“মেয়েটা আমি চোখে চোখেই রেখেছি। সন্ধার আগে স্টেশনে ট্রেন পৌছে যাবে। মেয়ে একদম আগুন সুন্দরী। যে যার যার অবস্থানে থাকবি। আজ রাতের পার্টিটা জমবে ভালো।”
লোকটা কাকে যেন ফোনে বিড়বিড় করে কথা গুলো বলে সামনের সীটে বইয়ের পাতায় দৃষ্টি রেখে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। লোকটার চাহুনিতে ক্ষনিকটা বিরক্তবোধ করলো ফারিহা। তবে এই চাহুনির আড়ালেও যে তার জন্য ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে, সেটা হয়তো এখনো আন্দাজ করতে পারেনি সে। লোকটার এমন দৃষ্টিতে কিছুটা বিরক্তিকর মুখ নিয়ে আবারও বইয়ের পাতায় দৃষ্টি রাখলো।
“আপনার টিকিট দেখি।”
ট্রেনের একটা অপরিচিত লোক টিকিট চাইতেই ফারিহা ব্যাগ থেকে টিকিট বের করে তার হাতে দিল। অন্য সীটের লোকটা এখনো অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফারিহার কাছে এবার কেমন যেন ভয়ানক মনে হলো সেই দৃষ্টি। কিছুক্ষণ আগে কাউকে ফোন দিয়ে কি যেন বলেছিল, তা শুনতে পায়নি সে। এখন সেটাও রহস্যজনক মনে হচ্ছে তার। মনে ভয়ও জন্ম নিলো ক্ষনিকটা। একা একা প্রথম ট্রেন ভ্রমনে এমন কিছুর সম্মুখীন হবে কে জানতো?
তার পাশে বসা আরেকটা ছেলে। দেখতে ভদ্রই মনে হচ্ছে তাকে। কানে এয়ারফোন লাগিয়ে বসে ছিল। সে ব্যাগ ও প্যান্টের পকেট তন্নতন্ন করে খুঁজেও নিজের টিকিটের কোনো হদিস পেলো না। তবুও ব্যাগে পুনরায় খোঁজার ফাঁকে টিকিট চেক করা লোকটার দিকে তাকিয়ে আবারও পেন্ট এর পকেট চেক করতে লাগলো।
ফারিহার দিকে চেয়ে টিকিট চেক করা লোকটা বলে,
“তিন সীটের টিকিট’ই কি আপনার?”
ফারিহা নমনিয় গলায় জবাব দিল,
“জ্বি।”
তাদের মাঝে কথা দীর্ঘায়িত হলো না। ফারিহা পূনরায় বই পড়ায় মন দিল। লোকটা তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
“আপনার টিকিট টা?”
তুষার বুঝতে পারছে না কি বলবে। তার সীটের পাশের রহস্যময় লোকটা টিকিট বের করে লোকটার হাতে দিল। কিন্তু তুষার নিজের টিকিটের খোঁজ পেলো না কোথাও।
বিষয়টা তাকে জানাতেই সে ক্ষনিকটা অন্যরকম দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমন করছেন?”
উত্তর দিতে পারলো না তুষার। সে এখনো বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে তার সাথে? টিকিট গেলো কোথায়? আর সে যাচ্ছেই বা কোথায়? আর কিছু ভাবার আগেই লোকটা পূনরায় বলে উঠে,
“বুঝতে পেরেছি। কমন কেস। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যান। সামনের স্টেশনেই নেমে যাবেন?”
লোকটাকে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো তুষার। কারণ কোথায় যাচ্ছে সেটা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটাকেই বা কি বলবে। এখন কি তাহলে সামনের কোনো অচেনা স্টেশনেই নেমে যেতে হবে?
এর মাঝে তার সামনের সীটে থাকা ফারিহা বলে উঠে,
“আসলে সে আমার কাজিন হয়। আমার তিন সীটের মাঝে এক সীট ওনার জন্য।”
লোকটা ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
“তাহলে এখানে বসেছে কেন? আর কিছু বলছেনাই না কেন?”
ফারিহা তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
“আসলে সে একটু আলাভোলা টাইপের। সবার সাথে কথা বলতে পারে না। বুঝতেই তো পারছেন কি বুঝাতে চাইছি।”
লোকটা কিছু একটা বুঝে নিয়ে তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
“এই যে ভাই, নিজের সীটে এসে বসুন।”
লোকটা চলে গেলো। কিছুটা অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো তুষার। মেয়েটা কেন তাকে হেল্প করছে, আর এবসই বা ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছে না। সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার।
মেয়েটার পাশে এসে বসে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ একটা ধন্যবাদ দিল। মেয়েটাও মুচকি হাসলো। কৌতূহল নিয়ে তুষার প্রশ্ন করে,
“আমাকে হেল্প করলেন কেন?”
তুষারের প্রশ্নে ফারিহা আড়চোখে একবার তাদের সাথে থাকা তৃতীয় লোকটার দিকে তাকালো। লোকটা এখনো ফারিহার দিকে মাঝে মাঝে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যার জন্য কিছুটা ভয় কাজ করছে তার মনে। কারণ লোকটাকে কোনো ভাবেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। এখন তুষারকে নামিয়ে দিলে সে লোকটার সাথে একা হয়ে যেত। না জানি কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হয় কি না। তাই ভয় কিছুটা কমাতে তুষারকে হেল্প করলো সে।
তুষার উত্তরের আশায় চেয়ে থাকলে ফারিহা লোকটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
“কেউ বিপদে পড়লে মানুষ হিসেবে তাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য মনে করলাম তাই।”
“নাম কি আপনার?”
ফারিহা ভ্রু কুচকে বলে,
“ক্ষনিকের এই পরিচয়ে নাম জানা কি খুব দরকার?”
“কারো দ্বারা আমার উপকার হলে তাকে আমি কখনো ভুলি না। তাই নাম জেনে রাখা ভালো। যেন কখনো দেখা হলে ঋণ শোধ করে দিতে পারি।”
ফারিহা কিছুটা হেসে বলে,
“ঋণ শোধ করার দরকার নেই। তাছাড়া মনে হয় না আবার দেখা হবে। আচ্ছা যাই হোক, আমি ফারিহা।”
“আমি তুষার।”
সৌজন্যমূলক একটা হাসি দিল ফারিহা। পূনরায় বইয়ের পাতায় দৃষ্টি রাখলো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে তুষার আবার প্রশ্ন করে,
” আচ্ছা এই ট্রেন কোথায় যাচ্ছে?”
ফারিহা বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই ছোট্ট করে জবাব দেয়,
“খুলনা।”
“আপনার বাসা খুলনা?”
“হুম।”
নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তুষারের মাথায়। তার মানে তো সেও খুলনা যাচ্ছে। খুলনায় তার কাজ কি? তার তো ঢাকায় থাকার কথা। এখানে আসলো কি করে?
অনেক সময় কেটে গেলো। ট্রেন থেমে গেলো। ফারিহাও নেমে গেলো ট্রেন থেকে। তুষার বাইরের দিকে তাকালো। হয়তো খুলনা চলে এসেছে তারা। সেও দ্রুত ব্যাগ কাধে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। কিছুটা দৌড়ে ফারিহার পাশে এসে দাড়ালো সে।
আড়াল থেকে কেউ একজন তাদের দিকে চেয়ে ফোনে ফিসফিস করে বলে,
“বস, মেয়েটা তো একা আসেনি। তার পাশে একটা ছেলেও আছে।”
ফোনের অপর প্রান্তে থাকা লোকটা বলে,
“এমনটা হওয়ার কথা না। একটু অপেক্ষা কর। দেখ বিষয়টা কি। তারপর আমাকে জানাবি।”
“আচ্ছা।”
কথা শেষ হতেই ফোন রেখে দিল সে। তুষার ও ফারিহাকে এক নজর চেয়ে নিজেকে আড়াল করে নিল সে।
ফারিহার পাশে এসে দাড়িয়ে তুষার বলে,
“আপনার টিকিটের দাম কত?”
ফারিহা তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কেন?”
“আমি কারো কাছে ঋণী থাকতে পছন্দ করি না। কেমন যেন অপরাধী মনে হয় নিজেকে। দাড়ান আপনার টিকিটের টাকা দিয়ে দিচ্ছি।”
বলেই নিজের মানিব্যাগ টা বের করে তুষার। আজব তো, মানিব্যাগে একটা টাকাও নেই কেন? ভালো করে দেখে এবার ব্যাগ চেক করেও একটা টাকা বের করতে পারলো না সে। পাশ থেকে ফারিহা হেসে বলে,
“আচ্ছা, পরে আমার ভাইয়াকে দিয়ে দিবেন টাকা টা। তাহলে আর আপনার নিজেকে ঋণী মনে হবে না।”
তুষার তার দিকে চেয়ে বলে,
“আপনার ভাইয়াকে কোথায় পাবো?”
“সে সব সময় আপনার সাথেই থাকে।”
“কে সে!”
“আপনার বন্ধু নিবিড়। সেই আমার ফাহাদ ভাইয়া।”
“ফাহাদ!”
“হুম তার আরেক নাম। আচ্ছা আমি আসি। ভালো থাকবেন।”
বিদায় নিয়ে চলে গেলো ফারিহা। ঠায় দাড়িয়ে রইল তুষার। সে যতদুর জানে নিবিড়ের কোনো বোন নেই। এমনকি তার কোনো পরিবারও নেই। নিবিড়ের বাবা-মা কে, সেটাও জানেনা নিবিড়। ছোট বেলা থেকেই একা বড়ো হয়েছে সে। আর এই মেয়ে বলছে, সে নিবিড়ের বোন। কিছুই মাথায় আসছে না তুষারের।
নিবিড়কে জিজ্ঞেস করতে হবে এটা। ফোন বের করে নিবিড়ের নাম্বার খুঁজতে লাগলো সে। আজব নাম্বার টা কোথায় গেলো? হটাৎ ই বিস্মিত হলো সে। আরে, নিবিড়ের নাম্বার ফাহাদ নামে সেভ করা কেন? ফোন দিলেও বলছে, এই নাম্বার টা আর ব্যাবহিত হচ্ছে না। অথচ নিবিড়ের সিম সব সময় চালু থাকে।
এসব কি হচ্ছে? মাথাটা ঘুরছে তার।
আচমকাই মাথাটা খুব ভাড়ি হয়ে অচেতন হয়ে ঢলে পড়লো সে।
,
,
চোখ খুলতেই নিজেকে রুমে আবিষ্কার করলো। পাশে নিবিড় বসে আছে। তার কিছুটা সামনে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে রেজোয়ান। কিছুদিন আগে লোকটা রাজের সাথে এই বাসায় এসেছিল। একটা প্রয়োজনে কয়েকদিন এখানে থাকবে। রাজ এমনটাই বলেছে। তাছাড়া গত তিন দিন হলো রাজ ও রুশান দুজন কোনো এক কাজে বের হয়েছে। যাওয়ার আগে শুধু বললো, পনেরো-বিশ দিন আর বাসায় ফেরা হবে না। এরা দু’জন যে কখন কি করে তা বোঝা বড়ো দ্বায়। বুঝবেই বা কি করে, এসব তাদের গোপন বিষয়। শুধু এতটুকুই জানে, তাদের ফিরতে আরো চৌদ্দ-পনেরো দিন আছে।
মাথাটা ধরে আছে তুষারের। উঠে বসে নিবিড়ের দিকে চেয়ে বলে,
“এখানে এলাম কি করে আমি?”
“তো কোথায় থাকার কথা তোর?”
“খুলনা ছিলাম আমি। সাথে তোর বোন, কি যেন নাম,,, ওহ্ হ্যাঁ ফারিহাও ছিল।”
নিবিড় অনেকটা অবাক হয়ে বলে,
“আমার বোন মানে! আমার আবার বোন ছিল কোন কালে? ঘুমের ঘোরে কিসব উল্টাপাল্টা বকছিস? যা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।”
“আরে না, ছিল সে। আমি খুলনাতেই ছিলাম। যাওয়ার পথে আমার কাছে টিকিট ছিল না। সে সাহায্য করেছে আমাকে। বললো, টিকিটের দাম তোর কাছে দিয়ে দিতে।”
নিবিড় একটু হতাশ হয়ে বলে,
“সবই তোর স্বপ্ন ছিল।”
তুষার পূনরায় অস্বীকার করে বলে,
“স্বপ্ন হয় এলোমেলো। বাট আমার বিষয়টা পুরোটাই গোছানো।”
নিবিড় আর এসব আজাইরা কথাবার্তা খুব একটা গুরুত্ব দিল না। ঘুম থেকে উঠে এই ছেলে এখন আমার মাথাটাও খাবে। ভেবেই উঠে চলে গেলো সেখান থেকে।
তুষার হতাশ হয়ে পাশে বসে থাকা রেজোয়ানের দিকে তাকালো। রেজোয়ান রহস্যজনক একটা হাসি দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“আবার ঘুমিয়ে পরুন। নির্দিষ্ট সময়ের পর রহস্য উন্মোচন হবে।”
কিছুই বুঝলো না তুষার। ভাবতে ভাবতে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো সে। আজব, আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসছেই বা কি করে?
হারিয়ে গেলো আবার সেই জায়গাটায়।
চোখে মুখে পানির ছিটা পড়তেই জেগে উঠে তুষার। দেখে ওখানেই পড়ে আছে, যেখানে ট্রেন থেকে নেমে অচেতন হয়ে পড়েছিল। আর তার সামনে ফারিহা নামক সেই মেয়েটা একটা বোতল হাতে বসে আছে। হয়তো এই বোতল থেকেই পানি ছিটিয়ে ছিল মুখে। মেয়েটা তার দিকে চেয়ে বলে,
“সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন কেন? শরির খারাপ?”
তুষার উত্তর দিল না। অপলক তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। মুহুর্তেই নিবিড়ের কথা মনে পড়লো তার। সে বলেছিল এসব স্বপ্ন। তাহলে সে কি এখনো স্বপ্নের মাঝে আছে? কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়লো তুষারের। সত্যিই কি এই মেয়েটার কোনো অস্তিত্ব নেই? মেয়েটা রুমাল বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“মুখ মুছে নিন।”
অস্তিত্বহীন মেয়ে শব্দটা মাথায় আসলে তুষার আচমকাই ফারিহার দিকে চেয়ে বলে উঠে,
“আচ্ছা আপনার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি?”
To be continue………….
#রহস্যময়_ঘোর (পর্ব ১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
~ আসসালামু আলাইকুম। অনেক দিন পর আবার গল্প নিয়ে আসলাম। ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। আপনাদের রেসপন্সে লেখার আগ্রহ অনেকটাই বেড়ে যায়।💖