কলেজে বিদ্যা অর্জন করতে আসো? নাকি ভ্রমণ করতে আসো? তোমাদের মতো কিছু স্টুডেন্ট আছে। যারা কলেজে আসবে ঠিকি। কিন্তু ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কলেজ প্রাঙ্গণে বসে আড্ডা দিবে। বাসায় গিয়ে বাবা-মাকে বুঝ দিতে হবে। এর জন্য দু’চারটা ক্লাস করতে হবে। কখন কোন ক্লাস হয়? সেটা তো জানো না। কখন কোন পিরিয়ডে কোন স্যার ক্লাস শেষ করে বের হয়ে যাচ্ছে। এটাও জানো না। আড্ডায় এত মগ্ন থাকো। যে স্যার ক্লাস রুমে দশ মিনিট আগে প্রবেশ করেছে। সেদিকে তোমাদের কোনো হুস থাকে না। আমার ক্লাস করতে হলে, সময়ের আগে ক্লাস রুমে প্রবেশ করতে হবে। আমার ক্লাসে এক সেকেন্ড দেরি করলে আসলে। আমার ক্লাসে প্রবেশ করার দরকার নেই। যে স্টুডেন্ট টাইম মেইনটেইন করতে চলতে পারে না। এমন স্টুডেন্ট আমার লাগবে না। এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে, আমার ক্লাসের সামনে থেকে সরে যাও। তোমার জন্য সবার সমস্যা হচ্ছে।
নিজের পদার্থ বিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকের কাছে, এমন কথা শুনে অপমানে মুখটা চুপসে গেল স্মৃতির। আজকে রাস্তায় অতিরিক্ত জ্যাম থাকায় আসতে দেরি হয়েছে। সে কখনো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেয় না। ক্লাসে নতুন শিক্ষককে দেখে একটু ভরকাল বটে। মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাস রুমে সামনে। সবাই স্মৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। স্মৃতি কণ্ঠস্বর নিম্ন করে বলল।
–স্যার আজকে রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। তাই আসতে দেরি হয়েছে। আমি কখনো ক্লাস মিস দেই না। আপনি চাইলে হাজিরা খাতায় আমার উপস্থিতি দেখতে পারেন? আরাভ হোয়াইট বোর্ডে লিখে তাপ গতিবিদ্যার অধ্যায়টি সবাইকে বোঝাচ্ছিল। স্মৃতির কথায় হাতজোড়া থেমে গেল। চক্ষুদ্বয় জোড়া স্মৃতির দিকে স্থির হলো। আরাভের দৃষ্টি নিজের দিকে দেখে হৃদস্পন্দনে কম্পন সৃষ্টি হলো। মৃদুভাবে পুরো শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। স্মৃতির কথা শুনে সবাই মৃদুস্বরে বলে উঠলো।
–স্যার স্মৃতি সত্য কথা বলছে। স্মৃতি কখনো ক্লাসে দেরি করে আছে না। সবার কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই আরাভ সবার দিকে দৃষ্টিপাত করল। আরাভের নজর সবার ওপরে পড়তেই সবাই মাথা নুইয়ে নিল। আরাভ গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
–মানুষের কয়টা হাত জানো তোমরা? আরাভের কথায় সবাই আরাভের দিকে দৃষ্টিপাত করল। একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো দুইটা। সবার কথা শুনে আরাভ গম্ভীর মুখ করে বলল।
–তোমরা সবাই জানো মানুষের হাত দু’টো। কিন্তু আমি জানি মানুষের হাত তিনটে। আরাভের কথা শুনে, সবাই হতভম্ব হয়ে আরাভের দিকে নজর আটলো। আরাভ বেশ বুঝলো। তার কথায় সবাই যথেষ্ট অবাক হয়েছে। সবাই আরাভের মুখপানে চেয়ে আছে। মানুষের তৃতীয় হাতটা কোথায়? এটা জানার জন্য। আরাভ নিজের অবস্থান বিদ্যামান রেখে, বলতে শুরু করল।
–এই যে দেখছে এটা আমার ডান হাত। আর এটা আমার বাম হাত। তোমাদের ধারণা ঠিক আছে। মানুষের দু’টো হাত। কিন্তু আমি তোমাদের এখন তৃতীয় হাতের কথা বলবো। যে হাত দেখা যায় না। কিন্তু আমরা বেশিভাগ ক্ষেত্রেই এই হাতটা ব্যবহার করে থাকি। আরাভের কথায় সবাই অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। টান টান উত্তেজনা চলছে সবার মাঝে। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আরাভ বলল।
–আমাদের তৃতীয় হাতটি হলো অজুহাত। যা আমরা কমবেশি সবাই ব্যবহার করে থাকি। এই অজুহাত ব্যবহার করা আমি একদম পছন্দ করি না। তাই আমার ক্লাসের সময় নষ্ট না করে, এখানে থেকে চলে যাও। কাল থেকে সঠিক সময়ে ক্লাসে আসতে পারলে, আমার ক্লাসে আসবে। না হলে আমার ক্লাসে আসার প্রয়োজন নেই। তোমার জন্য বাকিদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। আরাভের কথা শুনে স্মৃতি আর এক মুহুর্ত বিলম্ব করল না৷ দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। স্যারের প্রতি মনে ভিষণ ক্ষোভ জমেছে। কলেজে আরো কতজন শিক্ষক আছে। একটু দেরি করলে আসলে এমন ব্যবহার করে না। তোহাস স্যারের বদলে অন্য স্যার ক্লাস নিবে, এই কথা আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে একটা বার জানালো না। ভিষণ অভিমান হলো স্মৃতির। সে কমন রুমের দিকে অগ্রসর হলো। কমন রুমে এসে, এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে।
স্মৃতি চলে যেতেই আরাভ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল।
–অন্য শিক্ষকরা কি করে?তা আমি জানিনা। কিন্তু আমার ক্লাসে এক সেকেন্ড দেরি হলে, আমি আমার ক্লাসে প্রবেশ করতে দিব না। আমার প্রতিটি ক্লাসে সকলে উপস্থিত থাকতে হবে, যাদের উপস্থিতি কম হবে। আমি তাদের প্র্যাকটিক্যাল মার্ক দিব না। কথা গুলো চলেই পড়ানো শুরু করল।
রোহান, মেঘ, মারিয়া, মেঘলা, রাফিন, তোহা ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে স্মৃতিকে খুঁজতে শুরু করল। পুরো কলেজ প্রাঙ্গণ খুঁজে শেষ করে ফেলছে। কোথাও স্মৃতির দেখা মেলেনি। হঠাৎ করেই মেঘলা বলে উঠলো।
–আমার মনে হয় স্মৃতি কমন রুমে আছে। স্মৃতির যখন ভিষণ মন খারাপ হয়। তখন সে কমন রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। মেঘলার সাথে মেয়েরা সবাই চলে গেল। ছেলেরা বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্মৃতি একাই কমন রুম থেকে বেড়িয়ে জীব বিজ্ঞান ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। স্মৃতির পেছনে মেঘলা, তোহা, মারিয়া ও রয়েছে। সবাই স্মৃতির সাথে ক্লাস রুমে প্রবেশ করল। ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথে স্মৃতি রুম থেকে বেড়িয়ে বাসার উদ্দেশ্য যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। স্মৃতির পথ আটকে দাঁড়ালো তার বন্ধু মহল। স্মৃতি মুখ অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তোহা চেচিয়ে বলল।
–এভাবে আমাদের সাথে রাগ দেখাচ্ছিস কেনো? দোষ তুই করেছিস। আবার রাগও দেখাচ্ছিস। এমন ভাব করছিস। যেনো আমরা কোনো বড় অপরাধ করে ফেলছি। তোহার কথা কর্নপাত হতেই চক্ষুদ্বয় জোড়া মেলে তোহার দিকে তাকালো। স্মৃতির দৃষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত হতেই চুপ হয়ে গেল তোহা। মেঘলা রাগান্বিত হয়ে বলল।
–নিজের ফোন খানা একটু বের করে দেখ তো? কতগুলো কল, কতগুলো মেসেজ তোকে করা হয়েছে। আমাদের মানুষ বলে মনে হয় না। তুই সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবি। ফোনের ধারে কাছে আসবি না। তার দায় আমরা কেনো নিব? রাগ খালি তোর নেই। আমাদেরও আছে। একবার নিজের ফোন বের করে দেখ। তারপরে রাগ দেখাবি। কথা গুলো বলেই সবাইকে নিয়ে চলে যেতে লাগলো মেঘলা। স্মৃতি ফোন বের করল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ পড়তেই চক্ষুদ্বয় জোড়া ললাটে উঠে গেল। দ্রুত গতিতে তার বন্ধু মহলের দিকে ছুটে গেল। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল।
–আজকে আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে। তোহাস স্যার বলেছিল। আজকে পরীক্ষা নিবে। তাই রাত জেগে পড়াশোনা করেছি। আমি জানতাম না আজকে নতুন টিচার আসবে। মারিয়া চেচিয়ে বলল।
–তুই কোনোদিন আমাদের কোনো সাহায্য করিস নাই। কলেজের সকল খবর আমরা তোকে ইনফর্ম করি৷ তাই তোর মুখে এত বড় বড় কথা মানায় না। তোর পড়াশোনা আছে। আর আমাদের পড়াশোনা নেই। আমরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে, সারাদিন তোর পেছনে পড়ে থাকবো। মারিয়ার কথা শুনে মেঘলা রাগান্বিত হয়ে বলল।
–তুই ওর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেনো? সেখানে অধিকার আছে। সেখানে রাগ থাকবেই। তুই স্মৃতির সাথে এমন ব্যবহার করতে পারিস না। মেঘলার কথা কর্নপাত হতেই মারিয়া ফুঁসে উঠলো।
–স্মৃতি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই ওর সবকিছু সহ্য করতে পারিস। কিন্তু আমি স্মৃতির সবকিছু সহ্য করতে পারবো না। স্মৃতি এতক্ষণে চুপচাপ মারিয়ার কথা গুলো মনযোগ দিয়ে শুনছিল। নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলো।
–কাউকে কল দেওয়ার জন্য ফোনের টাকার প্রয়োজন হয়৷ তোর মতো মেয়ে মাসে ফোনে কয় টাকা তুলে? তুই আমাকে এত বড় বড় কথা শোনাচ্ছিস। তোর ফোন থেকে আমার ফোনে কয়টা কল আসছে। আমার ফোনে ৯৯+ কল আর মেসেজ আসছে। সবগুলো রোহান, মেঘ, মেঘলার ফোন থেকে, তারা আমাকে এত কথা শোনাচ্ছে না। তাহলে তুই কি করে আমাকে এত কথা শোনাতে পারিস? আগে কথা শোনানোর মতো যোগ্যতা অর্জন কর। তারপরে আমাকে কথা শোনাতে আসবি। আজকাল তুই একটু আমাকে বেশিই কথা শোনাচ্ছিস। তুই ভুলে যাস না। তুই কোথায় ছিলি। আমি তোকে কথায় নিয়ে এসেছি। নিজেকে কিসের বান্ধবী বলে দাবি করিস তুই? বান্ধবী হবার মতো কোনো যোগ্যতা তোর আছে? ফ্রেন্ড ছাড়া কি জীবন চলে না? আমি স্মৃতি একাই চলতে পারি। আমার কোনো ফ্রেন্ডের প্রয়োজন হয় না। মানুষ দূর থেকেই সুন্দর। কাছে আসলে এরা গিরগিটিকেও হার মানিয়ে দিবে। তোরা একজনও আমার সাথে কথা বলবি না। আজ থেকে তোরা তোদের মতো থাকবি। আর আমি আমার মতো থাকবো। কথা গুলো বলে এক মুহুর্ত বিলম্ব করল না স্মৃতি। দ্রুত পায়ে স্থান পরিবর্তন করল। সবাই বিরক্ত মাখা মুখ করে মারিয়ার দিকে তাকালো। মেঘলা রাগান্বিত হয়ে বলল।
–তুই স্মৃতির সাথে এভাবে রাগারাগি করে কাজটা ঠিক করিস নাই। স্মৃতি খুব সহজে রাগ করে না। একবার রেগে গেলে খুব সহজে রাগ ভাঙে না। সামনে পরীক্ষা। তোর জন্য যদি স্মৃতি আমাদের পরীক্ষার হলে সাহায্য না করে। তাহলে আমরা আর তোর পাশে কেউ থাকবো না৷ মেঘলার কথা শেষ হবার সাথে সাথে রোহান বলে উঠলো।
–তোরা তোদের স্বার্থের জন্য স্মৃতিকে ব্যবহার করছিস? রোহানের কথায় মারিয়া ফুঁসে উঠলো।
–আমি যা বলি সবার মুখের ওপরে বলি, আমি তোদের মতো দুমুখো সাপ না। মারিয়ার কথা শুনে, মেঘ রাগান্বিত হয়ে বলল।
–সবাইকে তোদের মতো মনে করিস না। আমরা স্মৃতিকে মন থেকে ভালোবাসি। তোর মেয়েরাই মেয়েদের দেখতে পারিস না৷ তোরা থাকতে মেয়েদের নতুন করে শত্রুর দরকার নেই। আমি আর রোহান কল দিলাম। আর তোরা দু’জন স্মৃতির সাথে এত বাজে ব্যবহার করলি? মানুষের ফ্রেন্ডশিপের বন্ডিং কত সুন্দর হয়। দেখলে ভালোবাসা বেড়ে যায়। আর আমাদের ফ্রেন্ড গুলো একেকটা অন্য জগতের প্রানী। মেঘের কথা শুনে মেঘলা বলে উঠলো।
–আমাদের বন্ধুত্ব কি কম সুন্দর ছিল? বুঝতে পারছি না৷ আমাদের বন্ধুত্বে কার নজর লেগেছে। একটা মানুষ আসার পরে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হতে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে, আমাদের বন্ধুত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমি বলছি কি সবকিছু আগের মতো করে নেওয়া যায় না। চল সবাই মিলে স্মৃতির রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করি। মেঘলার কথায় সবাই সম্মতি জানাল। সবাই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো স্মৃতিকে খোঁজার জন্য। স্মৃতি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা ভিষণ বিষন্ন হয়ে উঠেছে। কিছু ভালো লাগছে না তার। সময়ের সাথে রোদের প্রখরতা বেড়েই চলেছে। একা একা নিয়ে যাবার জন্য একটা গাড়িও নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছে না। এমন সময় আরাভ বাইক নিয়ে স্মৃতির সামনে দিয়ে চলে গেল। স্মৃতি একবার আরাভের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কি অ্যাটিটিউড মানুষটার। চোখে মুখে গম্ভীরতা বিদ্যমান। এখন থেকে এই মানুষটা ক্লাস নিয়মিত করতে হবে। ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।
বিষন্ন মন নিয়ে বাসায় আসলো স্মৃতি। আজকে স্মৃতির আম্মু ভিষণ ব্যস্ত। বাসায় এক প্রকার হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছে। বাসার অবস্থা দেখে স্মৃতির মেজাজ বিগড়ে গেল। বেশি মানুষ তার একদম পছন্দ নয়। বেশি মানুষের মধ্যে তার বেশ অস্বস্তি হয়। স্মৃতি মায়ের কাছে গিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো। আম্মু বাসায় এত কিসের আয়োজন। স্মৃতির আম্মু যা বলল। তা শুনে স্মৃতির কান গরম হয়ে আসলো। রাগান্বিত হয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে।
চলবে…..
#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_০১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu