#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩)
অনেকক্ষণ ল্যাপটপে ডুবে ছিল অভি। শরীর অবশ হয়ে এসেছে। হাত পা নাড়ানোর সময় খেয়াল হলো উষশী নেই। শুরুতে বিশেষ কিছু ভাবল না সে। নাস্তার সময় হয়ে এসেছে। সে মৃদু সরে ডাকল,”উষশী,ডাইনিং এ আসো। নাস্তা করবে।”
জবাব নেই। অভিরাজ আরো কয়েকবার ডেকেও যখন শব্দ পেল না তখন চারপাশে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে এল।
“গার্ড,উষশীকে দেখেছ?”
“উষশী মানে…”
“একটা বাচ্চা মেয়ে। তেরো চৌদ্দ বছর বয়সী হবে। সাথে একটা সাদা রঙের বিড়াল।”
“ও হো,একটু আগেই তো বের হলো। আমি ভাবলাম প্রতিবেশী হয়ত।”
গার্ডের কথায় গলা শুকিয়ে এল অভিরাজের। সে এক সেকেন্ড দেরি না করে বেরিয়ে পড়ল। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল চারপাশে। গত রাতের বৃষ্টিতে চারপাশ জ্যাম হয়ে এসেছে। একদম মানুষজন নেই। রাস্তায় গাছের ডাল পালা পড়ে আছে। বৃষ্টির পানিতে আশপাশ গুলো ভরে উঠেছে। কাদা পানির উপর দিয়ে ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটতে লাগল সে। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। রাগ হচ্ছে নিজের উপর। এতটা কেয়ারলেস সে!
কোকো বড্ড দুষ্টুমি করছে। উষশী হাঁপিয়ে উঠল। সে কোমরে হাত গুঁজে দিয়ে বলল,
“তোমায় রেখে চলে যাব কোকো। তুমি বড়ো জ্বালাচ্ছ।”
কোকো পাত্তা দিল না। সে যেন পরিবেশটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। হুট করেই কাদার মধ্যে লাফিয়ে উঠল। পুরো শরীর মেখে গেল কাদা জলে। ছুটে এসে ধরল উষশী। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কাঠ গলায় বলল,
“কোকো! তোকে আমি খুব মা র ব। তুই কি করলি এটা।”
কোকো মিউ মিউ করছে। ভারী মজা লাগছে তার। সে শরীর ঝাড়া দিতেই উষশীর মুখে এসে লাগল কাদা পানি। সে চোখ রাঙাল।
“তুই এত দুষ্টু হয়ে গেছিস!”
উষশী আসলেই রেগে গেল। কোকো কে ফেলে রেখে চলতে শুরু করেছে। কোকো মিউ মিউ করে ডাকল। উষশী’র সাড়া না পেয়ে সেও এল পেছন পেছন। উষশী আর রাগ করে থাকতে পারল না। কোকো কে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল।
এক ঘন্টা হয়ে গেল উষশীকে খুঁজে চলেছে অভিরাজ। পাগলের মতো খুঁজছে সে। সাতাশ বছর বয়সী অভি যেন কিশোরে ফিরে এসেছে। যার চোখে মুখে ভয়। বুকের ভেতর সংকট। এত বাজে অনুভূতি হচ্ছে। লাবণ্য’র কল পেয়ে আরো বেশি ভেঙে পড়ল যেন। সবটা বলতেই লাবণ্য বলল,”কোথায় গেল মেয়েটা।”
“বুঝতে পারছি না। আমার মাথা জ্যাম হয়ে আছে।”
“তুই টেনশন নিস না। আমি আসছি।”
“হুম।”
পুনরায় ব্যস্ত হয়ে গেল অভিরাজ। তার পা চলছে না। হাত পা ঝিম ধরে গেছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর ভীষণ ভাবে ক্ষত হচ্ছে। বাচ্চা একটা মেয়ে!
রাস্তাটা কিছুটা পরিচিত মনে হলো উষশী’র। সে এখনো তেমন কিছু খেয়াল করেনি।
“তুমি কি রাস্তাটাকে চিনতে পারছ কোকো?”
কোকো জবাবহীন। উষশী ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখছে।
“মনে হচ্ছে এর আগেও আমি এসেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না।”
কোকো মিউ শব্দ করল। উষশী’র পায়ে স্লিপার। সম্ভবত অভিরাজের। কারণ তার পায়ের থেকে বেশ বড়ো জুতোটা। কিছু সময় পর উষশী’র খেয়াল হলো সে রাস্তা চিনতে পারছে না। যেদিকেই যাচ্ছে অপরিচিত মনে হচ্ছে। কোন রাস্তা দিয়ে এসেছে মনে নেই। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কয়েকবার চক্কর দিয়েও লাভ হলো না। সামনেই একটা পার্ক দেখা যাচ্ছে। একটা মানুষও নেই সেখানে। উষশী সেখানে এল। কোকো লাফিয়ে নেমে গেল কোল থেকে।
“কোকো আমরা আবার হারিয়ে গেলাম।”
এতে অবশ্য কোকোর যায় আসে না। সে আপনমনে মেতে আছে। উষশী বেঞ্চে এসে বসল। তার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। এতটা হেলা না করলেও পারত।
অভিরাজের এই মুহূর্তে মনে হলো উষশীকে না দেখতে পেল শেষ হয়ে যাবে। এত কষ্ট হতে লাগল তার। বাচ্চা মেয়েটির কথা ভাবতেই ওর হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে। এমন অভিমানি মেয়ে কারো খপ্পরে পড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কাউকে যে বলবে তার ও জো নেই। মেয়েটার নাম আর গড়নের বর্ননা ছাড়া আর কিছুই তো জানে না সে। এমনকি একটা ছবি ও নেই। ছবি না তোলার জন্য নিজেকে ইউজলেস মনে হচ্ছে। একটা ছবি তুলে রাখলে কি হত? ফোনের রিং এ ধ্যান এল ওর। লাবণ্য কল করেছে।
“অভি,কোথায় তুই?”
“মেইন রোডে আছি।”
“ফিরে আয়। উষশীকে পেয়েছি।”
“কোথায় পেয়েছিস?”
“বাচ্চাদের পার্কটাতে। ভাগ্যিস বাইরে নজর রেখেছিলাম।”
বাড়ি ফিরে উষশীকে সোফায় বসে থাকতে দেখল অভিরাজ। প্রচন্ড রাগ হলো তার। এক প্রকার ধমকে উঠল। উষশী এবার সত্যিই ভয় পেয়েছে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে।
“আর ইউ সিলি? আমি অবাক হচ্ছি,একটা মানুষ কি পরিমাণে অদ্ভুত হতে পারে! ভদ্রতা তো বহু দূরের কথা,এটলিস্ট বলে তো যাবে। বাইরে যাবেই যখন,গার্ডেনেও থাকা যেত। কিন্তু না, চিন্তা না দেওয়া অবধি শান্তি নেই। ইউলেস একদম।”
লাবণ্য কিচেন থেকে ছুটে এল। অভিরাজকে রেগে যেতে দেখে বেশ ভয় পেয়েছে উষশী। কাঁপছে তার শরীর।
“অভি এভাবে বলিস না।”
“আর সাফাই না দে লাবণ্য। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এমন ফা ল তু মেয়ে এ জন্মে দেখি নি। ওকে সাথে আনাই ভুল
হয়েছে।”
রাগের চোটে শরীর কাঁপছে অভিরাজের। মুখের চোয়াল উঠানামা করছে। ডিভানটাকে ধাক্কা দিয়ে উপরে উঠে গেল। সেদিকে তাকিয়ে হতাশার শ্বাস ফেলল লাবণ্য। উষশী একই ভাবে দাঁড়িয়ে। নড়ছে না অবধি।
উষশী সেই কখন থেকে জানালার কাছটায় বসে আছে। ফের বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। কোকো পাশে বসে মিউ মিউ করছে। একটুও ধ্যান নেই তাতে। ওর দৃষ্টি বাইরের গাছে। সেখানে একটা পাখির বাসা। মা পাখিটা ছানা গুলোকে জড়িয়ে আছে। তারই পাশে বাবা পাখিটা বসে। সে হয়ত খাবার খুঁজতে যাবে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে। অভি’র মাথা ঠান্ডা হয়নি তখনো। লাবণ্য এসে বলল,”তুই যে কি অভি।”
“কি করেছি?”
“ওভাবে না বললেও পারতি।”
অভিরাজের থেকে উত্তর মিলল না। লাবণ্য পাশের চেয়ারটাতে বসে বলল,”মেয়েটা একদম শান্ত হয়ে গেছে।”
“ভালো হয়েছে।”
“তবু ওভাবে বলা ঠিক হয়নি তোর।”
“জানিস কতটা চিন্তা লাগছিল আমার। তুই জানিস আমি আমার দায়িত্বটাকে কত গভীর ভাবে দেখি।”
“বুঝেছি,তবে সবাই তো এক হয় না অভি। তাছাড়া এই বয়সটা ছেলেমানুষী করারই।”
অভিরাজ এবারও উত্তর করল না। লাবণ্য কিছু সময় থেকে চলে গেল। উষশী’র হাল্কা বাদামি চুল গুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। হাঁটুসম ফ্রকে তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। মেয়েটা অনেকটা অদ্ভুত। তার স্বভাবে মায়ের ছোট্ট ছানা ছানা ভাব রয়েছে। অভিরাজ দেখল উষশী’র নড়চড় নেই। কেমন যেন থমকে গেছে। ওর গিল্টি ফিল হলো। সত্যিই বেশি বলে ফেলেছে। তবে তখন এত রাগ হচ্ছিল। সে কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস নামাল সে। অত্যন্ত নরম কণ্ঠে বলল,”বৃষ্টি দেখছ?”
উষশী নিশ্চিত শুনতে পেল তবে জবাব দিল না। অভি খুব বুঝতে পারল বাচ্চাটার হৃদয়ে অভিমানের পাহাড় জমেছে। সে দোলনার অপর পাশটায় বসল। এতে এক চুলও নড়ল না মেয়েটি।
“কোকোর বয়স কত?”
এবার ও উত্তর নেই। অভি খুব বুঝতে পারছে অভিমানের পাহাড়টা আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। তার সত্যিই খারাপ লাগছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা তো হয়েই গেছে। সেসব তো চাইলেও বদলানো যাবে না। উষশীর পাশে বেশ কিছু সময় বসে রইল অভিরাজ। প্রতিটা মানুষের শরীরেরই একটা ঘ্রাণ থাকে। উষশীর শরীর থেকে কেমন বেলি ফুলের মতো সুবাস আসছে। কোমল বাচ্চা মেয়েটার হাতের খুব নিকটে রয়েছে তার বড়ো হাতটি। অভিরাজ হাত সরিয়ে বলল,”সরি। আর কখনো ওভাবে বলব না। তখন এত রাগ হচ্ছিল তাই বলে ফেলেছি।”
“সরি তো আমার বলা উচিত।”
“তুমি কষ্ট পেয়েছ?”
“আমি তো অভদ্র,ইউজলেস।”
নিজের গালে ঠা স করে চ ড় দেওয়ার ইচ্ছে হলো অভিরাজের। সত্যি সত্যি কাজটি করত সে যদিনা পাশে উষশী থাকত।
“উষশী,প্লিজ ফর্গিভ মি। আমার ওভাবে বলা উচিত হয় নি। রাগের বসে বলে ফেলেছি।”
বাচ্চা মেয়েটা নজর ঘুরিয়ে ফেলল। তার চোখ জ্বালা করছে। এই মুহূর্তে কথা বলতে পারছে না সে। অভিরাজের বুকের ভেতরটা কেমন ধীম ধীম করছে। মেয়েটি কি কাঁদছে?
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
**পাঠক ধীরে ধীরে সব কিছুই জানবেন। এটা একটা দীর্ঘ উপন্যাস সুন্দর মন্তব্য আশা করছি।**