#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৮)
মাঝ রাতে কান্নার শব্দে ছুটে এল অভিরাজ। উষশী খুব করে কান্না করছে। ছেলেটা ছুটে এসে বলল,”কি হয়েছে? কান্না করছো কেন?”
“কোকো, কোকো সাড়া দিচ্ছে না।”
“কোথায় দেখি।”
“ঘরে আছে। আমার কোকো কথা বলছে না। ওর কি হলো।”
অভিরাজ দেখল কোকো একটা কম্বলের নিচে শুয়ে আছে। বিশেষ কোনো নড়চড় নেই। সে বুঝতে পারল না। লাবণ্য ও চলে এসেছে। কোকোর শরীর ঠান্ডা। মুখের কাছটায় কিছু লেগে আছে। লাবণ্য সেটা স্পর্শ করে বলল,”হে আল্লাহ কোনো কেমিক্যাল খেয়ে নেয় নি তো।”
কথাটা শোনা মাত্র দিশেহারা হয়ে পড়ল উষশী। ছুটে এসে কোকো কে জড়িয়ে ধরল। ওর কান্না বেড়ে যাচ্ছে। অভি দ্রুত গাড়ি বের করতে বলে কোকোকে কোলে নিল।
“কোকো, আমার কোকো কে দিন আমার কাছে। কি হয়ে গেল। কোকো, কথা বলো।”
লাবণ্য উষশীকে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা কেঁদে চোখ মুখের যা তা অবস্থা করে ফেলেছে।
“কিচ্ছু হবে না। আমরা ওকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।”
কাছেই পশুপাখি হসপিটাল। সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার চেকাপ করে বললেন কোনো কেমিক্যাল খেয়ে কোকো চেতনা হারিয়েছে। খুব বেশি সময় হয় নি বিধায় কোকোর প্রাণটা এ যাত্রায় রক্ষা পেল। উষশী বাইরে বসে রইল। নিস্তেজ তার দৃষ্টি। ওকে দেখে অভির বুকটা পু ড় তে লাগল।
“ঠিক হয়ে যাবে।”
নিরুত্তর উষশী এবার দু চোখ জলে ভিজিয়ে দিল। এই মেয়ের কান্নার তোপ বেড়েই চলেছে। মেয়েটির মাথাটা বুকে চেপে ধরল অভি। কেন এমন করল সে বুঝতে পারল না। শুধু মনে হলো এই বুকে উষশী’র জন্য এক সাগর প্রশান্তি জমে।
কোকোকে চেকাপে রাখা দরকার। ডাক্তার বলেছে দুদিন পর নিয়ে যেতে। উষশী এখানে থেকে যেতে চাইল। এতে অবশ্য অভি খুব করে বিরোধ করল। হুট করেই বকা দিল। উষশী এবার ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,”আপনি কে ডিসিশন নেওয়ার?”
ছোট্ট বাক্যটি অভিরাজের টনক নাড়িয়ে দিল। সে সত্যিই এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। কিন্তু উষশী কথাটার পুনরাবৃত্তি করায় তার খুব রাগ হলো। মেয়েটির বাদামি চুল গুলো মুঠো ভরাট করে বলল,”আই এম ইউর শেল্টার।”
“খোঁটা দিচ্ছেন?”
“হ্যাঁ দিচ্ছি।”
“আমি থাকব না এখানে। চলে যাব।”
“থাকতে হবে।”
“আপনার কোনো রাইট নেই আমাকে আটকানোর।”
“যদি বলি আছে।”
“কে হন আপনি? নাথিং, কেউ হন না আমার। তাহলে কেন অধিকার দেখাচ্ছেন!”
“বদ মেয়ে তুমি।”
“আপনি বদ।”
“এই চুপ করবে।”
“করব না।”
“মা র খেতে চাও?”
“দেখি তো কত মা রতে পারেন।”
এগিয়ে এসে বলল উষশী। ওর কথাটা শেষ হতেই চুল ধরে টান দিল অভি। একই ভাবে অভিরাজের চুল গুলো টেনে ধরল উষশী। অভি এবার ওর গাল টেনে দিল। একই ভঙ্গিতে উষশী অগ্রসর হতেই লাবণ্য উপস্থিত হলো।
“আরে, কি করছিস তোরা!”
“আপু, ওনি আমাকে মে রে ছেন।”
“আর তুমি? তুমি কি করলে। আমার চুল গুলো সব ছিঁড়ে ফেলার প্ল্যান করেছিলে। আর নখের দাগ বসিয়ে ফেলেছ।”
“সব আপনার দোষ।”
“না তোমার।”
“আপনার।”
অভিকে থামিয়ে দিল লাবণ্য। উষশী মন খারাপ করে পাশে বসে রইল। অভি’র গলার কাছটায় নখের দাগ বসে গেছে। হতাশ হলো লাবণ্য। ছেলেটার গলায় আঙুলের স্পর্শ করে বলল,”অনেকখানি বসেছে। কতদিন থাকে কে জানে।”
উষশী আড়চোখে তাকাতেই দেখল অভি ওর দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। এতে মেয়েটা কিছুটা ভয় পেল। সে সত্যিই এমনটা করতে চায় নি।
বর্তমান
শার্ট খুলতেই অভিরাজের ফর্সা শরীরটা আয়নায় ভেসে উঠল। সে খুবই সুদর্শন পুরুষ। দীর্ঘদিন শরীরের যত্ন না নেওয়া সত্ত্বেও তার সৌন্দর্যে প্রভাব পড়ে নি। গলার কাছটার দাগ অনেকটাই কমে এসেছে। অভি নিজ হাতে সেটাকে ক্ষ ত করতে লাগল। সে চায় না এই স্মৃতি কখনো হারিয়ে যাক। উষশী তার হৃদয়ের সর্বত্র জুড়ে। কখনো মেয়েটার ছায়া মুছতে দিবে না সে। লাবণ্য এসে দেখল অভিরাজের গলার কাছে লাল তরল।
“কি করে হলো এটা। হায় আল্লাহ।”
লাবণ্য রঙিন তরলটা মুছতে যেতেই হাত ধরে ফেলল অভি। তার দৃষ্টির সাথে লাবণ্য’র দৃষ্টি মিলে গেল।
“এটা উষশীর স্মৃতি।”
“সারাক্ষণ ওর কথাই কেন মনে করিস অভি?”
“কারণ ও আমার ভালোবাসা।”
“আর আমি?”
“এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই লাবণ্য।”
চোখের কোণ থেকে জল মুছে নিল লাবণ্য। তার পুরো জীবনটাই অভিরাজের নামে উৎসর্গ হলো। অথচ ছেলেটা পুরো জীবন ভরে তাকে অবহেলা করল। সব কিছু তার হয়েও যেন হলো না।
অতীত
গাড়িতে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে উষশী। মেয়েটির মাথাটা অভি’র ঘাড়ের কাছে। কাঁধ সম চুল গুলো হাওয়ায় উড়ছে। তারা খুব করে পাঁয়তারা করছে অভিরাজকে স্পর্শ করার। দৈর্ঘ্য কম হওয়াতে বিশেষ লাভ করে উঠছে না। অভি এক পলক তাকিয়ে চোখ নামাল। উষশী’র ঘুমন্ত মুখ মারাত্মক সুন্দর। অভি’র নজর বার বার ঘুরে যাচ্ছে। সে একটা বিষয় ভেবে বড়ো বিচলিত বোধ করল। একটা সময় পর গাড়ি থামিয়ে দিল। সোডিয়ামের আলোয় চকচক করছে উষশীর মসৃণ শ্বেত রঙা গাল। অত্যন্ত সুন্দর এই মেয়েটিকে পরিপূর্ণ নারী মনে হলো ওর কাছে। সে নিজেকে খুব করে বিরোধ করল। তারপরই গাড়ি চলতে শুরু করল। উষশী নিজের ঘরে এসে বলল,”আমার কোকো’র যত্ন হচ্ছে তো?”
“হচ্ছে।”
“কেমন করে বুঝব?”
“তোমার জন্যেই তো লাবণ্যকে রেখে এলাম।”
“আপুকে কেন রেখে এলেন? আপনি থেকে যেতেন।”
“আমি কি ডাক্তার?”
“আপনি কি তাহলে?”
“কিছু না।”
“বলেন, আপনি কি করেন?”
“বেকার।”
“বেকার! আসলেই, তাহলে হসপিটালে অত ভাব নিচ্ছিলেন কেন?”
“কারণ ঐটা আমার বাবার হসপিটাল।”
“বাবার বলে ভাব নিবেন? আমি তো ভেবেছি আপনার।”
“আমার বাবার মানে তো আমারই হলো।”
“না। আপনার কেন হবে?”
অভি পর্দা গুলো সরিয়ে দিয়ে উষশীর দিকে তাকাল। উষশী বেডের উপর পা তুলে বসে আছে। গায়ে তার হাঁটুসম ফ্রক। এই বয়সী বাঙালি মেয়েরা সাধারণত কুর্তি, থ্রি পিস পরে থাকে। অন্যদিকে উষশী সর্বদা বাচ্চাদের মতো কাপড় পরে। দেশের ভিন্নতা কত কিছুর পরিবর্তন করে দেয়।
“ঘুমাও। শেষ রাত টুকু জেগে থেকো না। শরীর খারাপ করবে।”
“খারাপ করবে না। আর ঘুম ও আসছে না।”
“চেষ্টা করো।”
“হবে না।”
“হবে।”
“উহু।”
একাধিক বার বিপরীত জবাবে অভিরাজ ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলল। উষশী এখন আধশোয়া অবস্থায়। তাকে দেখতে ঠিক সদ্য কলি থেকে জেগে উঠা গোলাপ ফুলটির মতো লাগছে। যার পুরোটা জুড়েই মিষ্টি সুবাস আর কোমলতা। লাস্যময়ী এই কিশোরী অভিরাজের দৃষ্টিকে ধমকাচ্ছে।
“বৃষ্টি হচ্ছে না কেন?”
“কেমন করে জানব?”
“আমার বৃষ্টি দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“এত বাচ্চামো কোথায় পাও?”
“জানি না।” বলেই চুপ হয়ে গেল উষশী। সে এখন মুখে হাত দিয়ে আছে।
“উষশী।”
“হুম।”
“কিছু হয়েছে তোমার?”
“মম কে মনে পড়ছে।”
“খুঁজে দিব। তুমি তো পার্সপোর্টের ডাটা দিলে না। সারাক্ষণ রাগ করো। এত অবুঝদের মতো হলে চলবে?”
“আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। বড়ো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আচ্ছা যদি মম কে না পাওয়া যায় তখন কি হবে? আমাকে কি আপনাদের সাথে রাখবেন?”
উত্তর দেওয়ার পূর্বেই অভি’র ফোন বেজে উঠল। লাবণ্য’র কল পেয়ে চট করে রিসিভ করল সে।
“একটা গুড নিউজ আছে অভি।”
“কি?”
“মনে হচ্ছে উষশী’র বাড়ির ঠিকানা পেয়ে গেছি। কাল এসে সবটা জানাচ্ছি। উষশীকে এখনি কিছু বলিস না। আগে সিউর হয়ে নিই।”
নিউজটা শুনে এক বিন্দু খুশি হতে পারল না অভিরাজ। তার ভেতরটা ক্ষ ত হচ্ছে যেন। উষশী চোখ বন্ধ করে আছে। মাঝ রাতে তার উষ্ণ নিশ্বাস শোনা যাচ্ছে। অভি নিজের রুমে এসে বসে রইল। অশান্তি লাগছে বেশ। এদিক সেদিক ছুটতে শুরু করেছে। একটা সময় পর চুল গুলো মুঠোয় নিয়ে বসে রইল। হুট করে এতটা খারাপ লাগছে কেন তার?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি