#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭
“এইযে মিস! শুনুন। একটু দাঁড়াবেন প্লিজ!”
পুরুষালি শক্ত কণ্ঠ এসে পৌঁছায় তানিয়ার কর্ণকুহরে। চলা থামিয়ে শুকনো ঢক গিলে পিছু ফিরে তাকাতেই যেন কলিজা ছলকাতে থাকে তার। এক যুবক তার দিকে এগিয়েই আসছে ধেয়ে। মনে হচ্ছে আজই ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে আর নিজের ক্ষোভ উগড়ে দেবে। তানিয়া ফ্যাকাসে মুখে সামনে ফিরে বুকে থুথু দিয়ে আগপাছ না ভেবে বড়ো বড়ো পায়ের ধাপ ফেলে একপ্রকার ছুটতে শুরু করে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“হায় আল্লাহ! আমাকে বাঁচাও। আর জীবনে কোনোদিন মায়ের কথার অবাধ্য হবো না। মায়ের কথায় বিয়েশাদিও করে ফেলতে রাজি আছি। তাও এদের খপ্পরে পড়তে চাই না।”
তানিয়াকে জোরে ছুটতে দেখে হতবাক সৌমিত্র। উপায়ন্তর না পেয়ে সেও একটু জোরে হাঁটা ধরে চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
“ও হ্যালো, মিস গোলাপী! আপনাকেই বলছি। একটু রেলগাড়ীতে ব্রেক মা/রুন।”
তানিয়া এবার আরো জোরে পা চালায়। অক্ষিকোটর থেকে মণি বেরিয়ে আসার উপক্রম তার৷ মিস গোলাপী বলে যে তাকেই সম্বোধন করা হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই তানিয়ার। পিছু ফিরে সেই লোকটি তার চেয়ে কত দূরত্বে রয়েছে দেখতে গিয়েই বাঁধাল বিপত্তি। ফট করেই কাঁদায় পা দিয়ে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে পড়ে গেল রাস্তায়। লজ্জা, ভয়ে কী করবে সেই মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারল না সে। অবশেষে সৌমিত্র এসে দাঁড়াতে পারল তানিয়ার সামনে। হাফ ছেড়ে রাস্তায় অসহায় হয়ে পড়ে থাকা তানিয়ার দিকে সামান্য ঝুঁকে বলল,
“বাঘ না ভাল্লুক দেখে দৌড়াচ্ছিলেন হ্যাঁ? নিজের তো লস করলেনই তার সঙ্গে আমারও এনার্জির লস করালেন।”
তানিয়া অতিরিক্ত আতঙ্কের চোটে উদ্ভ্রান্ত হয়ে বলে ফেলল,
“দয়া করে আমাকে মাফ করে দেন। আমি ইচ্ছে করে সেদিন ওই ভাইয়াকে থা;প্পড় খাওয়ায় নি। ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়৷ আমি জানি আমার মুখে মায়া মায়া ভাব নেই। তবুও একটু মায়া করুন আমার ওপর। শা/স্তি দেবেন না।”
সৌমিত্র ঠোঁট উল্টিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল তানিয়ার আজগুবি কথায়। তানিয়া একভাবে কাঁদার মধ্যেই মাথা নিচু করে বসে থাকে। খানিকটা সময় পর শব্দ করে হেসে ফেলে সৌমিত্র। তার হাসিতে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তানিয়া। সে কি খুবই মজার কথা বলে ফেলেছে?
“আপনি এখনো সেদিনের কথা নিয়ে পড়ে আছেন? আর সেদিনের কারণে আপনাকে পানিশমেন্ট দেব ভেবে এভাবে ছুটছিলেন মিস গোলাপী?”
সৌমিত্রের কথায় তানিয়া অবাক হয়ে শুধায়,
“তাহলে আমি এমনি এমনি ভয় পাচ্ছিলাম?”
“ইয়েস ম্যাডাম! আমার শুধু একটা প্রশ্ন ছিল। সেটার উত্তর জানা খুবই জরুরি আমার। যদি বলতেন ধন্য হতাম।”
“এভাবে উত্তর দেব?”
সৌমিত্র একবার নজর দেয় তানিয়ার পুরো অবস্থার দিকে। মেয়েটা কাঁদায় মাখামাখি। মুখেও পড়েছে ছিটেফোঁটা। সৌমিত্র ইতস্তত বোধ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“ওহ সরি। উঠে আসুন। আমি হেল্প করছি।”
সৌমিত্রের হাত ধরে উঠে আসার ইচ্ছে বোধ করল না তানিয়া।
“নো থ্যাংকস। আমি একা উঠতে পারব।”
সৌমিত্র হাত সরিয়ে নিলো তানিয়ার কাছ থেকে।
“ওহ হো! বয়ফ্রেন্ড অন্য ছেলের হাত ধরতে মানা করেছে বুঝি? নো প্রবলেম। আমিও হলে তাই করতাম। আমি আবার কারোর প্রেমে আগুন টাগুন ধরাতে চাইনা, মিস গোলাপী!”
“মিস তানিয়া।”
“হ্যাঁ?”
তানিয়া ইতস্ততবোধ করে বলল,
“আমার নাম তানিয়া।”
“ওহ ওকে। বাট সত্যি কথা বলি? তানিয়ার চেয়ে গোলাপী নামটা বেশি মানাচ্ছে আপনাকে।”
তানিয়া নাক ফুলিয়ে তাকায় সৌমিত্রের পানে। কিছু বলতে চেয়েও বলে না। সে মনে করে এসব মন্ত্রীর লোকজনের সাথে কথা না বাড়ানোই ভালো হবে তার পক্ষে। তাই সে সোজা প্রশ্ন করে,
“আপনি কী জানতে চেয়েছিলেন আমার কাছে?”
“ওহ হ্যাঁ। একটা কথার জানার ছিল। তার আগে মনে হয় আপনার মুখের কাঁদা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।”
সৌমিত্রের কথায় তানিয়ার হাতে চলে যায় মুখে। সৌমিত্র প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে একটা কালো রুমাল বের করে দিয়ে বলে,
“বেশি সময় কাঁদা মুখে লেগে থাকলে র্যাশ হতে পারে। এই র্যাশের চক্করে আপনার বয়ফ্রেন্ড পালিয়ে গেলে আমি দায়ী হয়ে যাব। কারণ আপনি আমার ভয়ে পড়ে গেছেন।”
আঁখি দুটো সরু হয়ে এলো তানিয়ার। ছেলেটা অতিরিক্ত কথা বলে। তবে নীরবে সৌমিত্রের হাতের রুমাল নিয়ে মিনমিন করে বলে,
“থ্যাংকস।”
তানিয়া আস্তে আস্তে নিজের মুখের কাঁদা পরিষ্কার করে নেয়। তৎক্ষনাৎ আচানক দ্রুত তাদের সামনাসামনি হয় স্বচ্ছ। সৌমিত্র হকচকিয়ে উঠে ভাইয়ের দিকে তাকায়। স্বচ্ছের মেজাজ তখন তুঙ্গে। কঠিন স্বরে ছোটো ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“সামান্য একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে তোর এতক্ষণ লাগে? আমার সব সিক্রেট বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ হয় না তোর দ্বারা?”
সৌমিত্র আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
“আরে ভাই, মাত্র জানতে চাইছিলাম। কিছু জানার আগে একটা পরিচিত হওয়ার ব্যাপার থাকে না বলো? হুট করে প্রশ্ন করলে তো হয় না।”
ছোটো ভাইয়ের কথায় কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ করে না স্বচ্ছ। তানিয়ার দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সরাসরি প্রশ্ন,
“এইযে, হ্যালো! আপনি মোহের বান্ধবী না?”
স্বচ্ছের রুক্ষ কণ্ঠে আপনাআপনি শিউরে ওঠে তানিয়ার গায়ের লোম। তড়তড় করে বলে দেয়,
“জি। ও আমার ভার্সিটি লাইফের বান্ধবী।”
“ও তো নিজের বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে জানো কিছু?”
তানিয়া ঢক গিলে একনাগাড়ে বলল,
“হ্যাঁ সেদিন ও বাসে ছিল৷ তখন দেখা হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে।”
স্বচ্ছ কিছুটা সময় নীরব রইল। আবার প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ওর ফোন বন্ধ কেন সেটা জানো?”
“তা তো জানি না।”
“ওর গ্রামের বাড়ি কোথায়?”
তানিয়া কাঁপা স্বরে বলল,
“গা…গাজীপুরের একটা গ্রামে।”
“তুমি চেনো?”
“ওতোটা মনে নেই। তবে একবার ঘুরতে গিয়েছিলাম ওর সাথে।”
“ওর গ্রামের এড্রেস আমার চাই।”
তানিয়ার অবস্থা তখন বেগতিক। একের পর এক স্বচ্ছের প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছিল যেন আদালতের কাঠগড়ায় রয়েছে। কোনো ভাবনাচিন্তা ছাড়াই স্বচ্ছের কবল থেকে ছাড়া পেতে কোনোরকমে মোহের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে ফেলল সে।
“সৌমিত্র! আমি গাজিপুরের দিকে যাচ্ছি। বাড়িতে মাকে বলে ম্যানেজ করে নিস।”
সৌমিত্রের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে পেছন ফিরে গাড়ির দিকে হাঁটা ধরল স্বচ্ছ। সৌমিত্র প্রথমে স্তম্ভিত হলো ভাইয়ের কথায়। তানিয়া ভীতি নিয়ে দু’ভাইকে দেখছে। আসলে তারা মোহের থেকে কী চাইছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। দুরুদুরু বুকে নিজ বাড়ির রাস্তায় তানিয়া যেই না হাঁটা দেবে তৎক্ষনাৎ পিছু ডাকল সৌমিত্র।
“ও হ্যালো মিস গোলাপী! আই মিন তানিয়া। আমার রুমাল নিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছেন?”
তানিয়া সাথে সাথে সৌমিত্রের হাতে তার রুমাল দিতে গেলে সরে গেল সৌমিত্র। কপাল কুঁচকে তাকাল তানিয়া। সৌমিত্র বলল,
“এভাবে কেউ রুমাল ফেরত দেয়? ধুয়ে ভালোমতো আইরন করে আমার হাতে তুলে দেওয়া দায়িত্ব আপনার। বাসায় গিয়ে আগে রুমালটা ধুয়ে দেবেন। এটা কিন্তু আমার ফেবারিট রুমাল। মা গিফট করেছিল। তাই এটা আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিচ্ছি না আপনাকে।”
“কিন্তু এটা আমি আপনাকে পরে কী করে দেব?”
“ওহ হ্যাঁ! আমার নম্বর সেভ করে রাখুন।”
তানিয়া সরল মনে দ্রুত সৌমিত্রের নম্বর সেভ করে নিতেই ভাইয়ের দিকে ছুট লাগায় সৌমিত্র। স্বচ্ছের পাশাপাশি এসে হাঁটতে হাঁটতে অস্থির চিত্তে বলে,
“কিন্তু ভাই, তুমি এসময় এতদূর গেলে ফিরবে কখন?”
“আজকে নাহলে কাল ফিরব।”
স্বচ্ছের দায়সারা উত্তরে শান্তি হলো না সৌমিত্রের।
“ভাই, মা আমাকে কথা শুনিয়ে শেষ করে দেবে। আর বাবা জানতে পারলে তো আমাকে আধম/রা করে ঝুলিয়ে রাখবে।”
“বড়ো ভাইয়ের জন্য সামান্য আধম/রা হতে পারবি না সৌমিত্র?”
সৌমিত্র একেবারে থ হয়ে গেল ভাইয়ের কথায়। মাঝে মাঝে তার ভীষণ সন্দেহ হয় এই স্বচ্ছ নামক যুবকটি আসলেই তার ভাই কিনা! স্বচ্ছের কথায় ফের নিজের বিস্ময় কাটালো সৌমিত্র।
“কিন্তু প্রথমে বাড়িতেই যাব এখন আমি। তারপর সেখান থেকে বের হবো গাজীপুরের উদ্দেশ্যে।”
গ্রামের দিকে নিত্যদিনের বৃষ্টি হওয়া এখন যেন বাধ্যতামূলক। চারিদিকে কাঁদা। পা দেওয়ার জায়গা নেই। সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ অথবা তাঁরা কোনোটারই দেখা নেই। খবরে দেখাচ্ছে প্রবল ঝড় হওয়ার সম্ভবনা। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা শনশন বাতাস যেন ঝড়েরই জানান দিচ্ছে। কোনোরকমে খালি পায়ে সাবধানে পা ফেলে ইথানকে কোলে নিয়ে বাড়ির দিকে এগুচ্ছে মোহ। পা একেবারে কাঁদায় মাখামাখি। হাঁটতে হাঁটতে ইথানকে বকে বলল,
“বারবার বলেছিলাম আমার সাথে এসো না। বাড়িতে থাকো। তবুও মোড় অবধি আসতে হলো তোমাকে। এখন তো হাঁটতেও চাইছ না।”
ইথান নাকমুখ কুঁচকে বলে,
“ছি! নিচে এমন নোংরা আছে জানতাম নাকি?”
“আমি জানতাম বলেই তো তোমায় বারণ করেছিলাম। কিন্তু মায়ের কথা কি ইথান শোনে?”
ইথান বুঝদারের ন্যায় বলল,
“বাচ্চাদের ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হয় মোহ রানি। জেদ করা তাদের স্বভাব।”
মোহ ফিক করে হেসে দেয়। ইথান আজকাল বড্ড পাকা হয়েছে। স্কুলে ভর্তি করার সময় এসেছে। শহরে ফিরে সবার আগে ইথানকে ভালো একটা স্কুলেই ভর্তি করতে হবে তার। হাঁটার পথে হঠাৎ চোখেমুখে আলো পড়ল মোহের। চলা থামিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। সঙ্গে খানিকটা রাগ হলো তার! মুখের উপর কে টর্চের আলো দেয়?
“আরে মোহ নাকি?”
মোহের কাছে বয়স্ক পুরুষের কণ্ঠ পরিচিত মনে হয়। চোখ মেলে তাকায় সে পিটপিট করে। একজন বয়স্ক লোক টর্চ ধরে দাঁড়িয়ে। মোহ বাধ্য মেয়ের মতো বলে,
“জি জালাল চাচা।”
“কবে আইলি আবার? কোলে এইডা কার পোলা? তোর?”
মোহ বিরক্ত হয়। প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে না পেয়ে ছোট্ট করে উত্তর দেয়,
“হুমম।”
“পোলাডায় এত্ত বড়ো হইছে? এখনো বিয়াশাদী করস নাই? বড়ো হইয়া যখন পোলা জিগাবে আমার বাপ কে! তখন কী উত্তর দিবি?”
মোহের মেজাজ খারাপ হচ্ছে এবার। ভীষণ গায়ে লাগছে কথাগুলো। ছোট্ট ইথানের সামনে কথাগুলো বলা কি আদেও ঠিক হচ্ছে? মোহ কড়া কণ্ঠে জবাব দেয়,
“এসব তো আমার ব্যাপার চাচা। আপনি বরং নিজের পালিয়ে যাওয়া মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন। তাহলে ভালো হয়।”
জালাল চাচা মুখ বাঁকালেন। ঝাঁজালো সুরে বললেন,
“মুখ থাইকা কথা এহনো যায় নাই না তোর? আমার মাইয়া আর যাই হোক তোর মতো আকাম কইরা বাচ্চা জন্ম দেয় নাই। নিজের আকামের জন্য তো গ্রাম ছাইড়া বাহির কইরা দিছিল গ্রামের লোকজন। এহনো বুদ্ধি হয় নাই তোর?”
“যতদিন আমার মুখ আছে ততদিন আমি জবাব দিয়ে যাব। যতটা পারি ততটা কথা বলব। আমি যা করেছি বেশ করেছি। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। তবুও আপনাকে আমি সাবধান করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার ছেলের সামনে এসব ফালতু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করবেন না। বলে রাখলাম।”
ইথানকে অন্যহাতে জড়িয়ে দ্রুত পায়ে জালাল চাচার পাশ কাটায় মোহ। সরল ইথান চুপচাপ সব দেখে মাকে জিজ্ঞেস করে,
“দাদুটা কী বলল মা? কিছুই বুঝলাম না।”
মোহ কেঁপে উঠে ইথানকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। মলিন সুরে বলল,
“কিছু না সোনা। বড়োদের কথার মাঝে ছোটোদের ঢুকতে নেই।”
বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরটায় এসে ইথানকে বিছানায় বসিয়ে নিজের হাতের খাম থেকে কাগজটি বের করল মোহ। সূক্ষ্ণভাবে চোখ বুলিয়ে নিলো কাগজের প্রতিটি লেখায়। এইটা মোহের সামান্য হাতি/য়ার। এটা নিয়ে এখন মোহকে শহরের দিকে রওনা দিতে হবে। তার জানা নেই, সে কতটুকু সত্যি বের করতে পারবে। তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?
প্রবল বাতাসের গতির দাপটে সবটা যেন অন্ধকার দেখছে স্বচ্ছ। তবে ভালোই ভালোই গাজীপুরের সেই গ্রাম অবধি পৌঁছাতে পেরেছে সে। ঠিক ভালোই ভালোই বললে ভুলই হবে। মাঝে রাস্তা হারিয়েছে, কখনো এক রাস্তায় দুবার গিয়েছে। পায়ে ব্যথা উঠেছে তার। লাগা পায়ে বারংবার ব্রেক কষতে হয়েছে তাকে। মিনিট পাঁচেক নিজের পা’কে বিশ্রাম দিয়ে ফের যখন গাড়ি স্টার্ট দিলো তার উপলব্ধি হলো গাড়িটা কাঁদায় আঁটকে গেছে। লাগা পায়ে আর ইচ্ছে করল না জোর করে গাড়ি টেনে তোলার। গাড়িতে এক লা;থি মে/রে মাথা গরম করে বসে রইল সে। নিজের কর্মে আফসোস করে বলল,
“সৌমিত্রকে নিয়ে এলে ভালো হতো। আসতে চাইল, আমিই নিয়ে এলাম না। উফফ…এখন হাঁটতে হবে।”
ফোন বের করে সময় দেখে নেয় স্বচ্ছ। দশটা বাজছে ইতিমধ্যে। এই রাতে ও ছুটে এসেছে সামান্য একটা মেয়ের জন্য। এটা ভাবতেই নিজের প্রতিই বিস্ময় কাটছে না তার। এখন যদি মোহের বাড়ি খুঁজে না পায় কী হবে? অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই নরম মাটির কাঁদার নিচে ঢুকে গেল স্বচ্ছের পা। বিশাল অস্বস্তিতে পড়ে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। অতঃপর নিজের পা দুটো টেনে তোলার চেষ্টা করতে করতে মোহের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ঝেড়ে বলল,
“সব দোষ তোমার মিস মঞ্জুলিকা! না তুমি এখানে আসতে আর না আমি এখানে ছুটে আসতাম। আমার অবস্থার জন্য শুধু তুমি দায়ী।”
গ্রামের লোকজন ঘরে ফিরছে আর স্বচ্ছের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। সাধারণত এদিকে দামী গাড়ি নিয়ে কেউ প্রবেশ করেনা। তাই মানুষজনকে বেশ ভাবাচ্ছে বিষয়টা। স্বচ্ছ হঠাৎ করে অল্পবয়সী একটা ছেলেকে পেয়ে ডাক দেয়।
“এই ছেলে শোনো!”
ছেলেটি এগিয়ে আসে।
“জি, কন! কী কইবেন।”
“এই গ্রামের একটা বাড়ির ঠিকানা বলে দিতে পারবে?”
ছেলেটা দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“পারুম না ক্যান? এই গ্রামের এমন কোনো বাড়ি আছে? যেইডা শান্ত চিনবো না?”
“আচ্ছা আচ্ছা! আজহার সাহেবের বাড়ি চেনো তুমি?”
“ওহ! আজহার দাদু? মানে মোহ আপার বাড়ি?”
স্বচ্ছ দ্রুত জবাব দিলো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। চিনো তুমি?”
“চিনমু না ক্যান? সামনে যাইবেন। প্রথমে একটা বাগান পাইবেন। বাগানের পাশ দিয়া গিয়া আমাগো এলাকার সবচেয়ে বড়ো বটগাছ পাইবেন। ওইডাও পার হইয়া যাইতে দেখবেন ডান দিকে একটা পাকা বাড়ি আছে। ওইডাই মোহ আপার বাড়ি।”
স্বচ্ছের কাছে ভীষণ ঝামেলার মনে হলো বিষয়টা। যদি ভুল বাড়িতে চলে যায়? সে ছেলেটিকে শুধাল,
“তুমি আমায় তার বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে?”
“আরে না না। এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হইব। পাড়ায় খেলা দেখার লাইগা রাত হইয়া গেছে। এখন গেলে নির্ঘাত আম্মায় কাঁচা কুঞ্চি দিয়া বাড়াইব। আপনে আমার কথা মতো যান। বিশ্বাস করেন, বাড়ি পাইবেন।”
স্বচ্ছ আর কিছু না বলে অতি কষ্টে পায়ের ধাপ ফেলে হাঁটা দিলো। ফট করে ছেলেটি আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
“আইচ্ছা, আপনে কে হন মোহ আপার?”
স্বচ্ছ চট করে উত্তর দিলো,
“পাগল, হই পাগল! তোমার মোহ আপার রোগী।”
তড়তড় করে ব্যথা পায়ে নিয়ে চলে গেল স্বচ্ছ। শান্ত থ মে/রে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
মিনিট পনেরো হাঁটার পরে মাত্র বাগানের দেখা পেল স্বচ্ছ। এই পা নিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। অসহ্য লাগছে তার। নিচে কাঁদায় মাখোমাখো অবস্থা। এমন বিরক্তির সময় ফোন বেজে উঠলে সেটা বের করতে গিয়ে অসাবধানতায় ফোনটাও ফেলে দিলো কাঁদায়। সময় নষ্ট না করে দ্রুত ফোন হাতে তুলে দেখল যা হওয়ার হয়ে গেছে। ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে বাগানের বেড়ায় আ;ঘাত করতেই মনে যেন হলো হাতে পেরেক ঢুকে গেল। মৃদু চিৎকার দিয়ে হাত টান দিয়ে অন্যহাত দিয়ে অনুভব করল ডান হাত থেকে র/ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সেসবে ধ্যান না দিয়ে ফের চলতে লাগল। কেননা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
এক পর্যায়ে ঝড় শুরু হলো। স্বচ্ছ নিজের বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে যখন আর চলতে পারল না তখন সামনে দুটো পাকা বাড়ি দেখল। তবে ছেলেটি যে বলেছিল যেই পাকা বাড়ি দেখবে সেটাই? এখন কোনটা হতে পারে মোহের বাড়ি?
বাহিরে ঝড়ের বাতাস ও বৃষ্টি দেখছে মোহ। ইথান তার কোলে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন। এমন সময় অন্য ঘর থেকে রাবেয়া বেগম চিল্লিয়ে বলে উঠলেন,
“ও মোহ! ও মাইয়া! বাহিরের দরজাটায় বোধহয় লাঠি তুলে দেওয়া হয় নাই। একটু দিয়া আয় তো। আমি ঠিক মতো দেখতে পাইনা আন্ধারে।”
দাদীজানের কথামতো ইথানকে সাবধানে বালিশে শুইয়ে দিলো মোহ। হাতে টর্চ লাইট নিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে বাহিরের উঠোনে উঠতেই উপলব্ধি করল ঝড়ের বেগ অনেকটা। গা ভিজে যাচ্ছে। গামছা দিয়ে ঢাকল নিজের মাথা। পাশের আম গাছের এমন অস্থিরতা দেখে বুঝতে বাকি নেই যেকোনো সময় ডাল ভাঙবে তার। আস্তে আস্তে টিনের দরজার কাছে এগিয়ে দ্রুত লাঠি তুলে দিতেই ফাঁক দিয়ে একটি বলিষ্ঠ অবয়ব দেখে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল তার। এই রাতে কে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে? একমাত্র চোর ছাড়া? দরজা ফাঁক করে সামান্য উঁকি দিয়ে লোকটির মুখে টর্চ ধরার চেষ্টা করল মোহ। ঢক গিলে শুধাল,
“কে ও…ওখানে?”
তৎক্ষনাৎ টিনের সেই দরজায় করাঘাত পড়ল। লোকটি দরজা সজোরে টেনে ধরতেই খুলে গেল দরজা। পেছনে ছিটকে এলো মোহ। দ্রুত পুরুষটির মুখে টর্চ মারতেই চোখমুখ খিঁচে ফেলল সে। কাকভেজা অবস্থা, যে হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকছে সে হাতে তাজা র;ক্ত, শার্ট ভর্তি কাঁদা। ইশশ…কী বাজে অবস্থা!
চলবে….
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]