#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ১০
ক্লিওপেট্রা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলো কেন মিথ্যে বলেছিলে আমাকে?’
ক্লিওপেট্রা জবাব না দিয়ে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। আমি উচ্চস্বরে বললাম, ‘কী হল চুপ করে আছো কেন উত্তর দাও!’
ক্লিওপেট্রা মেঝের দিকে তাকিয়েই বলল, ‘এমনি।’
‘এমনি! তুমি আমাকে এতটাই বোকা ভাবো ক্লিওপেট্রা? এমনি তুমি এতবড় একটা মিথ্যে কথা বলবে? তুমি এমনি এমনি কিছু বলো না, করোও না। তার পেছনে নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো কারণ থাকে।’
মা পেছন থেকে আমাকে চেঁচামেচি করতে দেখে বলল, ‘কী হয়েছে আহান? ক্লিওপেট্রার সঙ্গে অমন ব্যবহার করছিস কেন?’
আমি কথাটা এড়িয়ে যাবার জন্য বললাম, ‘কিছু না মা! দেখো তো অহনা, ক্বাহাফকে নিয়ে কোথায় গেল। সবাই আসতে শুরু করেছে অথচ ওরা আসছে না এখনো সেটাই বলছিলাম ক্লিওপেট্রাকে।’
মা আমাকে বলল, ‘তার জন্যে ওর সঙ্গে অমন করছিস কেন? ও কী করবে? ‘
এরপর ক্লিওপেট্রাকে বলল, ‘তুই কিছু মনে করিস না তো মা! আজ ব্যস্ততায় ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুই আমার সঙ্গে আয় তো আমরা মা-মেয়ে মিলে ওদিকটা দেখি!’
ক্লিওপেট্রা বলল, ‘আসছি মা।’
আমি মা’কে বললাম, ‘তুমি যাও ও আসছে।’
মা যেতে-যেতে বলল, ‘ওকে বকবি না খবরদার!’
মা চলে যেতেই আমি বললাম, ‘এবার বলো! কেন মিথ্যে বলেছ?’
ক্লিওপেট্রা আচমকা আমার হাত ধরল। অনুরোধের স্বরে বলল, ‘প্লিজ আহান আমি তোমাকে সব বলছি। ক্বাহাফের জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা শেষ হতে দাও!’
আমি ধাক্কা দিয়ে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম।
সন্ধ্যেবেলা সাদামাটাভাবে ক্বাহাফের জন্মদিনটা পালন করা হল। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমুতে আসার পর আমি কথাটা আবার তুললাম।
ক্লিওপেট্রা বলল, ‘তুমি যাকে মিথি ভাবছ সে আসলে মিথি নয়। ‘
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কে সে?’
‘আমার বড় বোন অ্যানি!’
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। ‘কী!’
‘হ্যাঁ। তোমাকে আমি একটা মিথ্যে বলেছিলাম। তোমায় বলেছিলাম না, যেদিন মা’কে খুন করা হয় সেদিন আমরা পালাতে গিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছি? বোধহয় আপুকেও মেরে ফেলেছে ওরা?’
‘হ্যাঁ, বলেছিলে।’
‘ওটা আসলে মিথ্যে ছিল। সেদিন আমি আর আমার আপু দু’জনই পালাতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলেও সেদিন আপু সজ্ঞানে ছিল। জেনিফার আন্টি আমাদের দেখে দুজনকেই উদ্ধার করে। ‘
আমি বললাম, ‘তাহলে মিথ্যে কেন বলেছিলে?’
ক্লিওপেট্রা বলল, ‘বলছি। জেনিফার আন্টি মারা যাবার পর শুধু আমি না, আমার বোনও ডাকিনীবিদ্যায় অংশ নিয়েছিল। আর মহিলা তান্ত্রিকটি আমাকে ধোঁকা দিয়ে আমার ওপর ত্রিবিদ্যা প্রয়োগ করলেও আপুর ওপর শুধু ডাকিনীবিদ্যা প্রয়োগ করে। তাই সাইড-এফেক্টসগুলো শুধু আমার মাঝেই দেখা দিতে শুরু করে, আপুর মাঝে নয়।
আমি আর আপু দু’জন মিলেই আমাদের প্রতিশোধ নেই।
কিন্তু আপু প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হলে তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ শুরু করে। নিষ্পাপ মানুষদের ওপর ওর ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ায়। তাই আমি আপুকে থামানোর উদ্দেশ্যে গুরু তান্ত্রিকের সঙ্গে দেখা করি। তার কাছে জানতে চাই কীভাবে আপুকে থামাবো। তিনি বলেন আপুকে এভাবে থামানো সম্ভব নয়। ওর ওপর জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে কোনো একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। আপুর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য আপুর ওপর গুরু তান্ত্রিক জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করেন। যার ফলে আপু মানুষ থেকে একটা সাধারণ বিড়াল হয়ে যায়। এটাই ছিল আপুর পাপের শাস্তি।
আমি দেশে ফেরার সময় সাথে করে ওকে নিয়ে আসি। তুমি যাতে ওকে পাও সেজন্যই তুমি যে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করো সেখানে ড্রেনের পাশে ওকে রেখে আসি। আর তুমি ওকে ওখান থেকে পেয়ে বিড়াল ভেবে বাসায় নিয়ে আসো।’
আমি বললাম, ‘আমার পাওয়ার জন্য ওকে ছেড়েছিলে কেন?’
‘সেফটি! যতোই হোক ও আমার বোন ছিল একসময়। তাই মায়ায় পড়ে…।’
‘বুঝতে পেরেছি। ও কি আর কখনো মানুষ হবে না?’
ক্লিওপেট্রা উত্তর দিল, ‘সে সম্ভাবনা নেই। তবে একেবারে যে নেই তাও না। শাস্তি শেষ হয়ে গেলে মানুষ হিসেবে ফিরলে ফিরতেও পারে।’
‘ও কি বুঝতে পারে যে ও আগে মানুষ ছিল?’
‘একটুও না। ও এখন একদম অন্যান্য সাধারণ বিড়ালদের মতোই। যদি ও ভবিষ্যতে মানুষ হিসেবে ফিরেও তবুও ওর বর্তমানের বিড়াল জীবনের ব্যাপারে কিছুই বলতে পারবে না। স্মরণই থাকবে না কিছু।’
আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা কম্পলিকেটেড।’
ক্লিওপেট্রা সম্মতি জানাল। ‘হুম।’
★
পনেরো দিন পর…
সেদিন অফিসে হাফ ডে ছিল। দুপুরে অফিস থেকে ফিরে দেখি ঘরের মেইন দরজা হাট করে খোলা। মা নিশ্চয়ই পাশের ফ্ল্যাটে গিয়েছে। আর বন্ধ করার কথা খেয়াল নেই। নিজের ঘরে ঢুকতে নিতেই দুজন মানুষের কথোপকথন আমার কানে ভেসে এলো।
ক্লিওপেট্রা ইংরেজিতে বলছে, ‘আপু তুই এখন চলে যা। আমি দেখছি কী করা যায়।’
অপর কন্ঠস্বরটিও ইংরেজিতে বলল, ‘আর কতদিন! দু’বছর হতে চলল তুই এখনো কিচ্ছু করিসনি। আর কত ধৈর্য ধরতে হবে আমার বল তুই!’
ক্লিওপেট্রা চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। অপরজন আবার বলল, ‘তুই না পারলে ঠিকাছে। আমি নিজের হাতে আহানকে আর ওর পরিবারকে শেষ করে দেবো।’
ক্লিওপেট্রা বলল, ‘না! আমি থাকতে তোর এসব কিছু করতে হবেনা। তোকে তো আমি বলেছি আমি যেহেতু এ বাড়িতে আছি সেহেতু সুযোগ বুঝে আমিই যা করার করব।’
‘কবে মারবি ওদেরকে?’
‘এক সপ্তাহের মধ্যেই।’
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরল। এসব ক্লিওপেট্রা কী বলছে! হঠাৎই আমার মাথা ঘোরাতে লাগল। আমি টলতে টলতে অহনার ঘরে চলে গেলাম। ঘরে অহনা নেই। কলেজে গিয়েছে। কেউ নেই যে আমাকে ধরবে। পুরো পৃথিবী আঁধার হয়ে যাচ্ছে আমার। আমি ঘরের সোফায় ধপ করে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ কিছু ভাবতে পারলাম না। ঘোরগ্রস্তের মতো বসে রইলাম।
কয়েক মিনিট সময় লাগল আমার স্বাভাবিক হতে। স্বাভাবিক হতেই আমি বুঝে গেলাম ক্লিওপেট্রা কার সঙ্গে কথা বলছিল। ওর বোন অ্যানির সঙ্গে। যে এ বাড়িতে মিথির বেশে আছে। ক্লিওপেট্রা আমাকে আবারও ঠকালো। তবে এবার কোনো সামান্য ধোঁকা নয়। আবার জীবন ধ্বংস করে দিল ও। আচ্ছা আমি কি দোষ করেছিলাম? ওকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম এটাই কি আমার দোষ!
হঠাৎ ক্বাহাফের কথা মনে হতেই আমার বুক কেঁপে উঠল। ক্লিওপেট্রা কি ওকেও ফেরে ফেলবে? ও তো আমার পরিবারেরই একটা অংশ! এজন্যই কি আমি সেদিন অমন বিদঘুটে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম! ওটা কি তবে আমার জন্যে একটা সাবধান বানী ছিল!
নাহ! আমি কিছুতেই ওই ছলনাময়ীকে আমার পরিবারের দিকে হাত বাড়াতে দেবো না। কিছুতেই না! তার জন্যে যদি আমার নিজের জীবন ত্যাগ করতে হয় তো করব।
আমি বাকি সময়টকু আর অহনার ঘর থেকে বের হলাম না। ক্লিওপেট্রাকে জানতে দেওয়া যাবে না যে আমি সব জেনে গেছি।
অহনা কলেজ থেকে ফিরে আমাকে ওর ঘরে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া, তুই এসময় বাসায়! তাও আবার এ ঘরে? কিছু বলবি?’
আমি বললাম, ‘এই যে এখনি ফিরলাম অফিস থেকে। কি যেন বলতে এসেছিলাম ভুলে গেছি।’
এরপর নিজের ঘরে চলে এলাম। হাত-মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দেখি, ক্লিওপেট্রা ক্বাহাফকে সুজি খাওয়াচ্ছে। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আচ্ছা ও ক্বাহাফের খাবারে কিছু মিশিয়ে দেয়নি তো ওকে মেরে ফেলার জন্যে! আমি দৌড়ে ক্লিওপেট্রার হাত থেকে সুজির বাটিটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে মারলাম। বাটিটা আওয়াজ করে মেঝেতে পড়ে গড়াতে গড়াতে সুজিগুলো সারাঘরে ছিটাতে লাগল।
(পর্ব ছোটো হবার জন্য দুঃখিত।)
চলবে…
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা