#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৪
জাওয়াদ জামী
কান্তাকে খালার বাসায় রেখে দা’ফ’নকা’জ সম্পন্ন করে আরমান ফিরতি পথ ধরতেই তাকে ডাক দিলেন শহিদ আহমেদ।
” আরমান, বাসায় চল। তোমার সাথে কিছু কথা আছে। ” ভদ্রলোক মা’য়ের শোকে ভেঙ্গে পড়েছেন। সে তার মা’য়ের পরিনতির জন্য শুভকে দুষছেন।
” আপনার যা বলার এখানেই বলুন। আমি ঐ বাড়িতে আর পা রাখছিনা। ”
” এখানে কথা বলার মত কোন পরিবেশ নেই, বাবা। চল আমরা অন্য কোথাও বসি? ” শহিদ আহমেদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আরমান পাশের পার্কটায় আসে।
সিমেন্টের আসনে বসে আছে দুইজন। কারও মুখে কোন কথা নেই। একজন তার ছেলেকে কি বলবে, সেই কথামালা মনে মনে সাজাচ্ছেন। আর অপর পাশে থাকা ব্যাক্তি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে কিছু শোনার জন্য।
নিরবতা ভেঙে মুখ খুললেন, শহিদ আহমেদ।
” আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, আরমান। আমার সব কৃতকর্মের জন্য। প্লিজ, আমাকে এভাবে দূরে ঠেলে দিওনা। আজকাল রাতে ঘুম হয়না। চোখ বুজলেই তোমার সব অভিযোগ, অভিমান, আমার সব পাপ এসে বারবার জানিয়ে দেয়, আমি পাপী। আজন্ম এই পাপের ভাগীদার হয়েই আমাকে বাঁচতে হবে। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা করতে, তবে বোধকরি পাপের বোঝা একটু হালকা হত। ” কথা বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে উঠেন শহিদ আহমেদ।
চোখের সামনে বাবাকে কাঁদতে দেখে আরমান একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সামনে থাকা মানুষটা যতই অন্যায় করুকনা কেন, সে আরমানের বাবা, কথাটা চিরন্তন সত্য। বাবাকে দেখে আরমানের বুকের ভিতর ভারী হয়ে আসে। আবার ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠে,সে অপরাধী।
” আপনাদের কারও ওপর আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি সবাইকে অনেক আগেই ক্ষমা করেছি। তবে সবার ক্ষমার সাথে আপনার ক্ষমার একটু পার্থক্য আছে। সবার সকল অন্যায় ক্ষমা করলেও আপনার একটা অন্যায় আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবনা। আর সেটা হচ্ছে আমার মা’য়ের ওপর বিশ্বাস হারানোর অন্যায়। আপনি এতটা বছর ধরে আমার মা’কে দোষী ভেবে এসেছেন। যাকে একসময় ভালোবেসেছিলেন, যে মানুষটা দিনের পর দিন আপনার মায়ের কটুকথা শুনেও আপনার ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে, আপনার সাথে সংসার করেছে কোন অভিযোগ ছাড়াই। তাকে খুব সহজেই কিভাবে আপনি দোষী ভাবলেন! ঘৃণা পর্যন্ত করলেন! আর সেই ঘৃণার প্রভাব পরল আমার ওপর! কি আশ্চর্য না! আপনি একটাবারও ভেবে দেখলেননা, যে মানুষটা কিশোরীকাল থেকে আপনাকে ভালোবাসল, সেই মানুষটা কিভাবে তার সুখের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। আমার মা’য়ের প্রতি অবিশ্বাস করে যে অন্যায় আপনি করেছেন তার কোন ক্ষমা হয়না। অন্যরা নাহয় আমার মা’কে চিনতে পারেনি। তাই তারা অনেক কথাই বলেছে। কিন্তু আপনি! আপনি কি করে এই ভুল করলেন? তবে কি আপনি মা’কে ভালোই বাসেননি? যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আর বিশ্বাস থাকে। কিন্তু আপনার দিক থেকে এই দুইটার একটাও কি আদৌ ছিল? ”
শহিদ আহমেদ ছেলের কথার কি জবাব দিবে তা ভেবে পায়না। লজ্জায় তার মাথা নত হয়ে আসে।আজ আরমানের কথা শুনে তার সত্যি মনে হচ্ছে, আইরিনের প্রতি হয়তো তার কোন ভালোবাসাই ছিলনা। তাই খুব সহজেই আইরিনকে ভুলতে পেরেছেন তিনি। আইরিনের স্থানে অন্য কাউকে বসিয়ে দিব্যি সংসার করে গেছেন। সত্যিই তার এই অপরাধের কোন ক্ষমা হয়না।
” ঠিক আছে তুমি আমাকে ক্ষমা করোনা। কিছু কিছু অপরাধের ক্ষমা না হওয়াই উত্তম। আমি নাহয় শেষ বিচারের দিন আইরিনের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিব। আমার বিশ্বাস সেদিন আইরিন আমাকে ফিরিয়ে দিবেনা। সেদিন নিশ্চয়ই তুমি আমাকে ক্ষমা করবে? এই জীবনে তো তোমাদের নিয়ে সুখে থাকা হলোনা, ঐ জীবনেই নাহয় তোমরা আমার সাথী হয়ে থেক। এছাড়া আর কিইবা বলার আছে আমার! ”
” বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি এখন বাসায় যান। আর বেশি চিন্তা করবেননা। নিজের খেয়াল রাখবেন। শুভকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করুন। এখনও সময় আছে। তা নাহলে ভবিষ্যতে ওকে নিয়ে আপনার ভুগতে হবে। কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে আমাকে জানাবেন। আরেকটা কথা। আমার বড় খালার ছোট ছেলে রিয়াদ, তার জন্য খালা শ্রীজাকে পছন্দ করেছে। রিয়াদ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছে। তারও শ্রীজাকে পছন্দ। আমার মনে হয় শ্রীজা এই বিয়েতে অমত করবেনা। আপনি বাসায় কথা বলে দেখেন। তবে আর যাই করেন, আশা করি শ্রীজাকে কাঁদাবেননা। ”
” ঠিক আছে আমি আকলিমার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব। তবে কয়েকটা দিন যাক। তুমি আপাকে আমার সালাম জানিও। তাদের পরিবার সম্পর্কে আমার ভালো ধারনা আছে। শ্রীজার মতামতের বাইরে আমি কোন কাজ করবনা। আমার একটা কথা রাখবে, আরমান? ”
” বলুন। ”
” আমি আমার নাতি/নাতনিকে কিছু দিতে চাই। তুমি কি রাজি হবে? বউমা তোমার অনুমতি ছাড়া কিছু করবেনা, তা আমি ভালো করেই জানি। জানো, যখন শ্রীজার কাছে খবরটা শুনলাম, তখন নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার ছেলেটাও বাবা হতে চলল! একজন খাঁটি বাবা। অথচ আমি কখনোই ভালো বাবা ছিলামনা। খবরটা শুনে আমি কি যে খুশি হয়েছি, এই সুখের কাছে যেন দুনিয়ার সকল সুখ তুচ্ছ। ”
” এখনও আপনার নাতি/নাতনির আসতে অনেক সময় আছে। পরের কথা আগে ভাবার দরকার নেই। এখন বাসায় যান। ” আরমান সুকৌশলে বাবার কথা এড়িয়ে যায়।
” আরমান, আমাকে কোলে নিতে দিবে তোমার সন্তানকে? আমি ওকে একটুও কষ্ট দিবনা দেখ। ভালো বাবা হতে পারিনি, কিন্তু ভালো দাদু আমি অবশ্যই হব। ” শহিদ আহমেদ ছেলের হাত ধরে কেঁদে উঠেন।
এবার আরমানেরও খারাপ লাগছে। চোখের সামনে বাবাকে বারবার নত হতে দেখলে কোন সন্তানেরই ভালো লাগেনা। আরমান বাবার সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা অনেকবারই করেছে, কিন্তু কোথাও যেন একটা বাঁধা থাকে। যা বারবার আটকে দেয় আরমানকে।
জাবেদ বসে বসে স্কুলের খাতা দেখছে। এমন সময় শিখা হনহনিয়ে ঘরে ঢোকে।
” আমাকে দুই হাজার টাকা দাওতো৷ ”
” কি করবে দুই হাজার টাকা দিয়ে? ” চোখ সরু করে তাকায় জাবেদ।
” দরকার আছে। তোমাকে বলা যাবেনা। ”
” কি দরকার? আমার কাছে থেকে টাকা নিবে আবার আমাকেই বলবেনা! সোজাভাবে বললেও পার, তোমার অকর্মা ভাইকে দেয়ার জন্য টাকা লাগবে। এখন আমার কাছে কোন টাকা নেই। ” সোজাসাপটা জবাব দেয় জাবেদ।
” তুমি আমার ভাইকে অকর্মা বললে? মাত্র দুই হাজার টাকাইতো চেয়েছি। তাতেই তোমার আঁতে ঘা লেগেছে? পেয়েছ তো আমাকে বিনা পয়সার চাকরানী। তোমার বাড়িতে আসার পর থেকেই দাসীর মত খেটে গেলাম, কিছুই পেলামনা। শুধু শরীর শেষ করলাম খাটতে খাটতে। এই কয়টা টাকা চাইতেই তোমার রুপ দেখিয়ে দিলে। একটুও মায়া হলোনা আমার ওপর! ”
” তুমি কবে শরীর শেষ করলে! এই বাড়িতে এসে থেকেই পায়ের উপর পা তুলে থেকেছ। কান্তা যতদিন ছিল, সব কাজ সে-ই করেছে। ও যাওয়ার পর থেকে কাজের মেয়ে রেখেছ। আর প্রতিমাসেই একটা নির্দিষ্ট টাকা তোমার কাছে দিই, তোমার সাজপোশাকের জন্য। এতেও তোমার মন ভরেনা! বিয়ের পর থেকেই তোমার বাবার পরিবারকে টানছি আমি। তোমার ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচটাও আমাকেই দিতে হয়। অথচ নিজের বোনকে একটা টাকাও দিইনি। এরপরও তোমার মুখে এত কথা আসে কিভাবে? আসলেই তুমি একটা নিমকহারাম। কই তোমার বড় বোনও তো আছে। সে তো তোমার বাবা-মাকে কোন খরচই দেয়না। তবুও আমি কখনও কিছু বলেছি? তুমি চাইতেই আমি টাকা দিই। কিন্তু আমারও একটা সন্তান আছে। তার ভবিষ্যৎ আমাকেই সুরক্ষিত করতে হবে। আজ থেকে তোমার ভাই-বোনকে আমি কোন টাকা দিতে পারবনা। তোমার বাবাকে বল তার ছেলে-মেয়ের দ্বায়িত্ব নিতে। তার তো সম্পত্তি আছে। প্রয়োজনে সেগুলো বিক্রি করে ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা শিখাক। ”
” তুমি আমার বাবা-মাকে টাকার খোঁটা দিচ্ছ? এখন বোনই সব হয়েছে? আমরা কিছুই নই! আমি যদি পায়ের উপর পা তুলে থাকি, তবে তোমার পেটে ভাত যায় কিভাবে? করো তো দুই টাকার মাষ্টারি, তাতেই এত অহংকার! বিপদে পরলে কে সাহায্য করতে আসে সেটা আমি দেখব। ঐ অপয়া বোনের পক্ষ নিচ্ছে এখন? আসুক একবার এখানে। ওর টুটি আমি ছিঁ’ড়ে ফেলব। দূরে যেয়েও আমার সংসারে আ’গু’ন লাগাচ্ছে! আমি আমার ভাই-বোনকে একশবার টাকা দিব। দেখি তুমি কি করতে পার। ”
” তুমি আমাকে যা বলার বল কিন্তু কান্তাকে নিয়ে একটা কথাও বলবেনা। ও এই বাড়িতে থুতু ফেলতেও আসবেনা। ওর এখানে আসার প্রয়োজন নেই। ও তোমার ভাই-বোনের মত মানুষের সাহায্য নিয়ে বাঁচতে জানেনা। ওর স্বামীর যথেষ্ট আছে। আরমান এখন এএসপি। তোমার ভাইয়ের মত ভিখারি নয়। আর নিজের ভাই-বোনকে যদি কিছু দেয়ার ইচ্ছে হয়, তবে এউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেয়ে নিজে কামাই করে দাও। আমার পরিশ্রমের টাকা আমি আর কাউকে দিয়ে ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবনা। ”
শিখা এবার থমকায়। জাবেদ ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে! ও বুঝতে পারে এখন আর কথা না বাড়ানোই ভালো। পরে সময়-সুযোগ বুঝে জাবেদের কাছ থেকে টাকা নিতে হবে।
কিন্তু একটু আগে কি বলল সে! আরমান এএসপি হয়েছে! ঐ অপয়ার কপাল এত ভালো!
ওকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল শিখা। তাইতো সৎ শ্বাশুড়ির সংসারে পাঠিয়েছিল। যেদিন ঐ বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে, তারপরই কান্তার বান্ধবীর মায়ের কাছ থেকে ঐ বাড়ির বিষয়ে সব খুঁটিনাটি জেনে নিয়েছিল। নম্বর নিয়েছিল, কান্তার বান্ধবীর খালার। যে কান্তার খোঁজ ঐ বাড়িতে দিয়েছিল। সেই মহিলার কাছ থেকেই শিখা জানতে পারে আকলিমা আরমানের সৎ মা। তাই শিখা দেরি না করে বিয়ে যত তারাতারি হয় তার জন্য উঠেপড়ে লাগে। ও ভেবেছিল, সৎ শ্বাশুড়ির সংসারে অপয়া কখনও মাথা তুলতে পারবেনা। সেখানেই পঁচে ম’র’বে। কিন্তু ও এখন কি শুনছে! তবে কি ওর পুরো পরিকল্পনাই ব্যর্থ!
চলবে…