#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব বাইশ
২২.
এরই মধ্যে ৪/৫ দিন পার হয়ে গিয়েছে। ফারাজ বাবার অফিসে জয়েন করেছে। এখানেও নীতি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। ফারদিন আহমেদ মাঝেমধ্যে গিয়ে ঘুরে আসে অফিস থেকে।
আজ যখন ফারাজ আর নীতি অফিসে যাচ্ছিল নীতিকে আখি বেগম রেখে দিয়েছেন নিজের সাথে। তার একটাই কথা ফারাজকে যে,
‘তোরা তো আমার কথা শুনবি না। তুই যা অফিস। নীতি আমার সাথে থাকবে।’
ফারাজ বলল,
‘কিন্তু নীতিকে তো অফিসে দরকার হয় মা৷’
আখি বেগম ফারাজের কথা কে পাত্তা না দিয়ে নীতির হাত ধরে তাকে নিয়ে ঘরের দিকে হাটা দিতে দিতে ফারাজকে বললেন,
‘মুড়ি খা!’
ফারাজ থম মেরে তাকিয়ে রইলো মায়ের কথা শুনে। এজন্যই বুঝি বলে,’যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়াপড়শির ঘুম নাই।’
ফারাজ আর কি করবে। একাই রওনা দিল অফিসের উদ্দেশ্যে।
আজ অপরাজিতার বাসায় আবার যাবে তারা। সেদিন হুট করে যাওয়ায় ভালোভাবে কথাবার্তা হয় নি। আজ পরিবার নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেখতে যাবে এবং আংটি পড়িয়ে আসবে।যাওয়ার জন্য কিছু আয়োজন তো করা লাগবে কিন্তু আখি বেগমকে কেউ পাত্তা ই দিচ্ছে না।আখি বেগম ছেলের বিয়ে নিয়ে খুবই এক্সাইটেড। তাই তিনি সকাল থেকেই শুরু করে দিয়েছেন এই সেই নানা আয়োজন। সকাল বেলা ফায়াদকে বলেছিলেন হাসপাতালে না যেতে। ফায়াদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘কেন?’
আখি বেগম বলেছিলেন,
‘আজকে মেয়ে দেখতে যাবো তো!’
ফায়াদ স্বাভাবিক সুরে বলেছিল,
‘সেটা তো সন্ধ্যায় যাবো। সে টাইমে আমি এসেই পড়বো।’
আখি বেগম তখন ব্যস্ততা দেখিয়ে বলেছিলেন,
‘তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না? মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস। একটা আনুষ্ঠানিকতা আছে না? একটা আয়োজন আছে।’
ফায়াদ মায়ের দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হেসে বলেছিল,
‘মেয়ে তো আমি প্রতিদিনই দেখি মা! আয়োজন তুমি করো। আসছি আমি।’
বলে সে বেরিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।ফায়াদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আখি বেগম মনে মনে কপাল চাপড়ালেন।এই ছেলেকে তিনি কখনো জোর করে কিছু করাতে পারেন না।ফারাজকে জোর করে, ব্লাকমেল করে অনেক কিছু করাতে পারেন কিন্তু ফায়াদের না মানে না।
তাই তিনি ফারাজকে অফিসে যেতে দিলেও নীতিকে রেখে দিয়েছেন।
নীতির কাছে বিচার দিচ্ছেন,
‘আমার ছেলে গুলো দুটোই বদ’মাশ বুঝছো! একটা ভদ্র বদ’মাশ আরেকটা তো প্রকাশ্যে বদ’মাশ।’
আখি বেগমের কথা শুনে নীতি হাসছে। এ কয়েকদিনে আখি বেগমের সাথে খুব ফ্রি হয়েছে নীতি। দুজনে নানা গল্পে মশগুল থাকে যখন নীতি বাসায় থাকে।
নীতি বলল,
‘আন্টি আপনি ফায়াদ ভাইয়াকে বদ’মাশ বললেন! তাকে তো আমার কাছে ভালোই লাগে।’
আখি বেগম বললেন,
‘এজন্যই তো ভদ্র বদ’মাশ বলেছি।’
আখি বেগম আর নীতি বর্তমানে নীতির রুমের ফ্লোরে বসে কিছু গিফটস প্যাক করছে। নীতিও সাহায্য করছে। হাতের বক্সটাকে র্যাপিং করতে করতে নীতি মুচকি হেসে বলল,
‘ ভাইয়ার অপরাজিতা ফুল খুব লাকি আপনাকে শাশুড়ী হিসেবে পেয়ে।’
আখি বেগম হাতের কাজ টা থামিয়ে নীতির দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির এক হাসি দিয়ে বললেন,
‘আমি তো শাশুড়ী হতে চাই না। মা হতে চাই তার। আমার কোনো মেয়ে নেই। তবে ছেলের বউকে আমার মেয়ের মতো করে রাখবো আমি। মেয়ে নিয়ে যতো শখ ছিল সব তাদের দিয়ে মিটাবো। আমার এক মেয়ে তো চলে গেল তবে এই মেয়েকে আমি অনেক আদরে রাখবো।’
নীতি বুঝতে পারলো চলে গেল বলতে আখি বেগম ফারাজের মৃত স্ত্রী কে বুঝিয়েছেন। তার কথা ভেবে আখি বেগমের চোখের কোণে পানি চলে আসলো।হাত দিয়ে তা মুছে ফেলে বললেন,
‘ মেয়েটা এতো লক্ষী ছিল।আমার ঘরটা খুব সুন্দর করে আগলে রাখতো। কোনো সমস্যা হলে তা ধৈর্য সহকারে সমাধান করতো।আমার অগোছালো ছেলেটাকে সে গোছালো করে দিয়েছিল।খুব ম্যাচুর ছিল।’
নীতি আখি বেগমের হাত ধরে তাকে নিরবে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।আখি বেগম নীতির মুখপানে তাকালেন। মেয়েটাকে এতোদিন ভালোভাবে দেখা হয় নি। কিন্তু এই মুহুর্তে তিনি তাকিয়ে রইলেন নীতির মুখপানে। তার চোখে পানি দেখে নীতি মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই আবেগী খুব। দেখতেও খুব মায়াবী লাগছে এই মুহুর্তে। আচ্ছা এই মেয়েটাকে ফারাজের সাথে কেমন লাগবে?
নিজের ভাবনায় অবাক হলেন আখি বেগম। নিজেকে চটজলদি সামলে বললেন,
‘দেখেছো ইমোশনাল হয়ে গিয়েছি! কি করবো বলো? আমার ছেলে গুলো এতো ভালো ভালো মেয়ে গুলো যে কোথায় থেকে পায়।অপরাজিতা মেয়েটা এতো মিশুক। ছোটখাটো পুতুলের মতো একটা মেয়ে। বয়সে ফায়াদের থেকে অনেক ছোট কিন্তু আচরণে সে সবাইকে আপন করে নিতে পারবে। জানো সেদিন কি হয়েছে? আমরা যে গিয়েছিলাম বাসায় ফেরত আসার সময় সে আমাকে কানে কানে বলেছিল যে ফায়াদ নাকি তাকে অনেক ধমকিয়েছে আগে। তাকে যেন আমি ধমকে দেই।’
বলেই হাসতে লাগলেন তিনি। নীতি দেখছে প্রশান্তিময় হাসি। মায়েরা বুঝি এমন হয়! সবসময় মমতাময়ী। নীতির মনেও প্রশান্তি বয়ে গেল এই মমতাময়ী নারীর মমতা দেখে।তারও মায়ের কথা মনে পড়ছে।সেও বাবা মায়ের রাজকন্যা ছিল।অথচ এখন বাবা-মা কেউই নেই। নীতিকে চুপচাপ দেখে আখি বেগম বললেন,
‘শুনো মেয়ে, আমি তোমার কেউ না বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি না এটা ভাববে না। তুমি আমার ফারাজের খেয়াল রেখেছো ভীনদেশে। তার বন্ধু হয়ে পাশে ছিলে। তুমিও আমার খুব আদরের।এখন যেহেতু আমাদের সাথেই থাকবে তাই তুমি আমার আরেক মেয়ে। ঠিক আছে? আমার সাথে কোনো সংকোচ করবে না। আর সংকোচ করলে তোমার লস কারন বাড়িতে আর কোনো মেয়ে নেই তোমাকে সাহায্য করার।’
নীতির চোখ টলমল করে উঠলো আবারো। বলল,
‘আপনি এতো ভালো কেন আন্টি?’
আখি বেগম নাক মুখ কুচকে বললে,
‘আন্টি টা পর পর লাগছে। তুমি বরং আমাকে মণি ডাকো। আমার বোন নাই। বোন থাকলে বোনের ছেলেমেয়ের মণি ডাকা শিখাতাম। আছে একটা ভাই। তার ছেলেমেয়েরা ডাকে ফুপি!মণি ডাক শুনা আর হলো না। তুমি পূরণ করো সেই অভাব। ‘
আখি বেগমের হিসাব শুনে নীতি হেসে দিল। আখি বেগমের মুখেও হাসি ফুটলো। মেয়েটা বড্ড নাজুক৷ বাহিরে বড় হয়েও আবেগ দিয়ে ভরপুর।
ওদিকে অপরাজিতার বাসায়ও ভীষণ রকম ব্যস্ততা। অপরাজিতার মাকে হেল্প করার জন্য অপরাজিতার ছোট খালামনি এসেছে। বড় খালামনিকে ডাকে নি তার মা। কারন তাদের পরিবারটা ভালো না। একে তো পরিবার ভালো না তারউপর ইয়ানা মেয়েটা যেখানে যায় অশান্তি নিয়ে আসে। তাই ফোনেও কিছু জানায় নি আপাতত।
রামিসা বেগম আর তার ছোট বোন আমিনা দুজনে হাতে হাতে নানা কাজ করছে। আজ ছেলেপক্ষের বাড়ি থেকে বেশ কিছু মানুষ আসবে। আংটি পড়াবে, বিয়ে নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে। তাই মহা আয়োজন চলছে।
বসে বসে সেগুলোই দেখছে অপরাজিতা। তাকে আজ ক্লাসে যেতে দেয় নি। ফায়াদ তাকে বলেছিল ক্লাসে যেতে যেহেতু তারা সন্ধ্যায় আসবে। কিন্তু ছোট খালামনির ধমকে আর বের হওয়ার সাহস পায় নি। তার ছোট খালামণি অনেক রাগী। যা বলবে একেবারে মুখের উপর বলে দিবে। একথা ফায়াদকে জানাতে ফায়াদ বলল বাসায় পড়তে।
পড়তে সে বসেছিল কিন্তু খালামনির পোলাপানের জালায় আর পড়তে পারলো কই। কতোক্ষন পর পর তার ১৪ বছরের মেয়ে সামিয়া এসে বলবে,
‘আপু দুলাভাইকি অনেক সুন্দর?’
আবার এসে বলবে,
‘আপু দুলাভাই দেখতে কেমন?’
এখন অপরাজিতা সোফায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। এখন আবার এসেছে সামিয়া। এসে পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপু দুলাভাইয়ের একটা ছবি দেখাও না?’
অপরাজিতা এবার তেতে গেলো।দাতে দাত চেপে বলল,
‘দুলাভাই সুন্দর হোক বা না হোক তোর এত কি রে? সন্ধ্যায় যখন আসবে দেখিস। এখন মাথা খাইস না তো!’
সামিয়া গাল ফোলাল। তা দেখে সামিয়ার ভাই সামির হেসে দিল উচ্চস্বরে। সে অপরাজিতাকে বলল,
‘দেখায় দিলেই তো হয়!’
অপরাজিতা মুখ ভেঙচি কেটে বলল,
‘হুম তারপর তোর বোন সেই ছবি আমার থেকে নিবে।তার বান্ধবীদের গ্রুপে সে ছবি দিয়ে শোঅফ করুক। তারপর সবগুলো মেয়ে আমার জামাইকে নজর লাগাক! দরকার নাই। এই বয়সের মেয়েরা এমনিতেও পাকামি করে বেশি।’
সামির আবারো হেসে দিল।সামির আর অপরাজিতা সমবয়সী। তাদের বন্ডিং টা ফ্রেন্ড এর মতো। সামির বলল,
‘আমাকে তো দেখাতে পারিস’
অপরাজিতা বলল,
‘ন-আকার না। তুই ও নজর লাগায় দিবি।আমার হবু জামাই একটু বেশিই সুন্দর। ‘
সামির দিল অপরাজিতার মাথায় এক থাপ্পড়।সামিরকে আগেই দেখিয়েছে অপরাজিতা।ক্ষ্যাপানোর জন্য বলেছিল আবার দেখাতে। অপরাজিতা মাথা ঘষে বলল,
‘তোর ব্রেকাপ হয়ে যাবে দেখিস!’
এই কথা শুনে আমিনা বললেন,
‘ব্রেকআপ হয়ে যাবে মানে? সামির!!’
সামির আমতা আমতা করে বলল,
‘আরে আম্মু অপরাজিতা মজা নিচ্ছে।’
আমিনা চোখ রাঙিয়ে বলে গেলেন,
‘তাই যেনো হয়।’
আমিনা বেগমের ইচ্ছা ছেলেকে নিজের পছন্দে বিয়ে করাবে। তাই প্রেম করতে ছেলেকে সাফ সাফ নিষেধ করেছেন তিনি। আমিনা চলে যেতেই সামির হাফ ছেড়ে বাচলো। অপরাজিতা তা দেখে শয়তানি হাসি দিল। সামির চোখ কটমট করে তাকালো অপরাজিতার দিকে।
দুপুরে খাওয়ার পর অপরাজিতার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চাপলো। সে গিয়ে সামিরকে ধরলো,
‘এই চল বাহিরে যাই। ‘
সামির অপরাজিতা দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেন?’
অপরাজিতা সুন্দর করে বলল,
‘এমনি চল ঘুরে আসি। ‘
সামির ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
‘তোকে আমি বিশ্বাস করি না। কি না কি আকাম করতে যাচ্ছিস। ‘
অপরাজিতা বাচ্চাদের মতো করে বলল,
‘এমন করিস না!চল প্লিজ’
‘না’
অপরাজিতা এবার নিচু স্বরে বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘এই চল!আমি দুদিন ধরে ডাক্তারকে সামনাসামনি দেখি না। মোবাইলে দেখতে আর ভাল্লাগে না।চল তুই। নাহলে খালামণিকে তোর গার্লফ্রেন্ড এর কথা বলে দিব!’
অপরাজিতার ধমকে কাজ হলো। সামির অপরাজিতার মুখ চেপে বলল,
‘আস্তে বল বোন আমার!জু’তাপেটা খাওয়াবি নাকি?’
অপরাজিতা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,
‘চল তাহলে’
তারপর সামির রামিসা বেগম ও আমিনা কে অনেক কসরত করে মানিয়ে অপরাজিতাকে নিয়ে বের হলো।
রিকশায় বিরক্তি নিয়ে বসে আছে সামির।অপরাজিতার মুখ থেকে হাসি সরছেই না।সামির জিজ্ঞাসা করলো,
‘আমাকে এনেছিস কেন?’
‘আমাকে একা বিনা কারনে বের হতে দিবে না তাই। ‘
অপরাজিতাকে এতো খুশি দেখে সামির জিজ্ঞেস করলো,
‘কবে থেকে চলছে এগুলো?’
অপরাজিতা প্রশ্ন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।সামির বলল,
‘তোর রিলেশনশীপ এর কথা বলছি’
অপরাজিতার এবার বোধগম্য হলো।সে বলল,
‘ক্লাস টেন থেকে। এক পাক্ষিক ছিল। আমার তরফ থেকে। এইচএসসি এর পর দুপাক্ষিক হয়েছে।’
সামির অবাক হয়ে বলল,
‘তুই তারমানে পিছে ঘুরেছিস?’
অপরাজিতা চ জাতীয় শব্দ করে বলল,
‘পিছে ঘুরেছি বলিস কেন? বল ভালোবেসেছি।’
কথা বলতে বলতে তারা হাসপাতালে পৌঁছে গেল।রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই সামির অপরাজিতাকে বলল,
‘ওইটা ইয়ানা আপু না?’
একটা মেয়েকে দেখিয়ে দিল।টাইট টপ আর জিন্স পড়া। অপরাজিতার তা দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল।বলল,
‘এই শাকচু’ন্নী এখানে কি করে?’
সামির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘জানি না আয় দেখি। ‘
তারা ইয়ানার পিছে পিছে গিয়ে দেখলো ইয়ানা একটা চ্যাম্বারে প্রবেশ করেছে।চ্যাম্বারের বাহিরে ড.ফায়াদ আহমেদ দেখেই অপরাজিতার মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। অপরাজিতার মুখ দেখে সামির ফাকা ঢোক গিলল। আজ ইয়ানার খবর হয়ে যাবে।
অপরাজিতা নিজেকে অনেক কষ্টে দমিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।প্রবেশ করতেই দেখলো ইয়ানা সামনের দিকে ঝুকে বসে আছে। ফায়াদ এর নজর প্রেসক্রিপশন নোটের দিকে। আশে পাশে তাকাচ্ছে না সে। তা দেখে রাগের মাঝেও অপরাজিতার শান্তি লাগলো।
অপরাজিতা সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’
সালাম শুনে ফায়াদ মাথা তুলে তাকালো।মুখে হাসি ফুটলো তার। সে মুচকি হেসে অপরাজিতাকে তার কাছে চেয়ারে বসতে বলল।কিন্তু অপরাজিতা গিয়ে ইয়ানার পাশে বসে জোর করে হেসে বলল,
‘আপু তুমি এখানে কি করো?’
ইয়ানা ফায়াদের সামনেই এবার বলল,
‘তোর বয়ফ্রেন্ড দেখতে আসছি।’
অপরাজিতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘বয়ফ্রেন্ড বলো আর জামাই বলো মানুষটা আমার তাই আমাকেই না হয় দেখতে দাও।’
ফায়াদ বুঝলো এরা পরিচিত। তার সে আর ইন্টারফেয়ার করলো না।সে নিরবে দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করছে আসলে কাহিনি টা কি।
ইয়ানা দাঁড়িয়ে বলল,
‘আচ্ছা দেখ। আমার কাছে বরং একটা ছবি আছে আমি সেটা দেখি।’
বলে সে ব্যাগ থেকে ফায়াদের একটা ছবি দেখালো। যা সে অপরাজিতার রুম থেকে চুরি করেছিল। কিছু মানুষ থাকে যারা অন্যের জীবনে অশান্তি করে মজা পায়।ইয়ানাও সেরকম।
ছবিটা দেখে অপরাজিতা রাগ সামলাতে পারলো না।সে ছবি সহ ইয়ানার হাত মুচড়িয়ে ধরলো।ইয়ানা ব্যথায় ছুটার জন্য ছটফট করছে।অপরাজিতার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। ফায়াদ অপরাজিতার এই রূপ দেখে অবাক।কিন্তু সামির মোটেও অবাক না৷ কারন সে অপরাজিতাকে এভাবেই দেখেছে ছোটবেলা থেকে। ফায়াদকে অবাক হতে দেখে সামির ফায়াদের পাশে এসে বলল,
‘দুলাভাই অবাক হচ্ছেন? অবাক হবেন না কারন আমার বোন অলরাউন্ডার। সে সব পারে। ‘
বলে মিট মিট করে হাসছে সে।
এদিকে অপরাজিতা ইয়ানার হাত মুচড়ে ধরে রাগে হিশহিশিয়ে বলল,
‘ তুমি আমার থেকে বয়সে বড় হলেও তোমার থেকে আমার শক্তি বেশি বুঝেছো?তোমার এই না খেয়ে বানানো ফিগা’র ভাঙতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না।’
তারপর আরেকটু জোরে হাত মুচড়ে ধরলো।ইয়ানা ব্যথাতুর শব্দ করে উঠলো।সে ছুটার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।অপরাজিতা কায়দা করে ধরেছে।অপরাজিতা এবার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলল,
‘তুই এই পোশাক পড়ে এখানে আসছিস কেন?ফি’গার দেখাতে? আমি বলে দিচ্ছি আমার বিয়েতে যদি ঝামেলা করিস, তোর টাকা আসার সোর্স বন্ধ করে দিব। কি ভাবছিস আমি জানি না কিছু? তোর রাজনীতি করা বাপ জানে যে তার আদরের মেয়ে কোথায় কোথায় যায়?’
এটা শুনে ইয়ানা ভয় পেয়ে গেল। তার বাবা জানলে তাকে জানে মেরে ফেলবে এই ব্যাপারে। অপরাজিতা হাত ছেড়ে দিল ইয়ানার। ইয়ানা রাগে ভয়ে আর অপমানে একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল।
ইয়ানা বেরিয়ে যেতেই অপরাজিয়া জোরে নিশ্বাস ছাড়লো।
সামির অপরাজিতা আর ফায়াদকে প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য কিছু একটা বলে বের হলো কেবিন থেকে।
সামির বেরিয়ে যেতেই ফায়াদ অপরাজিতার কাছে তাকে পাশের ছোট সোফায় বসিয়ে বলল,
‘এতো কিছু কি দরকার ছিল? সে কিছু বলে নি আমাকে।’
অপরাজিতা চেয়ারে বসেই পেট জড়িয়ে ধরলো ফায়াদকে। শক্ত করে ধরে বলল,
‘ছিল। আপনি তাকে চিনেন না।খুবই খারাপ।’
অপরাজিতা এখনো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে রাগের কারনে। ফায়াদ তা বুঝতে পেরে অপরাজিতাকে ছাড়িয়ে তার পাশে বসে তাকে বুকে জড়িয়ে নিল।অপরাজিতা খামচে ধরলো ফায়াদের পিঠ।এইতো শান্তি! এই বুকেই অপরাজিতার শান্তি।
ফায়াদ অপরাজিতার মাথার পাশে চুমু খেল।তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।বেশ কিছুটা সময় ফায়াদের বুকের মধ্যে থেকে অপরাজিতা শান্ত হলো। শান্ত হতেই অপরাজিতা ধীরস্বরে বলল,
‘আপনাকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাবো আপনি কি বুঝতে পারতেছেন!’
গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো অপরাজিতার।হারানোর ভয় অপরাজিতাকে খুব পীড়া দেয়। সে ফায়াদকে অনেক সাধনা করে পেয়েছে। এক পাক্ষিক ভালোবাসলে যে কতোটা অসহায় লাগে তা অন্য কেউ বুঝবে না। নিজের উপর ভরসা রেখে ফায়াদের অনুভুতির জন্য অপেক্ষা করেছে সে। হারাতে পারবে না। হারালে সে নিজেও হারিয়ে যাবে।
অপরাজিতা বুক থেকে মাথা তুলে ফায়াদের গালে হাত দিয়ে বলল,
‘আমি আপনাকে কতোটা ভেঙে ভালোবেসেছি এটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। আপনাকে হারালে আমি পাগল হয়ে যাবো বিশ্বাস করেন। আমি আপনাকে পাওয়ার জন্য দিনের বেলা পাগলামো করলেও রাতের বেলা বালিশ ভিজিয়েছি চোখের পানিতে৷ মনে হতো এই বুঝি অন্য কেউ এসে নিয়ে গেল। অল্প বয়সী ছিলাম। আবেগ বলুন আর যাই বলুন শুধু আপনাকেই চেয়েছি।’
অপরাজিতার গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। কথাগুলো যেন এক একটা তীরের মতো বিধছে ফায়াদের হৃদয়ে। সে কেন আরেকটু আগে মেয়েটাকে আপন করে নিল না! তাহলে হয়তো তার ফুলের কষ্ট টা একটু কম হতো।ভিতরে সব এলোমেলো লাগছে ফায়াদের কিন্তু বাহিরে সে শান্ত রইলো।
অপরাজিতা আবার বলল,
‘আপনাকে না পেলে আমি–‘
বলতে পারলো না সে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। ফায়াদ অপরাজিতার ভেজা চোখে চুমু খেল। পরপর দুচোখেই। তারপর ডান গালে, তারপর বাম গালে। অপরাজিতা চোখ বন্ধ রেখেই ফায়াদের কাধের শার্ট খামচে ধরলো। তার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে নিরবে। ফায়াদ অপরাজিতার ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল,
‘এটা বাকি থাকলো।বিয়ের পর এর উপর অধিকার খাটাবো।’
তারপর অপরাজিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
‘আমি তোমার। তোমারই হবো।কান্না করবেনা। আমার অসহ্য লাগে তুমি কান্না করলে।’
অপরাজিতা চোখ খুলে তাকালো ফায়াদের দিকে। তারপর আবার মুখ গুজে দিল তার বুকে। ফায়াদও সময় দিল অপরাজিতাকে শান্ত হওয়ার। আজ ইয়ানা নামের মেয়েটার উপস্থিতি আরো একবার জানান দিল ফায়াদকে যে এই ফুলটা তাকে ছাড়া ঝরে যাবে। তাই একে আদর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হবে। খুব মূল্যবান ফুল যার মূল্য হয় না। শুধুর ভালোবাসার ফুল।
(চলবে)