ক্লিওপেট্রা পর্ব- ১২

0
347

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ১২

মা, অহনা তখনও বাইরে থেকে সমানে দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল। তাই খুলে দিয়ে এলাম। ঘরে ঢুকেই মা তেড়ে এসে সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে চড় মারল। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মা ক্লিওপেট্রার কাছে গিয়ে বলল, ‘কোথায় মেরেছে দেখি আমাকে দেখতে দে, মা!’

ক্লিওপেট্রা আঁচল দিয়ে প্যাঁচিয়ে পিঠ ঢেকে রেখেছিল। মা টেনে পিঠের ওপর থেকে আচল সরিয়ে দিতেই সদ্য বেল্টের আঘাতে তৈরি হওয়া দাগগুলো দৃশ্যমান হল। মা’র চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরল। অহনা আঁতকে উঠল দাগগুলো দেখে। আমার বুকের ভেতরে যেন আগুন জ্বলছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হতে লাগল বুকের মাঝখানটায়।
মা বলতে লাগল, ‘যার বাপ একটা জানোয়ার তার ছেলে মানুষ হবে কী করে! জানোয়ারের বাচ্চা তো জানোয়ারই হবে।’

আমি কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না। কী বলব! মা তো ঠিকই বলেছে। আমি কী আর কোনো মানুষ আছি! অমানুষ হয়ে গেছি।

ক্লিওপেট্রা মা’কে বলল, ‘মা এখন এসব থাকুক। আমার তেমন কিছু হয়নি।’

মা অতি উচ্চস্বরে বলল, ‘কী হয়নি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। ওকে কি আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেবো! গায়ে হাত তোলা? এর শোধ নিয়ে ছাড়ব আমি।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। নিজেকে আমিও কখনোই ক্ষমা করতে পারব না ক্লিওপেট্রার গায়ে হাত তোলার জন্য।
ঘটনার শুরু যেখানটায় সেখানেই ফিরে গেলাম। সবার সামনেই ক্লিওপেট্রাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না?’

মা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কীসের উত্তর চাইছিস ওর কাছে?’

ক্লিওপেট্রা আমাকে বলল, ‘তোমাকে যদি এখন আমি নিজের মুখে সব খুলে বলিও তবুও তুমি আমাকে পুরোপুরি কখনোই বিশ্বাস করতে পারবে না। ভাববে, বোধহয় এ আমার নতুন ছলনা! একবার যদি কারো মনে অবিশ্বাসের বীজ জন্মে যায় তাহলে সেটা ডাল-পালা না গজানো পর্যন্ত কখনোই থামে না।’

আমি চুপ করে রইলাম। ক্লিওপেট্রা আবার বলল, ‘তাই বলে আমি চাইনা তুমি সেই ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই থাকো। তাই আজ যা বলার মা বলবে আমি না।’

আমি ওর দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম। মা বলবে মানে! মা এসব কীভাবে জানবে!

ক্লিওপেট্রা ঠান্ডা গলায় মা’কে বলল, ‘মা, আহান ভাবছে আমি তোমাদের সবাইকে ফেরে ফেলতে চাইছি। আমার মনে হচ্ছে ও হয়তো আমার আর অ্যানির কথাবার্তা শুনেছে। তাই ই হয়তো…!’

মা বলল, ‘ক্লিওপেট্রা যা বলছে সেটাই কি তোর এমন আচরণের কারন?’

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। মা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, ‘যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিস তার ওপর এইটুকু বিশ্বাস নেই? অন্তত ওকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারতি আসল ঘটনাটা কী!’

মা এতোটা স্বাভাবিক কীভাবে আমি বুঝতে পারছি না। তবে অহনাকে মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। আমার মতো হয়তো অহনাও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না!

মা আবার বলল, ‘ অবাক হচ্ছিস? ক্বাহাফ পেটে থাকতেই ক্লিওপেট্রা আমাকে সব খুলে বলেছে। তুই যা না জানিস তাও বলেছে।’

আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। মা সব জানে! আর আমি যা না জানি মানে! ক্লিওপেট্রা মা’কে কী এমন কথা বলেছে যা আমিও জানিনা!

মা বলল, ‘তুই কী জানিস না তা বুঝতে পারছিস না তাই না?’

আমি মায়ের দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকালাম।

মা বলল, ‘তোর জন্মদাতা পিতাই হচ্ছে ক্লিওপেট্রার মা-বাবার মূল হত্যাকারী। ওই মানুষরূপী জানোয়ারটাই ওর পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’

আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পরল। এসব কী বলছে মা! তবে কী আমার ধারণাটাই সঠিক! আমিও তো ভেবেছিলাম হয়তো ওই লোকটা কোনোভাবে ক্লিওপেট্রাদের ক্ষতি করেছে তাই ও আর ওর বোন অ্যানি মিলে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছে!

মা আবার বলল, ‘শওকত চৌধুরীর জন্যেই ক্লিওপেট্রাকে এতো ভুগতে হয়েছে। ওই জানোয়ারের লোভ ও লালসার শিকার হয়েই ওর মা-বাবাকে মরতে হয়েছে।’

আমার আচমকা অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমার ছয় বছর বয়স। অহনা মায়ের গর্ভে। সেদিন রাতে আমি মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলাম। তখন গভীর রাত। মা পাশে না থাকলে আমি কিছুতেই ঘুমোতে পারি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি মা পাশে নেই। ড্রয়িংরুম থেকে মায়ের চিৎকার ভেসে আসছে। আমি শোয়া থেকে উঠে দৌড়ে সেখানে যাই। দেখি বাবা মা’কে মারছে। আর মা মেঝেতে আধশোয়া হয়ে কাঁদছে। বাবার অপর পাশে অশ্লীল পোশাক পড়নে এক মহিলা দাঁড়ানো।
বাবাকে প্রায়ই অমন অশ্লীল পোশাক পড়নের মহিলাদের বাসায় আনতে দেখতাম। একেক সময় একেক মহিলাদের দেখা যেত। মা তাদেরকে বাসায় দেখে বাবার বিরুদ্ধে কথা বলতো। প্রতিবাদ করতো। আর বাবা রেগে গিয়ে মা’কে মারত।

বাবা মা’কে প্রায়ই মারত। খাবার দিতে এক মিনিট দেরি হলেও মা’কে মারত। মা সব মুখ বুঝে সহ্য করে নিয়েছিল তবুও। কিন্তু একসময় বাবা আমার ওপর হাত তুলতে শুরু করল। নিজের সন্তানের ওপর অত্যাচার হতে দেখে হয়তো মায়ের টনক নড়ে। লোকটাকে ডিভোর্স দেবার স্বীদ্ধান্ত নেয়।
মা একদিন কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি আমাকে নিয়ে নানাবাড়ি চলে যায়। নানা-নানীকে সব জানানোর পর তারা আফসোস করেন মেয়েকে অমন নরকে তুলে দিয়েছেন বলে। অতিসত্বর ডিভোর্সের ব্যবস্থা নেন। ডিভোর্সের পর আমরা নানাবাড়িই রয়ে যাই। নানা আমাদের কোথাও যেতে দেননি। অহনা জন্মানোর পর কখনো ওর জন্মদাতা পিতাকে আর দেখতে পায়নি। আমরা বড় হই নানার পরিচয়ে। ধীরে ধীরে অনেকগুলো বছর কেটে যায়।
আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরির সন্ধানে নেমে পড়ি। চাকরিতে জয়েন করার পরপরই ঢাকায় চলে আসি। এখানেই এক ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। নানা আমাদের আসতে দিতে চাননি। হাজার বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাই। বলি, এখন আমি বড় হয়েছি। এখন অন্তত আমার মা, অহনার দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ!
নানা একসময় রাজি হলেও এখনো খানিকটা রেগে আছেন আমার ওপর।

পরিচিতদের কাছে শুনেছি, ওই লোক না-কি এখন আমেরিকায় চলে গেছে। সেখানেই না-কি নতুন স্ত্রীকে নিয়ে স্থায়ীভাবে থেকে গেছে।

আচ্ছা, সেজন্যই কী ক্লিওপেট্রা আমাকে কখনো ওর মা-বাবার খুনির নাম বলতো না! শুধু বলতো ‘ওই লোকটা!’

আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মা বলল, ‘কী ভাবছিস এতক্ষণ ধরে?’

‘কিছুনা, মা।’ এরপর ক্লিওপেট্রাকে বললাম, ‘তুমি আমাকে কেন বলোনি যে তোমার মা-বাবার খুনি শওকত চৌধুরী? ‘

ক্লিওপেট্রা এখনো কাঁদছে। জলভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বললে তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসতে না আহান! কখনোই বাসতে না! ভাবতে তোমার বাবা এলেক্সা আর আমাদের অফিসের সহকর্মীর সাথে মিলে আমার মা-বাবাকে মেরে ফেলেছে বলে আমিও প্ল্যান করে তোমাকে বিয়ে করে প্রতিশোধ নিতে এসেছি।’
কিছুক্ষণ থেমে ক্লিওপেট্রা হাসার চেষ্টা করল, ‘অবশ্য এখনও তা-ই ভাবছো।’

ক্লিওপেট্রা আবার বলল, ‘আচ্ছা, আহান তুমি কি মনে করো আমি এখনো ডাকিনীই রয়ে গেছি?’

আমি উত্তর দিলাম না। ও আবার বলল, ‘এসব ব্যাপারে আমি তোমাকে একটাও মিথ্যে বলিনি আহান। তুমি আমাকে যেদিন থেকে ভালোবাসতে শুরু করেছো সেদিন থেকে আমার সব অভিশাপগুলো কাটতে আরম্ভ করেছে। ডাকিনী হবার কিছু দিন পর যখন সাইড-এফেক্টসগুলো দেখা দিতে শুরু করল তখন আমার অনুভবের ক্ষমতাও চলে গিয়েছিল। আমি কিছু অনুভবও করতে পারতাম না। মনে আছে একদিন তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেদিন অন্যদিনের চাইতে বেশি ঠান্ডা পড়েছিল কি-না? তখন আমি কিছু অনুভব করতে পারতাম না। কিন্তু সেদিন হঠাৎই খুব ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিল। তাতেই আমি বুঝতে পারি তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছো। ‘

আমি বললাম, ‘আমার মনে আছে।’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘সেগুলো সব সত্যিই ছিল আহান! আর পাঁচটা মানুষের মতো অনুভব করার ক্ষমতা ফিরে পাবার পর আমি তোমার চরিত্রের প্রেমে পড়ে যাই। ধীরে ধীরে তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করি। তোমার সাথে বিয়ের পর আমার ওপর থেকে পার্শ-প্রতিক্রিয়াগুলো অনেকটাই সরে গিয়েছিল। ক্বাহাফ হবার পর সম্পূর্ণ মুক্ত হই আমি। আমি আর ডাকিনী নেই আহান! তাই সেই ক্ষমতাগুলো কিংবা সাইড-এফেক্টসগুলো কোনোটাই নেই। এখন আমি তোমাদের মতোই সুস্থ-স্বাভাবিক সাধারণ মানুষ আহান! কোনো প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত নানা শক্তির অধিকারী ডাকিনী নই!

আমি বললাম, ‘আমি বলিনি ক্লিওপেট্রা তুমি এখনো তেমনটাই রয়ে গেছ। আমি জানি তুমি এখন আর চার-পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই।’

ও বলল, ‘তাহলে তুমি কী করে ভাবলে আমি প্রতিশোধের নেশায় তোমার বাড়িতে পরে আছি! আমি তোমাকে ভালোবাসি আহান! শুধু তোমাকে নয়। মা’কে, অহনাকে সবাইকে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে আমি নিজের পরিবার মনে করি আহান! আমি মা’কে আমার আপন মায়ের চাইতে কোনো অংশেই কম ভাবিনি কখনো! আর অহনা! অহনাকে আমি নিজের বোনের সাথে তুলনা দেবো না। কারণ অ্যানি তো হিংস্র পশুর চাইতেও জঘন্য হয়ে গিয়েছিল! ‘

আমি বললাম, ‘তুমি বলেছিলে অ্যানিকে জাদুবিদ্যা দ্বারা সাধারণ বিড়ালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তাহলে আমি যে তোমাদের সেদিন কথা বলতে শুনলাম!’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘আমি সত্যিটাই বলেছিলাম তোমাকে। এমনকি এ-ও বলেছিলাম শাস্তি শেষ হলে কখনো মানুষ রূপে ফিরলেও ফিরতে পারে। তবে ও যে মানুষরূপে ফিরলেও ডাকিনীই রয়ে যাবে তা আমি সত্যিই জানতাম না।’

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

(প্রিয় পাঠকেরা, গল্পের কোনো অংশ বা কোনো কিছু না বুঝলে কিংবা গল্প স্বমন্ধে কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন।
আরেকটা কথা। গল্পের আর এক পর্ব বাকি আছে। এ পর্বে শেষ করে দেওয়াটা সম্ভব হলো না।
আর আমি ছেলে নই, মেয়ে। অনেকেই আমাকে ছেলে মনে করে ভুল করেন।😑)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here