে আকলিমা খানম রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ড্রয়িংরুমে এসে স্বামীর সাথে ছেলেকে দেখে তার কলিজা শুকিয়ে যায়। শহিদ আহমেদ শুভকে ধরে রেখেছেন আর শুভ টলছে।
” তোমার ছেলের যে এত অধঃপতন হয়েছে, তা কি তুমি জান? এই ভোরে সে নেশা করে বাসায় এসেছে। কবে থেকে চলছে এইসব? ”
শহিদ আহমেদের প্রশ্নের জবাব দিবে আকলিমা। সে কোন উত্তর খুঁজে পায়না।
” উত্তর দিচ্ছনা কেন? নিজের সন্তানকে মানুষ করতে পেরেছ? খুব তো চেয়েছিলে, তোমার ছেলে যেন আরমানকে ছাড়িয়ে যায়। আজ তোমার কি মনে হচ্ছে? তোমার ছেলে আরমানকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে? ছেলেটাকে তো কম জ্বালাওনি। কি পেলে এতসব করে? ”
” জাষ্ট স্যাট আপ, বাবা। তুমি মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছ কেন? নিজেকে কি মনে কর? দুইটা পয়সার মালিক হয়েছ বলেই এভাবে কথা বলবে? তোমার এত সম্পদ খাবে কে? আমরাই মালিক এসবের। এখন যে এত ফুটানি দেখাচ্ছ, শেষ বয়সে তোমাকে দেখবে কে? আমি যদি লাথি দিয়ে বের করে দিই, তখন কোথায় যাবে? আমাকে শাসন করতে আসছে! বড় ছেলের সাথে আমার তুলনা দেয়! এখনতো আবার একটা বাহানা পেয়েছে, তার বড় বউ ম’রে গেছে। বউয়ের শোকে দেবদাস হয়েছে। এই বাহানায় এখন বড় ছেলেও ভালো হয়েছে। আর আমরা হয়েছি নিকৃষ্ট। আমার মা এখন খারাপ হয়েছে। স্বার্থপর মানুষ বুঝি একেই বলে। ”
শুভর কথা শুনে শহিদ আহমেদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এসব কি বলছে তার ছেলে! এতবড় অপমান তাকে করল শুভ! ছেলে হয়ে বাবাকে লাথি মা’র’তে চাইল! ধপ করে মেঝেতে বসে পরলেন শহিদ আহমেদ। তার সমস্ত শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। এসব তারই কর্মফল।
” শুভ, তুই আমার ছেলেকে এসব কি বলছিস? নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছিস? তোর এত অধঃপতন হয়েছে? ভালোবাসা বেশি পেয়েছিস জন্যই এতটা বেড়েছিস। নিজের বাবাকে সম্মান দিতে পারছিসনা। ছিহ্, এতটা বেয়াদব হয়েছিস? ”
” ওহ দাদিমা, তুমিও শুরু করেছ? আজ হঠাৎ ছেলের পক্ষ নিচ্ছ? নাকি তুমিও ছেলের বউয়ের শোকে উল্টাপাল্টা বকছ? বুড়ো বয়সে তোমাকেও দেখছি ভীমরতিতে পেয়েছে! শোন একটা পরামর্শ দিই, আজ বাদে কাল ম’র’বে, তাই এই কয়দিন বেশি বেশি করে আল্লাহর নাম নাও। সুযোগ পেলেই সবাই নিজের জ্ঞান জাহির করতে পিছপা হয়না। আমাকে কি তোমরা আরমান পেয়েছ? যখন খুশি তখনই কথা শোনাবে? শুনে রাখ, আমি আরমান নই আমি শুভ। আমাকে জ্ঞান দিতে আসলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ডাষ্টবিনে ফেলে আসব। যত্তসব, ফালতু মানুষজন, আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা । ” শুভ কথাগুলো বলেই টালমাটাল পায়ে উপরে যায়।
রাজিয়া খানমের নাতির এরূপ অপমান হজম করতে কষ্ট হয়। আজ কেন যেন আরমানকে ভিষণ মনে পরছে। আরমান সবার হাজারও কটুকথা শুনে নীরবে হজম করত। কতইনা কষ্ট ছেলেটাকে তারা দিয়েছে। তবুও সে কখনও এভাবে বলেনি। ছেলের পাশে বসে তার কাঁধের উপর হাত রেখে কাঁদতে থাকে রাজিয়া খানম।
ছেলের এহেন মুখের ভাষা শুনে আকলিমা খানমেরও চোখে পানি আসে। এটাও হওয়ার ছিল!
চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ শুনে শ্রীজা রুম থেকে বেরিয়ে নিচে আসতেই, শুভর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। তবে ওর একটুও খারাপ লাগছেনা। আজ যেন একটু শান্তি শান্তি লাগছে। একেই বুঝি বলে, প্রকৃতির প্রতিশোধ। আসলেই প্রকৃতি কখনোই কারও ঋণ রাখেনা। একদিন না একদিন, সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয়। হাঁই তুলে আবারও রুমের দিকে পা বাড়ায় শ্রীজা।
সেদিন সকালে অফিসে গিয়ে প্রথমেই শহিদ আহমেদ তার ল ইয়্যারকে ডাকেন। তার সাথে কিছু জরুরী কাজ আছে।
রাজিয়া খানম সেদিনের পর থেকে অসুস্থ হয়ে পরেছে। কিছুই খেতে পারছেনা সে। সব সময়ই অনুশোচনা এসে হানা দিচ্ছে তার মনে। বিবেক বলছে, তুই বড্ড ভুল করেছিস, পাপ করেছিস। তোর কর্মফল তোকেই ভোগ করতে হবে।
ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে আলমিরার কাছে এসে দাঁড়ায় রাজিয়া খানম। আলমিরার পাল্লা খুলে বের করে আনে একটা বাক্স। এটা তাকে তার শ্বাশুড়ি দিয়েছিলেন বিয়ের দিন। বলেছিলেন, এখানে আছে এই পরিবারের ঐতিহ্য। এরপর বাক্সের ডালা খুলে বের করেন একটা সাতনরি হার। পরিয়ে দেন পুত্রবধূর গলায়। এটাই নাকি তাদের ঐতিহ্য। বংশের বড় ছেলের বউ পায় এই হার। এটাই হয়ে আসছে বংশপরম্পরায়। তবে স্বামীর বংশের ঐতিহ্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাজিয়া খানম এটা আইরিনকে দিতে অস্বীকার করে। আইরিন হারিয়ে যাবার পর, তার ভাইয়ের মেয়েকে পুত্রবধূ করে এনে এটা সে আকলিমাকে দিয়েছিল। এতদিন এই হারটা আকলিমার কাছেই ছিল। আজ দুপুরে সে আকলিমার কাছ থেকে এটা চেয়ে নেয়। আকলিমাও বিনাবাক্যে ফুপুকে বাক্সটা দিয়ে দেয়।
ফজরের আজান দিতে আরও কিছুটা সময় বাকি। আরমান কান্তাকে তার বুকে জরিয়ে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। চারদিকে নিস্তব্ধতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে ধরনী। শুধু মাথার ওপর শাঁ শাঁ আওয়াজে ফ্যান চলছে। হঠাৎই নিস্তব্ধতাকে গ্রাস করে বেজে ওঠে আরমানের মোবাইল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় দুজনের কেউই শুনতে পায়না। তবে বিরতিহীনভাবে বাজতে থাকায় একসময় দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায়। কান্তার মাথা বালিশের ওপর রেখে, আরমান বিছানা হাতড়ে ফোন হাতে নেয়। এই অসময়ে কে ফোন দিয়েছে! মুখের সামনে নিতেই দেখল আননোন নম্বর। কয়েক সেকেন্ড ভেবে রিসিভ করে ফোন।
” আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? ” ঘুম জড়ানো গলায় বলে আরমান।
” আরমান, তুমি কি ঢাকায় আসতে পারবে, কান্তাকে নিয়ে? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ”
গলার স্বর চিনতে আরমানের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। এবার আরমানের অবাক হওয়ার পালা।
” এতরাতে এই কথা জানাতে ফোন দিয়েছেন! আমি আপাতত ঢাকায় যাচ্ছিনা। দুঃখিত আপনার কথা না রাখতে পারার জন্য। ”
” এখন ভোর। একটু পরেই ফজরের আজান দিবে। আমিও দুঃখিত তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য। তবে যদি পার একটিবার এসে আমার সাথে দেখা করে যেও। আর কোনদিনও তোমাকে বিরক্ত করবনা। এটা এক বৃদ্ধার শেষ আকুতি ধরে নাও। রাখছি। তোমরা ভালো থেক। ”
ফোন কেটে গেছে। আরমান অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে আছে। ওর এত বছরের জীবনে আজ এমন আজব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে।
” কে ফোন করেছিল? আপনি এভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? ” কান্তা উঠে বসে আনমানকে জিজ্ঞেস করে।
” রাজিয়া খানম ফোন করেছিল। সে আমাকে ঢাকা যেতে বলে তোমাকে সহ। ”
” আর আপনি যেতে চাইলেননা, তাইতো? ”
” হুম। ”
” ভুল করবেন না গেলে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলুন ঢাকা যাই। উনি হঠাৎ কেন আমাদের ডাকলেন তা জানা দরকার। ”
” আমার যাওয়ার মোটেও ইচ্ছে নেই। আর ঐ বাড়িতে তো অবশ্যই নয়। এখন শুয়ে পর। ”
” প্লিজ, বয়স্ক মানুষ হঠাৎ করেই ফোন করেছে, নিশ্চয়ই এর কোন কারন আছে। আমরা নাহয় ঐ বাড়িতে না-ই গেলাম। শ্রীজাপুর সাথে দাদিমাই আসলো আমাদের সাথে দেখা করতে।”
” সেটা পরে ভাবলেও চলবে। এবার তুমি ঘুমাও। ”
কান্তা আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরে। তবে ওর চোখে আর ঘুম আসলনা। আরমানেরও তাই।
একটু পর ফজরের আজান দিতেই দুজনেই উঠে পরে।
সকালে শ্রীজার ফোন পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় আরমান। শ্রীজা ওকে জানাল, দাদিমা হঠাৎ করেই ফজরের নামাজের পর অসুস্থ হয়ে পরেছে। তাকে হসপিটালাইজড করা হয়েছে। ডক্টর জানিয়েছেন তার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে।
সংবাদ পাওয়া মাত্রই আরমান দেরি না করে কান্তাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
চলবে….