#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট__৪৩
জাওয়াদ জামী
শুভ চলে যাওয়ার পরও আরমান বাবা-মা’র কাছে বসে, তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু শহিদ আহমেদ ও আকলিমা খানম কিছুতেই বুঝ নেয়না। তাদের একটাই কথা, শুভকে তাদের জীবনে আর কোনও প্রয়োজন নেই। আকলিমা খানমের ভাষ্যমতে, দুষ্টু গরুর থেকে, শূন্য গোয়াল ভালো। শুভকে ফিরিয়ে এনে সে বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করতে চায়না।
কিংবা আরমান চাইছে, শুভকে কাছে রেখে শোধরাবার চেষ্টা করতে।
কিন্তু ওর প্রস্তাবে শহিদ আহমেদ এবং তার স্ত্রী কিছুতেই রাজি হয়না।
এত সময় ধরে বাবা-মা’ র সাথে কথা বলতে গিয়ে আরমান মেয়ের কথা দিব্যি ভুলে বসেছিল। সে একটিবারও মেয়ের দিকে কিংবা কান্তার দিকে তাকায়নি। এই বিষয়টি লক্ষ্য করে কান্তা ভিষণ কষ্ট পায়। এমনটা নয় যে শুভর বিষয় নিয়ে ও চিন্তিত নয়। কান্তার বারেবার মনে হচ্ছে, কথার ফাঁকে একটিবার অন্তত আরমান ওদের দিকে তাকাতে পারত। কষ্টে কান্তার বুক দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। এ কেমন বাবা!
শহিদ আহমেদের সাথে কথার মাঝেই আরমানের কানে মেয়ের কান্নার শব্দ আসে। ও হকচকিয়ে মেয়ের দিয়ে তাকায়। নিজের অজান্তেই অশ্রাব্য গালি বেরিয়ে আসে মুখ থেকে । ও কি করে পারল এতক্ষণ যাবৎ ওর পরীটাকে ভুলে থাকতে! আজ বাবা হিসেবে নিজেকে নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে।
শহিদ আহমেদের সাথে কথা শেষ না করেই, আরমান শ্রীজার কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করে। আশ্চর্যজনকভাবে আরমানের কোলে উঠেই কায়া শান্ত হয়ে যায়। আরমান মেয়ের চোখেমুখে চুমু দিয়ে আদর করতে থাকে। বাবার আদর পেয়ে মেয়েও বিড়াল ছানার মত বাবার বুকে সিঁটিয়ে যায়।
শহিদ আহমেদ ছেলেকে রেষ্ট নিতে বলে নিজেও রুমে যান। তার পিছুপিছু হুইল চেয়ারে ভর করে আকলিমা খানমও রুমে যায়।
এতক্ষণে আরমান কান্তার দিকে তাকায়। কিন্তু ওর সাথে কোনও কথা না বলে সোজা রুমের দিকে পা বাড়ায়।
কান্তাও ওর পিছুপিছু মুখ ভার করে রুমে ঢোকে।
আরমান রুমে এসে মেয়েকে প্রানভরে আদর করছে। কিন্তু কান্তার দিকে একটাবারও ফিরে তাকায়না। ও এমনভাব করছে যেন, কান্তাকে দেখতেই পাচ্ছেনা।
কান্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ের আল্লাদ দেখছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আরমান মেয়েকে রেখে ওয়াশরুমে ঢোকে। অনেক সময় নিয়ে গোসল করে বেরিয়ে আসে।
শ্রীজা এসে আরমানকে খাওয়ার জন্য ডাকলে, আরমান মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। কান্তাকে একবারও বলেনা।
আরমান বেরিয়ে গেলে কান্তা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
ওর মনে ভয় চেপে বসেছে। আরমানকে হারানোর ভয়।
রাতে মেয়েকে ঘুমিয়ে দিয়ে, কান্তা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে সূদুর পানে। ওর চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রুধারা। আরমানের এই পরিবর্তন ও কিছুতেই মানতে পারছেনা। যে মানুষটা ওকে সব সময় ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছে, আজ সেই মানুষটার এ কি পরিবর্তন! বাঁধ ভাঙ্গা ঢেউ আছড়ে পড়ছে কান্তার বুকের তীরে। এবার বুঝি ভাঙ্গনের সুর বেজেছে! কিন্তু ও আরমানকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবে! কিভাবে একা পথ চলবে! কথাটা ভাবতেই কান্তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে র’ক্ত ছলকে উঠছে। প্রতিটি র’ক্ত বিন্দু বলছে, তুই তাকে ছাড়া নিঃস্ব। অনাদরের সাগরে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলি, সে তখন তোর অক্সিজেন হয়ে এসেছিল। তোর শ্বাস নেবার পথ সুগম করেছিল। আজ তুই নিজের দোষে সব হারাতে বসেছিস। তবুও কান্তা নিজের মনকে প্রবোধ দেয়, এসব তার নিছকই কল্পনা। কিন্তু মন সেই প্রবোধ মানলে তো!
কান্তা এবার শব্দ করে কেঁদে উঠে।
রুমে ঢুকতেই আরমানের কর্ণকুহরে কারও কান্নার আওয়াজ বারি খায়। ও সাথে রুমের ভেতর এদিকওদিক তাকায়। রুমে কান্তাকে না পেয়ে ওর বুঝতে বাকি থাকেনা ঘটনা কি।
দ্রুত পায়ে চলে আসে বারান্দায়। পেছন থেকে জাপ্টে ধরে তার রমনীকে। থুঁতুনি রাখে তার কাঁধে। এরপর ছোট্ট করে তার কানের লতিতে চুমু দেয়।
হঠাৎ কারও ছোঁয়া পেয়ে শিউরে ওঠে কান্তা। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে কার বাহু বন্ধনে আবদ্ধকরণ সে। এই ছোঁয়া ওর অচেনা নয়। ওর ঠোঁটের কোন একটু প্রসারিত হয়।
” ভয় গিলিয়ে খাওয়াতে পেরেছি? খুব তো বড়বড় বুলি আওড়াচ্ছিলে! এখন কাঁদছ কেন? ভয় যে উগড়ে দিলেনা? আমি অপেক্ষায় আছি যে। ” আরমান গলায় মধু ঢেলে বলল। ওর হাত বিচরণ করেছে কান্তার পেটে।
এবার কান্তা আরমানের মতলব বুঝতে পারছে। মুহূর্তেই ওর মন ভালো হয়ে যায়। মনের আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে সোনালী সূর্য উঁকি দেয়। মনকে সহাস্যে বলে দেয়, সে আমারই আছে। একান্তই আমার । তার মন বাগানে শুধু আমারই বিচরণ। আমিই তার তনু-মনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারীনি।
” আপনি আমাকে ভয় পাওয়াতে শুধুই কষ্ট দিয়েছেন! আমার কত কষ্ট হচ্ছিল সে সম্পর্কে আপনার কোন ধারনা আছে? এই কয়দিন আমি যেন বেঁচে থেকেও ম’রে গেছিলাম। না পারছিলাম কাউকে বলতে, না পারছিলাম সহ্য করতে। কি যে এক অসহ্য যন্ত্রণায় আমি দিনাতিপাত করেছি, তা আমিই জানি। আপনি আমাকে যেন এক সমুদ্র অ’ন’লে নিক্ষেপ করেছিলেন। এই অনলের আঁচ অনুভব করা যায়, পুড়ে ক্ষ’ত-বি’ক্ষ’ত হয় মন। শরীরে কোন প্রভাব না ফেলেই জ্বা’লি’য়ে অ’ঙ্গা’র করে দেয়। ” এবার কান্তা ডুকরে কেঁদে উঠে।
কান্তার কান্নার আওয়াজে আরমানের বুকের ভিতর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। বুকের ওপর যেন কয়েকশো পাথর চেপেছে।
” সরি বউ। তুমি কেঁদনা। তুমি এভাবে কাঁদলে আমার যে ভিষণ কষ্ট হয়। বুকের পাঁজরে কুল ভাঙ্গা ঢেউ এসে আঘাত করে। আমি ভেঙে গুঁড়িয়া যাই মুহূর্তেই। ” কান্তার চোখের পানি সযত্নে মুছে দেয় আরমান।
” আপনি আমার কাছে প্রমিজ করুন, কখনও আর এমন দুষ্টুমি করবেননা? এসব সহ্য করার করার ক্ষমতা আমার নেই। ” নাক টানতে টানতে বলে কান্তা।
” আমি প্রমিজ করছি, আর কখনোই এসব করবনা। আমার বউটাকে কতদিন ধরে আদর করিনি বলতো? আরও কতকাল বউয়ের আদর থেকে বঞ্চিত থাকব! পাষাণ নারী। জামাইয়ের চাওয়া বোঝেনা। দেখ, কেমন শীতল হাওয়া বইছে। চারপাশে ঘুম জাগানিয়া গানে সুর তুলেছে ঝিঁঝিঁ পোকার দল। তোমার কি ইচ্ছে করছেনা, ঝিঁঝিঁদের দলে সামিল হয়ে, আমাকে জাগিয়ে রাখতে? তোমার উঞ্চ ছোঁয়ায় আমার শরীরে কাঁপন ধরাতে তুমি কি চাওনা। আজকে তোমার মাঝে ডুবতে ভিষণ ইচ্ছে করছে। ” কান্তাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় আরমান।
আরমানের এমন ডাক উপেক্ষা করার সাহস নেই কান্তার। সে-ও তার পুরুষের গলা জড়িয়ে ধরে, মাথা রাখে তার বুকে।
চলবে…