প্রেম_প্রেম_পায় #স্বর্ণালী_সন্ধ্যা পর্ব ষোল

0
920

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব ষোল

১৬.
বাসায় ফিরেই অপরাজিতাকে অনেক বকা খেতে হয়েছে। শাড়ি পড়ে অসময়ে ভেজার কারনে দারুণ বকা জুটেছে তার কপালে। কিন্তু একটা কথাও সে কানে নিয়েছে কিনা সন্দেহ। তার কানে এখনো ভাসছে ফায়াদের কথা। চোখের এখনো ভাসছে তার চেহারা। মাথায় এখনো ঘুরছে তার নিকটে যাওয়া।আজকের সেই মুহুর্তটা তে অপরাজিতার মনে হচ্ছিল তার চেনা গম্ভীরমুখো ফায়াদ হারিয়ে গিয়ে প্রেমিক ফায়াদ এসেছে তাকে অনুভূতিতে ভাসাতে।

অপরাজিতা মায়ের কথা মন দিয়ে শুনছিল না বলে শেষে খেল এক রাম ধমক। ধমক খেয়ে ভাবনা থেকে ছিটকে সরলো সে।তারপর আরো কিছু বকা হজম করে রুমে ফেরত আসলো সে। রুমের দরজা আটকে দিল চেঞ্জ করবে বলে। আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো সাজ খোলার জন্য। চুড়ি খুলে আয়নার দিকে তাকাতেই তার চোখ পড়লো ঠোটের দিকে৷ সাথে ভেসে উঠলো ফায়াদের সেই ফিসফিসানো কথা। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল সে। লজ্জায় মরি মরি তার অবস্থা।মনে মনে বলল,
‘ চির চেনা এই সভ্য পুরুষ মোটেও সভ্য নয়!’

ফায়াদ অপরাজিতাকে পৌঁছে দিয়ে সাথে সাথে বাসায় গেলো না। বেশ খানিকটা ড্রাইভিং করে তারপর বাসায় গেল। তার মাথায় যেন শাড়িতে জড়ানো বৃষ্টি কন্যা ঘুরছে। একটা প্রবাদ শুনেছিল,’শাড়িতে নারি’। তার সত্যতা যেন আজ দেখেছে ফায়াদ। পুচকি সেই মেয়েটা আজ প্রেমিকা রূপে ফায়াদের মন ভুলাতে এসেছিল। কিন্তু সে কি জানে সে যে ফায়াদকে সম্মোহন করে ফেলেছে! মনটা যেন আজ একেবারেই অবাধ্য হতে বলছিল তাকে।
বাসায় পৌছানোর পর পরই ফায়াদ কাপড় চেঞ্জ করে ফেলল। ফারদিন আহমেদ আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছেন অফিস থেকে। বৃষ্টির মৌসুমে বাসায় বসে টিভি দেখা আর পাকোড়া খাওয়া টা দারুন এনজয় করেন তিনি।
ফায়াদ বাবা-মায়ের রুমের দরজায় নক করলো। আখি বেগম অনুমতি দিলেন,
‘আয়’

ফায়াদ ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো দুজনেই মুভি দেখতে ব্যস্ত। দুষ্টুমি করে বলল,
‘কাপলদের অসময়ে ডিস্টার্ব করলাম নাকি?’

আখি বেগম কোলের বালিশ টা ছুড়ে মারলেন ছেলের মুখে।ফায়াদ ক্যাচ ধরে ফেলল। মায়ের দিয়ে দেখে হাসছে সে। তার বাবা লজ্জা না পেলেও মা এখনো লজ্জা পায় ছোট ছোট ব্যাপারএ। ফারাজ আগে কোনো সুযোগ ছাড়তো না।এখন ফারাজের হয়ে ফায়াদ মাঝেমধ্যেই এরকম করে থাকে। আখি বেগম চোখ রাঙালেন ফায়াদকে।
‘অসভ্য ছেলে!’

ফারদিন আহমেদ পাকোড়া মুখে দিয়ে আফসোস এর সুরে বললেন,
‘কতো সুন্দর বৃষ্টি বাহিরে, শান্তি ময় এক আবহাওয়া অথচ তোমার বউ নেই। আহারে!’

ফায়াদ হাসলো।বাবা তাকে খোচানোর চেষ্টায় আছে সে বুঝতে পেরেছে।মাথা চুলকে বলল,
‘বউ লাগবে এজন্যই তো বাবা-মায়ের কাছে আসলাম’

ফারদিন আহমেদ বললেন,
‘ওহ আচ্ছ—কি??’

সাথে সাথে টিভি অফ করে দিলেন তিনি। পুরো মনোযোগ ছেলের দিকে দিয়ে বললেন,
‘বিয়ে করবে বলছো?’

ফায়াদ বিছানার সাইডে আয়েশ করে বলল,
‘করবো না কেন?’

এবার ফারদিন আহমেদ কে বলার সুযোগ না দিয়ে তার মুখে পাকোড়া গুজে দিয়ে আখি বেগম বললেন,
‘পুচকি ফুলকে?’

ফায়াদ কপালে হাত দিল।পুচকি ফুল শুনার পর থেকে সবাই শুধু এই নামেই বলে যাচ্ছে। কপাল থেকে হাত সরিয়ে ফায়াদ সঠিক করার মতো করে বলল,
‘পুচকি ফুল নয় মা। ওর নাম অপরাজিতা।’

‘ নামটা তো ফুলই দেখছি।’

ফারদিন আহমেদ ভাবছেন। নামটা চেনা চেনা লাগছে উনার কাছে কিন্তু মনে করতে পারছেন না উনি। পাকোড়া চিবুতে চিবুতে ছেলেকে বললেন,
‘মেয়েটাকে কি আমরা চিনি? নামটা চেনা চেনা লাগছে কেন বলতো?’

ফায়াদ কিছুটা লুকিয়ে চুড়িয়ে বলল,
‘চেনো আসলে। আসিফ আঙ্কেল এর মেয়ে!’

শুনে ফারদিন আহমেদ অবাক হলেন। চোখ বড় বড় করে স্ত্রীকে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
‘দেখেছো? কত বড় চোর তোমার ছেলে! আমাদের চোখের সামনে দিয়ে প্রেম করছিল!’

ফায়াদ কানে হাত দিল। আখি বেগমও অবাক হলেন।
ফায়াদ আবার বলল,
‘আমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি। বিয়ে করলে তাকেই করবো।’

বলে সে বের হয়ে গেল রুম থেকে। ভাবনায় রেখে গেল মা বাবা কে। আপাতত সে কোনো জেরার সম্মুখীন হতে চাচ্ছে না। সে জানে এখন মা-বাবা যা করার করবে।
রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সারা দিনের ক্লান্তি যেন ভুলে গেল। আরাম এসে সারা দেহ জুড়ে স্থান দখল করেছে। চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসলো। অপরাজিতাকে ম্যাসেজ করে বলল,
‘একটা জ্বরের ট্যাবলেট খেয়ে নিও। আমাকে আজ আর কল দিও না। আমি ঘুমোতে গেলাম। তুমিও ঘুমাও খাওয়া দাওয়া করে। নতুন ভোরের জন্য অগ্রীম শুভেচ্ছা। হতে পারে নতুন কিছুর আগমন ঘটবে। শুভ রাত্রি ফুল!’

অপরাজিতা ফায়াদের সে ম্যাসেজ দেখলো অনেক পরে। সে রাতে আর কল করলো না সে।রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সারা দিনের স্মৃতি গুলো জমতে লাগলো চোখের পাতায়। ডুবে যাচ্ছে সে কল্পনার দুনিয়ায় ধীরে ধীরে।

————-

‘তো সব গোছগাছ শেষ?’

নীতি হাসলো।ফারাজ হাসি দেখে বলল,
‘কি ব্যাপার হাসছেন কেন?’

‘স্যার আপনাকে একটু খুশি খুশি লাগছে।’

ফারাজও এবার হেসে দিল।বলল,
‘তা বোধহয় লাগছে কারন আমি সত্যিই খুশি। অনেক বছর পর পরিবারকে দেখবো এজন্য হয়তো।’

‘তাহলে পরশু সত্যিই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি আমরা?’

‘ইয়েস’

নীতি দ্বিধা নিয়ে বলল,
‘স্যার আমার যাওয়া টা কি ঠিক! মানে আমি গিয়ে কি করবো সেখানে?’

ফারাজ নীতির কপালে টোকা দিয়ে বলল,
‘আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট এর দায়িত্ব পালন করবেন।এবং বন্ধুরও।’

নীতি কপাল ঘষতে ঘষতে বলল,
‘বাংলাদেশে অ্যাসিস্ট্যান্ট কিসের?’

ফারাজ মেকি হেসে নাটকীয়ভাবে বলল,
‘কারন আমি জানি বাংলাদেশ গেলে বাবার বিজনেস আমাকেই দেখতে হবে। উনি আমাকে দেখে আলসেমির রাজা সাজবে। তাই সে প্রস্তুতি নিয়েই যাবো।’

নীতি হেসে দিল ফারাজের বলার ভঙ্গিমা দেখে। জিজ্ঞেস করলো,
‘এখানের কাজের কি হবে?’

‘এখানের লোকেরা দেখবে। আমি এসে মাঝেমধ্যে দেখে যাবো।’

‘ওহ’

‘আপনি এবার ভাবাভাবি বাদ দিয়ে এক কাপ কফি এনে দিন আমাকে। অনেক কাজ! ‘

নীতি গেলো কফি আনতে। ফারাজ কাজে ডুবে গেলো। সে আসলে কাজে ডুবে যেতে চাচ্ছে। কিছু স্মৃতি আছে যারা ফারাজকে দুর্বল করতে চাচ্ছে। কিন্তু ফারাজ এগিয়ে যেতে চায়। স্মৃতিরগুলোকে আকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিকে। বাংলাদেশ!! মায়ের দেশ। তার দেশ! হয়তো নতুন কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য!

———————-

সকাল বেলা হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে নিলেই বাধা দেন আখি বেগম। ফায়াদকে সোফায় বসিয়ে চা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘আজ কোথাও যাবি না।আমরা মেয়ে দেখতে যাবো।’

‘ওয়াট!!’

‘জি’

‘এতো জলদি কিভাবে কি? ম্যানেজ কিভাবে করলা।’

আখি বেগম হেসে দিলেন। বললেন,
‘তোর বাবার সাথে আসিফ ভাইয়ের সম্পর্ক ভালো। ব্যবসায়িক কাজের ক্ষেত্রে অনেক পরামর্শ করেন তারা প্রায়ই!’

ফায়াদ ভ্রু কুচকে বলল,
‘তারপর?’

‘তারপর সে কাল রাতেই তোর পুচকি ফুলের বাবা কে ফোন দিয়েছে। বেশ অনেক্ষন আড্ডা দিয়েছেন তারা।অনেক রাত অবধি কথা বলেছেন দুজনে। এক পর্যায়ে তোর কথা বলল। পুচকি ফুলকে নিজের মেয়ে করে নিয়ে আসতে চায় হ্যান ত্যান আকড়ুম বাকড়ুম আরো কতো কি!’

ফায়াদ আবারো তার মা কে শুধরে দিতে চাইলো,
‘অপরাজিতা অপরাজিতা!’

আখি বেগম হালকা ধমকে উঠলেন,
‘আরে রাখতো অপরাজিতা। আমার পুচকি ফুল নামটা অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি এটাই ডাকবো।’

ফায়াদের নিজের মাথার চুল নিজের ছিড়তে মন চাচ্ছে। কারন সে না ছিড়লেও অপরাজিতা ছিড়বে যখন সে জানতে পারবে তার এই নামের কথা।

ফায়াদ তারপর জিজ্ঞেস করলো,
‘তারপর?’

‘তারপর তোর জন্য প্লাস পয়েন্ট হলো আসিফ ভাই তোকে খুব পছন্দ করেন৷আর.. ‘
তারপর চোখ গুলো ছোট ছোট করে বলল,
‘তুই নাকি তাদের কয়েকমাস আগেও হাসপাতালে সাহায্য করেছিলি? কই আমি তো কিছু জানি না’

ফায়াদ চুরি ধরা পড়েছে ধরনের হাসি দিল। তারপর বলল,
‘আংকেল এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেল?’

‘তোর বাপ কথার ওস্তাদ।রাজি আবার না হবে! তার নাকি তর সইছে না তোর বিয়ে করানোর জন্য।এবার তুই রুমে যা। হাসপাতাল আজকে যাওয়া হবে না।আমরা দুপুরের পর পর রওনা দিব।’

ফায়াদকে ঠেলে ঠুলে রুমে পাঠিয়ে দিল। ফায়াদ ভাবে নি যে একদিনের মধ্যে তার বাবা এমন খেল দেখাবে।

অপরাজিতাকে তার মা এই দেখতে আসার কথা বলার পর থেকে অপরাজিতা মায়ের সাথে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে।তার শুধু কান্না করা বাকি। বিয়ে তো সে অন্য কাউকে করবেই না। কখনোই না!!

‘তুমি কি এখন আমাকে জোর করে বিয়ে দিবা?’

‘জোর করে বিয়ে দিব কেন? বিয়ে তো দিচ্ছি না। তারা শুধু তোকে দেখতে চাচ্ছে।’

অপরাজিতা নাকমুখ কুচকে বলল,
‘আমি কি শোপিস?’

রামিসা বেগম এবার ধমকে উঠলেন,
‘বেশি হচ্ছে এখন!এমন কেন করতেছিস বুঝতেছি তো আমি। তোকে যে আমি বললাম তোর পছন্দের ছেলে কে আমার সাথে দেখা করতে বলতে, কই সে ছেলে?আসলো তো না।’

মায়ের ধমক শুনে অপরাজিতার কান্না আসছে। খুব কষ্টে কান্না আটকে আছে সে। যার দরুন তার সমগ্র মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।মেয়ের মুখ দেখে রামিসা একটু নরম হলেন।বললেন,
‘তোর বাবার একজন পরিচিত মানুষ। ছেলেটাকেও তোর বাবা পছন্দ করে। তারা আসুক। আসলেই তো বিয়ে হয়ে যাবে না। তারা তোকে দেখতে আসবে। এমন করে বলল যে তোর বাবা মানা করতে পারে নি। আর ছেলেকে তুই চিনিস।তাই এখন কোনো আপত্তি করিস না মা আমার। ‘

অপরাজিতা আর কিছু না বলে রুমে এসে পড়লো। কল লাগালো ফায়াদকে। তার জিদ উঠছে এই ডাক্তারের উপর। কেন তার মার সাথে দেখা করতে আসলো না?

ফায়াদ ফোন ধরে কিছু বলার আগেই অপরাজিতা বলল,
‘আমাকে অন্য ছেলে দেখতে আসছে আর আপনি শুধু রোগীই দেখেন।আমাকে আর দেখা লাগবে না।রোগীকেই বিয়ে করেন তারপর ওটারেই চিকিৎসা দেন সারাজীবন!’

ফায়াদকে কিছু বলার সুযোগ ই দিল না। ফায়াদ বলল,
‘শ্বাস নাও আগে। তারপর বলো। দেখতে আসছে বলতে?’

অপরাজিতা নিজেকে বহু কসরত করে সামলে বলল,
‘পাত্রী দেখা বুঝেন? আমাকে দেখতে আসবে আজকে।’

‘ওওওওওও’

ফায়াদ বুঝতে পারলো অপরাজিতা পাত্রর ব্যাপারে কিছু জানে না এখনো।ফায়াদের স্বাভাবিক কন্ঠ শুনে অপরাজিতার মেজাজ গরম হলো।চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ওও মানে কি হ্যা?আপনি আমার মার সাথে দেখা করেন নি কেন? এখন আমি কি করবো?’

‘তুমি ছেলেকে চিনো?৷ যে আসবে তোমাকে দেখতে।’

‘মা বলল চিনি। আর আমাকে বুঝ দিচ্ছে দেখতে আসলে নাকি বিয়ে হয়ে যায় না।’

ফায়াদ ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘হ্যা ঠিকই বলেছে। আর হলে হবে। করবা বিয়ে!’

অপরাজিতার এবার যেন মেজাজের বারোটা বাজলো।রাগে জিদে চিল্লিয়ে বলল,
‘করবা মানে? হ্যা? আমি কি পুতুল? বিয়ে তো আমি আপনাকেই করবো।এতো সহজ আমি? আর আমি বলে রাখলাম যে ছেলে আসবে তার মাথা যদি না ফাটা’ইছি আমি! আপনারও খবর করে ছাড়বো দেইখেন!’

বলে খট করে ফোনটা কেটে দিল। ফায়াদ কান থেকে ফোনটা সরিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বিরবির করলো,
‘সাংঘাতিক!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here