#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৬)
বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছিল অভিরাজ। অসময়ে ঘুম দেওয়া এখন তার নিত্যদিনের অভ্যাস। এদিকে রাতের খাবারের সময় শেষ হয়ে এসেছে। ইরা ডাকতে এসে দেখল দোলনায় বসে অভিরাজ। চোখের দৃষ্টি সামনের গাছ গুলোতে।
“ভাইয়া।”
“ইরা?”
“হুম।”
“বোস।”
“রাতের খাবার খাবে না?”
“কয়টা বাজে?”
“সাড়ে দশটা।”
“সাড়ে দশটা বেজে গেল!”
“হুম। সারাক্ষণ তো নিজেকে আড়াল করে রাখো। সময়ের দিকে কি আর খেয়াল থাকে?”
“তোরা বেশি ভাবিস।”
“এর জন্যেই তো বিগত পাঁচটা বছর ধরে এভাবে নিজেকে
পু ড়া চ্ছ।”
ইরার কণ্ঠে হতাশা। অভিরাজ উঠে এসে ফ্রেস হতে গেল। ভাইয়ের ঘরের অবস্থা দেখে তার কষ্ট হলো। অভিরাজ যতক্ষণ না বের হলো ততক্ষণে কাবাড গুছিয়ে ফেলল ইরা।
“তুই এগুলো গোছাতে গেলি কেন?”
“কাউকে তো আসতে দাও না তোমার ঘরে। তাই কাবাডটা গুছিয়ে দিলাম।”
“সবাই খেয়েছে?”
“না।”
“রোজ রোজ কেন বসে থাকে?”
“কারণ তোমায় সবাই ভালোবাসে ভাইয়া।”
“ভালোবাসা এভাবে না দেখালেও হয়।”
“তুমিও তো…” কথা পরিবর্তন করল ইরা। বুকের ভেতর চোরা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,
“আসো।”
অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেতে হলো ওকে। এ বাড়ির মানুষ গুলো ওকে বুঝে না একটুও।
“বাবা এসেছিস?”
মায়ের আবেগ ভরা ডাকটা অভিরাজের কর্ণপাত হলেও ভালো মন্দ কিছু ব্যক্ত করল না সে। চুপচাপ খেতে বসল। লাবণ্য সমস্ত তরকারি গরম করে বলল,”বড়ো আম্মু তুমি খেয়ে নাও।”
“পরে খাব।”
“শরীর খারাপ করবে। ঔষধ গুলো খেতে হবে তো।”
লাবণ্য জোর করে বসিয়ে দিল আমিনাকে। মায়ের মন সন্তানের জন্য বরাবরই কাঁদে। খাবারের প্লেট হাতেই নয়ন সিক্ত করে ফেললেন তিনি। লাবণ্য বাহুতে হাত রেখে সান্ত্বনা দিল।
“সব ঠিক হয়ে যাবে বড়ো আম্মু।”
“তুই আমার শেষ ভরসা মা।”
অতীত
দুপুর বেলায় অশান্ত লাগছিল ভীষণভাবে। সেই জন্যেই আগে চলে এসেছে অভিরাজ। হাতে হরেক রকমের মিষ্টি। লাবণ্য ফোন করে জানিয়েছে উষশী মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করে। আট রকমের মিষ্টি এনেছে সে। কেন এনেছে জানে না। লাবণ্য সব গুলো প্যাকেট রাখতে রাখতে বলল,”এত মিষ্টি এনেছিস কেন? দু এক রকমের আনলেই তো হতো।”
“এমনিই এনেছি। যতটুকু রাখার রেখে দে। বাকি গুলো পথশিশুদের দিয়ে আসব।”
কথাটা শুনতে পেয়ে উষশী বলল,”আমিও যাব।”
“ঠিক আছে।”
বিকেল বেলা লাবণ্য আর উষশীকে নিয়ে বের হলো অভিরাজ। লাবণ্য ফ্রন্ট সিট থেকে একটু পর পর পেছনে তাকাচ্ছে। উষশী বেশ আনন্দের সাথে চারপাশ দেখছে। তার কোলে বসে লাফালাফি করছে কোকো।
“ওকে আমার কাছে দাও তো।”
লাবণ্য’র কাছে এসে আরো বেশি লাফালাফি শুরু করল কোকো। একটু শাসন করে বলল লাবণ্য।
“এই দুষ্টু,এমন করলে কিন্তু রেখে চলে যাব। উষশী কোকো’র বয়স কত?”
“আট মাসের মতো। ওকে আমি এডপ্ট করেছি ছয় মাস হলো।”
“শুরু থেকেই এমন মিশে যেত সবার সাথে?”
“না। প্রথম দুইটা মাস কি যে যন্ত্রণা দিয়েছে। ও খুবই দুষ্টু। একদিন তো পাশের বাসার সুগারকে মে রে এসেছে।”
“সুগার কে?”
“আমাদের নেইবর রোজানিয়ার বিড়াল।”
“বাহ,কোকো তো দেখছি খুব শক্তিশালী।”
“হুম। তার খাওয়া দাওয়ার রকমারি দেখলে অবাক হবে।”
“এমন কিছু তো দেখলাম না।”
“কি জানি,এখানে আসার পর ভদ্র হয়ে গেছে।”
“বোধহয় বাংলাদেশ খুব পছন্দ করেছে।”
“হতে পারে।”
মুচকি হাসল উষশী। এত সময় ধরে অভিরাজ কোনো কথা বলে নি। উষশী আরচোখে তাকাল ব্যক্তিটার দিকে। বেশ ফর্সা,লম্বা বলিষ্ঠ পুরুষটি অনেকটা আমেরিকান হিরো চেস ক্রফোর্ডের মতো দেখতে। ওর চোরাদৃষ্টি চোখ এড়াল না অভিরাজে। লাবণ্য ফোনে কথা বলছে। সেদিকটায় মনোযোগ দিল অভি। লাবণ্য’র মুখটা মলিন হয়ে এসেছে। হতাশা তার দৃষ্টিতে।
“কি হয়েছে?”
“ইমার্জেন্সি হসপিটালে যেতে হবে।”
“গাড়ি ঘুরাচ্ছি।”
“না, না তোরা যা। আমি উবারে চলে যাব।”
“ঠিক আছে। সাবধানে যা।”
“তোরাও সাবধানে যাস। উষশী,ফিরে এসে দেখা হচ্ছে। নিজের খেয়াল রেখো বাবু।”
“হুম।”
লাবণ্য হাত নাড়িয়ে চলে গেল। উষশী এখনো পেছনটায় বসে আছে। কোকো লাবণ্যর সিট দখল করে রেখেছে।
“সামনে এসে বসো।”
“আমার এখানেই ভালো লাগছে।”
“কিন্তু আমার লাগছে না।”
“কেন?”
“আমি কারো ড্রাইভার হতে চাই না।”
“ওসব ফালতু কথা।”
“তর্ক না করে সামনে আসো।”
“আপনি পেছনে আসেন।”
“তাহলে গাড়ি চালাবে কে, তুমি?”
“হুম আমি।”
পেছন ঘুরল অভিরাজ। উষশী বেশ সিরিয়াস হয়ে আছে।
“তুমি ড্রাইভ করতে জানো?”
“হু,অনেক আগে থেকেই।”
“সিওর?”
“করে দেখাই?”
“ওকে। বাট সাবধানে।”
উষশী নেমে এসেছে। তার মুখটা হাসি হাসি।
“আপনি নামেন।”
“সাবধানে উষশী।”
“এত চিন্তা করছেন কেন? আমি খুব ভালো ড্রাইভ জানি।”
বিশ্বাস করেই ড্রাইভিং এ বসতে দিল অভি। সত্যিই খুব ভালো ড্রাইভ করতে পারে উষশী। ওর চালানো দেখে নিশ্চিত হয়ে বসল অভিরাজ।
“তুমি খুব এডভান্স।”
“আমাদের কান্ট্রিতে সবাই খুব এডভান্স।”
“হুম। কিন্তু তোমাতে বাঙালি নারীর কিছু গুণ রয়েছে।”
“কেমন?”
“এই যে হুট করে অভিমান করো। পনেরো বছরের হলেও কখনো কখনো ছয় বছরের বাচ্চা হয়ে যাও। আর অনেকটা আদুরে।”
ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল উষশী। কে বলবে কয়েক দিন পূর্বেই ব্যক্তিটার সাথে ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল ওর। দুজন যেন হুট করেই বন্ধুর মতো হয়ে গেল। বিষয়টা কল্পনা করে মৃদু হাসল উষশী।
“আমার মম খুব ভালো রান্না জানে। অথচ আমি কিছু পারি না।”
“শিখে নিবে।”
“হুম।”
কোকো ঘুমিয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত ছুটোছুটির পর বিড়ালটি ঘুমাতে পছন্দ করে। অভিরাজ পুনরায় ড্রাইভিং এ বসেছে। উষশী’র খোলা বাদামি চুল গুলো হাল্কা সমীরণে দোল খাচ্ছে। বাইরের দিকটায় নজর পড়তেই চেচিয়ে উঠল উষশী।
“স্টপ দ্যা কার।”
“কি হলো?”
“আমি এই জায়গাটা চিনি।”
“চিনো মানে?”
“আমার বাসার কাছে এটা।”
তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামাল অভিরাজ। উষশী ফট করেই নেমে গেল। পেছন পেছন এল অভি। কোকোর ঘুম ছুটে গিয়েছে। মিউ মিউ শব্দ করে ডাকছে।
“এখানটায় এসেছি আমি। মম নিয়ে এসেছিল ফেয়ারে। ঘুরেছিলাম আমরা।”
“কোন দিক থেকে এসেছিলে তোমরা?”
“সামনের দিক থেকে।”
“চলো,খুঁজে বের করি।”
উত্তেজিত হয়ে পড়ল উষশী। সে আগে আগে ছুটতে শুরু করেছে। অভিরাজ ইষৎ শব্দে বলল,”থামো,গাড়িতে করে যাই। এভাবে অনেক সময় লাগবে।”
পুনরায় গাড়িতে উঠে এল ওরা। উষশী চারপাশে নজর বুলাচ্ছে। হাল্কা হাল্কা চিনতে পারছে সে। বুকটা ধুকপুক করছে। ওর হৃদস্পন্দন যেন শুনতে পেয়েছে অভি।
“পানি খাও।”
পানি খেল উষশী। তারপরই বাইরের দিকে নজর রাখল। তার দৃষ্টি বিচলিত। আরেকটু যেতেই সব কেমন অচেনা হয়ে এল। উষশী মনে করতে পারছে না। এত অসহ্য লাগল ওর।
“আর গিয়ে লাভ হবে না।”
“কেন?”
“আমি আর চিনতে পারছি না।”
“তুমি সিওর ওখানে এসেছিল তোমরা?”
“হুম।”
“মন খারাপ কোরো না,আমি খুব দ্রুত তোমার বাসা খুঁজে বের করব।”
“ভালো লাগছে না।”
“উষশী।”
“হুম।”
“তোমার কি খুব মন খারাপ হয়েছে?”
সিক্ত দৃষ্টিতে তাকাল মেয়েটি। অভি পকেট হাতরিয়ে রুমাল বের করল।
“চোখ মুছো।”
“মমকে খুব মনে পড়ছে।”
“চিন্তা কোরো না।”
“আমার খুব কান্না পাচ্ছে।”
এতটা অসহায় লাগল অভিরাজের। সে হতাশ হয়ে ড্রাইভ করতে লাগল। জানালা দিয়ে অনিমেষ চেয়ে আছে উষশী। ওর তাকিয়ে থাকা বিষণ্ণ দৃষ্টিতে অভিরাজের মন খারাপ হলো। মনে মনে ভাবল খুব দ্রুতই মেয়েটির বাড়ি খুঁজে বের করবে।
পুরো সন্ধ্যা ঘুমিয়ে পার করেছে উষশী। ঘুম থেকে উঠে দেখল আকাশে মেঘ জমেছে। একটু পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বসার ঘরে বসে কাজ করছে অভিরাজ। ওকে দেখে ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করল।
“ঘুম কেমন হয়েছে?”
“ভালো।”
“চা কফি কিছু খাবে?”
“উহু।”
“বসো তাহলে।”
“বৃষ্টি হবে?”
“হুম। তেমনটাই তো মনে হচ্ছে।”
আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। খানিক বাদেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বড়ো জানালার পাশে এসে দাঁড়াল উষশী। হা হয়ে বৃষ্টি দেখছে সে। সে দিকে তাকিয়ে অভিরাজের মনে হলো মেয়েটির মন খারাপের সাথে সই পাতিয়ে কাঁদছে আসমানও।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
**উষশী হচ্ছে বিদেশিনী। তার কালচার অন্যরকম। সে বাঙালি মেয়েদের মতো নয়। এইটুকু মাথায় রেখে গল্পটা পড়ার অনুরোধ।**