#গভীর_গোপন #৫ম_পর্ব #অনন্য_শফিক

0
261

#গভীর_গোপন
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



জুঁই চলে যাবার পর আমার কেমন একলা লাগতে শুরু করলো।খুব মন খারাপ লাগছে!
জেবা,টুকি এরা এখনও ফিরেনি। কোথায় চলে গেল ওরা? নাকি আশফাকের সঙ্গে বাইরে কোথাও ঘুরছে?
এখন আর কোন কিছুতেই আমার বিশ্বাস টেকে না।
আশফাকের নম্বরে কল করলাম আমি। নম্বর বন্ধ। ও কোন কারণ ছাড়া নম্বর বন্ধ করবে কেন? নাকি —
আমি কোনদিন কারোর প্রাইভেসি চেক করিনি। কোনদিন চেক করবো এরকম ভাবিওনি! ওরকম লোকই না আমি। কিন্তু সমস্যা যখন নিজের ঘরের ভেতর ছুটে আসে,তা পরখ করতে গিয়ে ওসব ভালো মানুষী ধরে রাখা চলে না!
আমি দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে জেবার ঘরে ঢুকে পড়লাম।
জেবা দুটো বড় বড় ব্যাগ এনেছে।ব্যাগ দুটোতে লক দেয়া।ব্যাগ ব্যতীত এটা ওটা চেক করেও সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না।ওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় শুধু বিছানার বালিশের দিকে হঠাৎ চোখ পড়লো।একপাতা পিল পরে আছে ওখানে।দেখে মনে হলো আমার বুকের ভেতরটায় কে যেন হঠাৎ করে তার বিষাক্ত নখ দিয়ে খামচে ধরেছে ।বালিশ সরিয়ে ওঠা হাতে নিতেই দেখি ওখান থেকে অনেক গুলো ইতিমধ্যেই খাওয়া হয়ে গেছে। ওষুধের পাতাটা ওখানে রাখতে রাখতে আমার কেবল মনে হলো, বিশ্বাস খুবই চমৎকার এক জিনিস। বিশ্বাস না করলে সংসার হয় না। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস খুবই বাজে একটা জিনিস।এটা সংসার আর রাখে না। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।

জেবা ফিরলো সন্ধ্যায়।ওর দু’ হাত ভর্তি শপিং।মুখ ভর্তি উচ্ছল হাসি। কেনাকাটা করেছে সম্ভবত।ও ফিরেই আমায় ডাকলো ওর ঘরে।আমি কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওর ঘরে গেলাম।জেবা হাসি হাসি মুখে বললো,’ এই গুলো আমার আন্টি কিনে দিয়েছেন। কদিন পরেই ওখানে চলে যাবো আমি। আন্টির বাসার একটা ফ্ল্যাট খালি হবে। ওখানে উঠবো গিয়ে। তাছাড়া আন্টি একটা জবের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন আমায়।আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকছি না তুলি! এখন নিজের পায়ে দাঁড়াবার সময় হয়েছে।’
জেবা খুব হাসিখুশি।ওর সঙ্গে এতো কিছু ঘটেছে দেখে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। আগে কথায় কথায় কাঁদতো। এখন আর কাঁদে না! হাসে।
এরিমধ্যে হুট করে টুকি তার মায়ের আঁচল ধরে টানতে টানতে বলে উঠলো,’ মা, আশফাক মামা যে আমায় চকোলেট কিনে দিলো, ওগুলো দাও।আমি খাবো। সবগুলো খাবো।’
আমি চমকে উঠে তাকালাম।জেবা হাসিহাসি মুখে বললো,’ ওখান থেকে ফেরার সময় আশফাকের সঙ্গে দেখা।ওর অফিসের সামনে দিয়েই আসতে হয়। ও তখন ওর অফিসের সামনে দোকানে বসে সিগারেট টানছে। আমাদের দেখে ডেকে রিক্সা থামালো।টুকিকে চকলেট কিনে দিলো।
টুকি বললো,’ এহ্ সবগুলোই তো মামা দিয়েছে। আমার সুন্দর জামাটা দেখাও আন্টিকে! আর বলেছে ডালিম —‘
জেবা রাগে চোখ গরম করে মেয়ের দিকে তাকালো।ধমক দিয়ে বললো,’ সবগুলো দাঁত ফে*লে দিবো এক চ*ড়ে । বেয়াদব মেয়ে।’
জেবা মেয়েকে শা*সিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবার মৃদু হাসলো। হেসে বললো,’ মেয়েটা বেশি পেকে গেছে। বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে।দেখলে না আগে একদিন কি সব পঁচা কথা বলে বসলো তোমার কাছে। ওকে নিয়ে যে কি বিপদের মধ্যে পড়েছি তুলি! জায়গায় জায়গায় লজ্জা পেতে হয় ওর জন্য!’
আমার আর ওখানে থাকতে ভালো লাগছে না। ওকে দেখতেই ইচ্ছে করছে না আর। শরীর রাগে জ্বলছে।আমি বললাম,’ জেবা, আমার শরীর খারাপ লাগছে। গিয়ে শুয়ে থাকবো একটু।’
জেবা বললো,’ ঠিক আছে।যাও।আর শুনো, ওই হারামজাদাটার সঙ্গে ডিভোর্সের বিষয়টা এখন পাকাপাকি।আমি বলে দিয়েছি হিসেবে যতোটা টাকা আসে এর এক পয়সা কম দিলেও মানবো না!ঠিক করিনি তুলি? যে যেমন ইতর তার সঙ্গে ওরকম ইতরামি করতে হয়!’
আমি হাসলাম।আর মনে মনে বললাম, তুমিও ইতর। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইতর তুমি।

ঘরে এসে মেসেজ করে সব বললাম জুঁইকে । জুঁই বললো সে কাল আসবে।এসে এর একটা বিহিত সে করে ছাড়বে।
আমি বললাম,’ কীভাবে করবে?’
সে বললো,’ এলেই বুঝবে কিভাবে কি করি।’

বিকেল বেলা জেবা চা করলো। বারান্দায় বসে খেতে ডাকলো।আমি বললাম,’ আমার পেটে আবার ব্যথা হচ্ছে।খাবো না।’
জেবা সম্ভবত বিরক্ত হয়েছে। তার মুখ কেমন গুমড়া করে রেখেছে।আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম। তার পাশে দু কাপ চা।এমনি এমনি জুড়িয়ে জল হচ্ছে । খাওয়া হচ্ছে না দুটোর একটিও।
আমি বললাম,’ জেবা, তোমারটা খাচ্ছো না কেন?’
জেবা বললো,’ এমনিতেই। ইচ্ছে করছে না।’
আমি মিটিমিটি হাসলাম।মনে মনে বললাম,’ শয়তান মেয়ে।খাবে কেন? এটা তো তোমার বাহানা মাত্র। উদ্দেশ্য তো আমাকে খাওয়ানো। খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা।’
টুকি খেলছে।ওই সাদা বেড়ালটার সাথে। হঠাৎ করেই বেড়ালটা খামচি বসিয়ে দিয়েছে টুকির পায়ে। কিন্তু টুকি ততোটাও ব্যথা পায়নি।ভয় পেয়েছে কিছু টা ‌।
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,’ টুকি, বেড়ালটাকে তাড়িয়ে দাও। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এটা।যে উড়ে এসে জুড়ে বসতে চায় তাকে বসার আগেই তাড়িয়ে দিতে হয়!’
জেবা কথাটা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তার চেহারা মুহূর্তে কেমন পরিবর্তন হয়ে উঠেছে। সে কি বুঝতে পেরেছে যে,বেড়াল নয়, এই কথাটা মূলত তাকে উদ্দেশ্য করেই আমি বলেছি?

রাতের রান্নাটা আমিই করলাম।জেবা রান্নাঘরে গিয়েছিল।আমি বললাম,’ তুমি মেহমান এই বাড়ির। মেহমান থাকবে মেহমানদের মতো করে। সে রান্না করবে কেন? বাড়ির কাজ করবে কেন? বাড়ির কাজ করবে বাড়ির লোকেরা। বাড়ির লোকেরা কাজ সামলাতে না পারলে কাজের লোক রাখা হবে। কিন্তু মেহমান দিয়ে কাজ করানো এটা তো রীতিমত অসভ্যতা।তাই না জেবা?’
জেবা হাসলো।আর কিচ্ছু বললো না। কিন্তু আমি জানি ওর ভেতরে আগুন ফুঁসলে উঠেছে তখন। কিন্তু এই আগুন সে কিছুতেই দেখাতে পারছে না আমায়। দেখাতে পারবেও না সহজে!

রাতে আশফাক বাড়ি ফিরে হতাশ হলো সম্ভবত।কারণ আমি তখনও জেগে।টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ স্বর্গের নীচে মানুষ ‘ পড়ছি।
সে এসে হাসার চেষ্টা করলো।জোর করে হাসলে সেই হাসি উপলব্ধি করা যায়। তার হাতে একটা সুতোর ব্যাগ। বাইরে থেকেই দেখা যায় ব্যাগের ভেতর চারটে ডালিম রাখা।
আমি ম্রীয় হাসলাম। বললাম,’ ডালিম আনলে যে হঠাৎ?’
আশফাক থতমত খেয়ে গেলো।বললো,’ আসার সময় পেয়েছি।তাই নিয়ে এসেছি। তুমি খেলে উপকার হবে।খুব ভিটামিন আছে। ভাবলাম তোমার খাওয়া প্রয়োজন। এমনিতেই তো এখন শরীরে পুষ্টি লাগবে।’
আমি বই থেকে চোখ তুলে আবার হাসলাম। বললাম,’ ডালিম আমার অপছন্দের। তুমি ভুলে গেছো আশফাক? ‘
আশফাক আবার থতমত খেলো। বললো,’ তুমি না খেলেও আমি খাবো।খুব স্বস্তায় পেয়েছি তো তাই লোভ সামলাতে পারলাম না। নিয়ে এসেছি।’
আমি বললাম,’ খুব ভালো করেছো।টুকিকে ডেকে দিয়ে দেও।ও বিকেল বেলা ডালিম খেতে চেয়েছিল। তুমি খেতে চাও যদি তবে একটা রেখে দিতে পারো।’
এই কথা শোনার পর আশফাকের চেহারা দেখে কে? আমি নিজেই ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম।ওর মুখ ধরা পড়া চোরের মতো রক্তশূন্য হয়ে গেছে!
আমি বইটা বন্ধ করে দিয়ে একপাশে রেখে দিলাম। তারপর বসা থেকে উঠে ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,’ মানুষ সবচেয়ে রহস্যময় প্রাণী আশফাক। সবচেয়ে বেশি রহস্যময়।’
আশফাক কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,’ কেমন?’
আমি বললাম,’ ধরো দুজন মানুষ একটা ছাদের নিচেই অনেক গুলো দিন ধরে থাকছে।একটা খাটেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে।একের ঘামে ওপরে লেপ্টে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা একজন অপরজনের উপরের টুকুই শুধু চিনতে পারছে।একে অপরের উপর টুকুই শুধু মুখস্থ এদের। ওরা ভাবে ওরকম ভাবে একে অপরের ভেতরটাও বুঝি চিনে।জানে । কিন্তু না।জানে না। কিচ্ছু জানে না ভেতরের। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো উপরে উপরে যারা খুব ভালো। এদের অনেকের ভেতরটাই না পঁচা।খুব পঁচা।’
এসব বলতে গিয়ে রাগে এবং একটা দুঃখ কাঁচের আঘাতে আমার চোখ ভিজে উঠলো জলে।কান্না পাচ্ছে খুব। অসহায় লাগছে বড় নিজেকে। কিন্তু চোখের জল তো অতো সস্তাও না যে যার তার জন্য কাঁদতে হবে।আমি জানি, কার জন্য কাঁদতে হবে এবং কার জন্য কান্না করা যাবে না।
আমি দেখছি আশফাকের কপাল ঘামছে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভেজা চুপসানো গলায় আবার বললাম,’ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্ট কি জানো আশফাক?’
আশফাক কিছু বললো না। তার হয়তো এসব শোনার, জানার কোন রকম ইচ্ছে নেই।
আমি নিজ থেকেই ওকে বললাম,’ বিশ্বাসঘাতকতা।’

#চলবে

৪র্থ পর্বের লিংক –
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/806932241028550/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here