ক্লিওপেট্রা পর্ব- ০৯

0
321

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৯

গুরু তান্ত্রিকের বাড়ির কথা শুনে ভেবেছিলাম লতাপাতায় ঘেরা অতি পুরোনো কোনো ভূতূড়ে বাড়ি হবে। কিন্তু বাড়ির গেইটে পা রাখতেই আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। এত সুন্দর বাড়ি! এরকম ডিজাইনের বাড়ি আমি এর আগে কখনো দেখিনি।
আমি কখনো শুনিনি এমন ধরনের বাড়িতে যে তান্ত্রিকেরা থাকতে পারে। তাও আবার এমন তান্ত্রিকদেরও গুরু। ক্লিওপেট্রাকে বললাম,
‘তুমি শিউর এটাই তোমার সেই গুরু তান্ত্রিকের বাড়ি?’

ক্লিওপেট্রা হাসল।

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একজন মহিলা হাসিমুখে আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে উনি কোথায় যেন চলে গেলেন। আমি ক্লিওপেট্রাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনি কে? গুরু তান্ত্রিকের স্ত্রী? ‘

ক্লিওপেট্রা আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল। ‘আস্তে কথা বলো। উনি তো বিয়েই করেননি। এটা এ বাড়ির একজন মেইড।’

‘দেখে তো মনে হলো না।’

‘তিনি খুব ভালো একজন মানুষ। তার বাড়ির সবকটা কাজের লোকদের তিনি বাড়ির সদস্যদের মতোই ট্রিট করেন। এজন্য বাইরের লোক এসে বুঝতে পারেনা যে এনারা এ বাড়িতে কাজ করেন।’

‘ওহ আচ্ছা!’

কিছুক্ষণ পরেই ওই মহিলাটি ফিরে এল। সঙ্গে নানান রকম খাবার-দাবার নিয়ে। পরিষ্কার ইংরেজিতে আমাদের খেতে বলল।
ক্লিওপেট্রাও ইংরেজিতে ধন্যবাদ জানালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, গুরুতান্ত্রিক কখন আসবেন?

মহিলাটি বলল, মাস্টার এখন মেডিটেশন করছেন। আধা ঘণ্টা বসতে হবে।

ক্লিওপেট্রা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই মহিলাটি চলে গেল।

ত্রিশ মিনিট পরেই উপর তলা থেকে সিড়ি বেয়ে একজন সত্তর- পঁচাত্তর বয়সী ভদ্রলোককে নিচে নামতে দেখা গেল। একদম ফাদারদের মতোন পোশাক পড়নে। গলায় ক্রুশ।
আমি ক্লিওপেট্রাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘উনি ফাদারদের পোশাকে কেন?’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘উনি এভাবেই থাকতে পছন্দ করেন। ‘ এরপর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমাকে চুপ থাকতে ইশারা করল।

আমি আর কোনো কথা বললাম না।

গুরু তান্ত্রিক নিচে নেমেই ড্রয়িংরুমের পাশের ঘরে চলে গেল। ওই মহিলাটি পুনরায় এল। এসে ক্লিওপেট্রাকে বলল, মাস্টার ডাকছে।

ক্লিওপেট্রা আমাকে বলল, ‘ দু’মিনিট বসো। আমি কথা বলে আসছি।’

ঠিক পাঁচ মিনিট পর ক্লিওপেট্রা ফিরে এল। ওকে দেখে বিমর্ষ মনে হল। গুরু তান্ত্রিক কী এমন বলল যে ওর মন খারাপ হয়ে গেল!
ও আমার কাছে এসে বলল, ‘চলো।’

আমি বললাম, ‘উনি কী বলল?’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘গাড়িতে বলব। এখন চলো।’

গাড়িতে উঠে বসতেই বললাম, ‘এবার বলো।’

ও বলল, ‘আসলে আহান…।’

‘কী? বলো! ভয় পাচ্ছো কেন?’

ক্লিওপেট্রা মাথা নিচু করে বলল, ‘ উনি বললেন, এখনো শাপ কাটেনি! আমাদের বেবি নিতে হবে। তাহলেই আমি পুরোপুরি অভিশাপ মুক্ত হতে পারব।’

আমি ক্লিওপেট্রার ডান হাতটা আমার বুকের বামপাশে ধরলাম। ‘বোকা মেয়ে! এতে এতো মন খারাপ করার কী আছে? বাচ্চা নিতে হবে তো নিয়ে নেবো! তুমি কি মায়ের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছো? মা একদমই ওরকম নয়। মা উল্টো আরো খুশি হবে নাতি-নাতনি পেলে। মা, অহনা দুজনই অনেক খুশি হবে ঘরে নতুন সদস্য এলে।’

ক্লিওপেট্রা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।


তিন মাস পর ক্লিওপেট্রা কনসিভ করল।

বাচ্চাটা আমাদের কোল আলো করে আসছে যেদিন শুনলাম সেদিন আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সবার ব্যাপারে আমি যেটা ভেবেছিলাম সেটাই। মা খুশিতে একেবারে আত্নহারা হয়ে গেছে। এখন থেকেই নিজ হাতে কাঁথা সেলাই করতে শুরু করে দিয়েছে অনাগত শিশুর জন্য। অহনাও প্রচন্ড খুশি। বলে কি না রোজ ওর কলেজে যাওয়ার সময় বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে যাবে। ওকে ছাড়া এক মূহুর্তও না কি থাকতে পারবে না সে। আমি ওদের কান্ডকারখানা দেখে হাসি। আনন্দ পাই।


আটমাস পর আমাদের ঘর আলো করে একটা পুত্রসন্তান এল।
ক্লিওপেট্রা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কাঁদছি। মা আমার থেকে কেড়ে নিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। অহনা মা’র কোল থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিল বাচ্চাটাকে। অহনাও ওকে কোলে নিয়ে কাঁদতে শুরু করল। আমরা সবাই কাঁদছি। ক্লিওপেট্রা হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে আমাদের কান্ড দেখছে। বলল, ‘তোমরা সবাই এত খুশি হয়েছ বাচ্চাটাকে পেয়ে? ‘

আমরা তিনজনই হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। আমাদের সঙ্গে হঠাৎ ক্লিওপেট্রাও কাঁদতে আরম্ভ করল।


সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি বিছানায় ক্বাহাফ নেই। এতো সকালে তো ও ঘুম থেকে জাগেনা! কোথায় গেল আমাদের ছেলেটা! বোধহয় মা নিয়ে গেছে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি কেউ নেই। মা’র ঘরেও মা’কে পেলাম না। অহনার ঘরেও অহনা, মা কেউ নেই। সারা বাড়ি খুঁজতে লাগলাম সবাইকে। কাউকেই পেলাম না!
রান্নাঘরটা বাকি রয়ে গেছে। ওখানে যেতেই দেখলাম, ক্লিওপেট্রা রান্না করছে। আমাকে দেখে পেছন ফেরে মুচকি হাসল।
বিশাল এক পাতিল চুলোয় বসানো। এত বড় পাতিলে ও কী রান্না করছে। দেখার জন্য আমি সামনে গিয়ে উঁকি দিলাম। সাথে সাথে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরল। পৃথিবীটা আঁধারে তলিয়ে গেল যেন। আমাদের ছেলে! আমাদের ছেলে ক্বাহাফকে ক্লিওপেট্রা গরম পানিতে আস্ত সেদ্ধ করছে! আমি চিৎকার করে ক্লিওপেট্রাকে ডাকলাম। ওকে থামাতে চাইলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ংকরভাবে হাসলো। তৎক্ষনাৎ ক্লিওপেট্রার চেহারা মুহূর্তেই বদলে গিয়ে বিদঘুটে হয়ে গেল। কুৎসিত কালো দাতগুলো বের করে বিকৃত হাসি হাসতে লাগল ও।
আমি আবার জোরে চিৎকার করে ওকে ডাকলাম, ‘ ক্লিওপেট্রা! ‘

তারপরই লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলাম আমি। বসে হাঁপাতে লাগলাম। আমাকে এভাবে জাগতে দেখে ক্লিওপেট্রাও লাফিয়ে উঠল। আমাকে ধরে বলল, ‘কী হল আহান? খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?’

আমি ক্লিওপেট্রার ওপাশে ক্বাহাফকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। আমি বিছানা থেকে নেমে নিচু হয়ে ওর কপালে চুমু খেলাম।
এরপর পুনরায় বিছানায় ফিরে এসে ক্লিওপেট্রাকে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বললাম, ‘হুম, স্রেফ একটা দুঃস্বপ্ন। ‘

আজ আমাদের ছেলের একবছর পূর্ণ হল। ঘরোয়া ভাবে ওর জন্মদিনটা পালন করা হবে। সকালেই একটা দু’পাউন্ডের কেকের অর্ডার দিয়ে এসেছি। সন্ধ্যায় কেক কাটা হবে।
অফিসে ছুটি নিয়ে বিকেল হবার আগেই ফিরে এলাম আমি। ঘর সাজিয়ে কেক আনতে দোকানে চলে গেলাম। ক্বাহাফের জন্যে গিফট কিনতে হবে। তাই পরিচিত একটা ছেলেকে দিয়ে কেকটা বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।

কী কিনবো, কী কিনবো ভেবে ওর জন্য শেষমেশ একটা খেলনা রোবট কিনে নিলাম। ব্যাটারিচালিত রোবট। সুইচ চাপলে হাঁটে। ক্বাহাফ খুব খুশি হবে এটা পেলে।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছি। হঠাৎ পেছন থেকে একটা অতিপরিচিত স্বরের ডাক শুনে থেমে গেলাম।

বাসায় ফিরে কলিংবেল চাপতেই ক্লিওপেট্রা দরজা খুলে দিল। আমি ওর হাতে একটা বেশ বড়সড় সাইজের বাক্স ধরিয়ে দিলাম। ও হেসে বলল, ‘এটা আহানের বার্থডে গিফট? ‘

আমি আমার হাতের ব্যাগ দেখিয়ে বললাম, ‘এই যে ওর গিফট। ওটা তোমার জন্য।’

ক্লিওপেট্রা লজ্জা মিশ্রিত হাসল, ‘আমার জন্য আনার কী দরকার ছিল!’

আমি বললাম, ‘খুলে দেখো।’

ও জিজ্ঞেস করল, ‘এখন?’

‘হ্যাঁ, এখন!’

ক্লিওপেট্রা উৎফুল্ল হয়ে বাক্সটা খুলতে লাগল। বাক্সটা খুলতেই ভেতর থেকে মিথি লাফিয়ে বেরোলো।

সঙ্গে সঙ্গে ক্লিওপেট্রার মুখ কালো হয়ে গেল। আমি ভ্রু নাচিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন লাগল গিফট? ‘

ক্লিওপেট্রা জবাব না দিয়ে চলে যেতে লাগল। আমি ওর হাত ধরে ওকে আটকালাম। বললাম, ‘আমি কতো গাধা তাই না ক্লিওপেট্রা? তুমি যখন বললে তুমিই মিথি তখন সাথে সাথেই সেটা বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন বোধ করিনি। ভেবে নিয়েছিলাম রূপ বদল করতে পারাটা হয়তো তোমার পাওয়ার কিংবা সাইড-এফেক্টস!’

(প্রিয় পাঠক, “নাইস”, ” নেক্সট ” শব্দ দুটো না লিখলে খুশি হবো। আমি রোজ তিন-চারঘন্টা ব্যয় করে গল্প লিখি। আর আপনারা মাত্র দু’মিনিট ব্যয় করে এক লাইন মন্তব্য করতে পারবেন না?🙂)

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here