#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭।
মেহুলের ভার্সিটিতে আজ বিশাল প্রোগ্রাম। সকাল থেকেই তাই প্রস্তুতি চলছে। মেহুল আর রিতা বেশ তাড়াতাড়িই আজ ভার্সিটিতে চলে এসেছে। মেহুল অডিটরিয়ারে তার গানের অনুশীলন করছে। রিতা আজ একটা নৃত্য পরিবেশনা করবে তাই সেও তার অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে।
দশটায় অনুষ্ঠান শুরু। ভার্সিটির প্রাঙ্গন ছাত্রছাত্রীদের হৈ চৈ এ মুখোর হয়ে উঠেছে। এখন গ্রীষ্মের শেষের সময়। তবে গরম এখনো কমেনি। তবে অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু তাপপ্রবাহ কম।
ভার্সিটির মাঠের এক কোণেই বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। সেই গাছের বেশ কিছু ফুল মাটিতে পড়ে আছে। মেহুল সেখান থেকে একটা ফুল তুলে কানে গুঁজে। সাদা শুভ্রতায় ঘেরা আদলে তার এই এক টুকরো লাল ফুল যেন চকচক করে জ্বলছে। সাদা রঙটা মেহুলের খুব একটা পছন্দ না। তবে রাবীরের নিশ্চয়ই এই রং টা পছন্দ। তাই তো লোকটার সব পাঞ্জাবী সাদা রঙের। তাই আজ রাবীরের পছন্দের সুবাদেই সে এই সাদা রঙের কামিজটা গায়ে দিয়েছে। কপালের ছোট্ট কালো টিপে আরো বেশি চমৎকার লাগছে তাকে।
_______
অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুভেচ্ছা বার্তার মধ্য দিয়ে প্রোগ্রামের আনুষ্ঠানিকতা পরিপূর্ণ হয়। একে একে সবাই যার যার মতো পারফরমেন্স দিয়ে যায়। এক সময় মেহুলের পালা আসে। গান নিয়ে সে খুব কনফিডেন্ট থাকলেও একটু একটু ভয়ও লাগছে। তার নাম ডাকা হলে সে সাহস নিয়ে স্টেজে যায়। মাইকটা হাতে নিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেলে। নিজেকে ধাতস্ত করে। গাইতে হবে। মন প্রাণ দিয়ে গাইতে হবে। সে সুর তুলে,
“ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ
ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ
দিও তোমার মালা খানি
বাউল এর এই মন টা রে……
…..”
মেহুলের গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত শ্রোতারা সব হৈ হুল্লোড় শুরু করেন। চারদিকে প্রশংসা কানে বাজে। মেহুল খুশি হয়। প্রচন্ড খুশিতে হাত কাঁপছে তার। সবাই তাকে অনুরোধ করে আরেকটা গান করার জন্য।
উপস্থাপিকা বলেন,
‘হ্যাঁ, মেহুল। আরেকটা হয়ে যাক।’
মেহুল মুচকি হেসে মাথা নাড়ে। সে আবার গান ধরে,
“যাও পাখি বলো হাওয়া ছলো ছলো
আবছায়া জানলার কাঁচ
আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাঁকে
রূপকথা আনাচ-কানাচ….
….. …..”
আবারও সবাই উৎসাহে মেতে উঠে। সবার এত উচ্ছ্বাস মেহুল আশা করেনি। সে স্টেজ থেকে নামতেই তার বন্ধুরা ছুটে আসে। তাকে সাধুবাদ জানায়। পরের পারফরমেন্সটা রিতার। তাই মেহুল তাকে অল দ্যা বেস্ট বলে এক কোণে দাঁড়িয়ে যায় তার নাচ দেখার জন্য। রিতার নাচ শেষ হতেই মেহুল একটু ওয়াশরুমের দিকে যায়। তবে তার যাওয়ার মাঝেই কেউ তাকে ডেকে উঠে। মেহুল পঁছন ফিরে চেয়ে দেখে সাদরাজ। মেহুল প্রসন্ন হাসে। জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি মাত্র এসেছেন? আমার পারফরমেন্স তো শেষ।’
‘সৌভাগ্যবশত আমি আপনার পারফরমেন্স দেখতে পেরেছি। And it was just mind-blowing. আপনি এত ভালো গান করেন! তা আপনি কোনো গানের রিয়েলিটি শো তে অংশগ্রহণ করছেন না কেন?’
মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসে। বলে,
‘এখানে গান গাওয়ার অনুমতি পেয়েছি যে এটাই বেশি, আবার রিয়েলিটি শো।’
সাদরাজ প্রশ্ন করে,
‘কেন, আপনার ফ্যামিলি কি আপনাকে সাপোর্ট করে না?’
‘করে, তবে খুব একটা না।’
‘আপনার হাজবেন্ড নিশ্চয়ই আপনাকে সাপোর্ট করেন?’
‘জি।’
‘তাহলে আর সমস্যা কোথায়? একবার চেষ্টা করে দেখুন, আপনি খুব ভালো জায়গায় যেতে পারবেন।’
মেহুল মৃদু হেসে বলল,
‘ধন্যবাদ, আপনাকে। আর আপনি এখানে এসেছেন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি।’
‘আপনি যেখানে আসতে বলেছেন সেখানে না এসে পারি। যাকগে, এসেছি যখন আপনার ভার্সিটিটা তো একটু ঘুরে দেখাতেই পারেন।’
‘জি, অবশ্যই। চলুন।’
মেহুল আর সাদরাজ পাশাপাশি হাঁটছে। মেহুল ভার্সিটির এটা ওটা দেখিয়ে তাকে পরিচিত করাচ্ছে। তবে সাদরাজের মনে এই মুহুর্তে কী চলছে সেটা কেবল সে’ই জানে। মেহুল সাদরাজকে নিয়ে তার ডিপার্টমেন্টের ভেতরে যায়। তখন তাদের পাশ কাটিয়ে দুজন লোক যায়। একজন লোক তখন পাশের জনকে বলে উঠে,
‘আরে এটা সাদরাজ আহমেদ না? সাবেক সংসদ নেতা?’
পাশের লোকটা বলে,
‘হ্যাঁ, আমারও তো তাই মনে হয়। কিন্তু, উনি এখানে কী করছেন?’
‘কী জানি? আর পাশের মেয়েটা কে? উনার বউ নাকি?’
‘হতেও পারে।’
________
‘এই যে দেখুন, এই সবগুলো গাছ আমি লাগিয়েছি। সুন্দর না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা, আপনি কোনো সাবজেক্টে পড়েছেন?’
‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান।’
‘আচ্ছা। আর আপনি এখন এমনিতে কিসে জব করছেন?’
‘ঐ ছোট্ট একটা কম্পানিতে জব করি।’
‘ওহহ।’
‘আচ্ছা, চলুন ঐদিকটাই একটু বসি।’
‘ঠিক আছে, চলুন।’
মেহুল বেশ দূরন্ত রেখে সাদরাজের পাশে বসল। তবে সাদরাজ কথা বলার আগেই মেহুলের ফোন বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে রাবীরের নামটা দেখে মেহুল খুশি হয়। সাদরাজের দিকে চেয়ে বলে,
‘এক্সকিউজ মি।’
সাদরাজ জোরপূর্বক হেসে বলে,
‘কথা বলুন। সমস্যা নেই।’
মেহুল একটু দূরে গিয়ে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রাবীর বলে,
‘কোথায় আপনি? আমি আপনার ভার্সিটির গেইটের সামনে।’
‘আপনি এসেছেন? তখন তাহলে না করেছিলেন কেন?’
‘সময় পেয়েছি তাই চলে এসেছি। এখন আপনি বলুন, আপনি কোথায় আছেন?’
‘আমি তো আমার ডিপার্টমেন্টে আছি। আচ্ছা আপনি দাঁড়ান, আমি আসছি।’
মেহুল কল কেটে সাদরাজের কাছে যায়। হেসে বলে,
‘আমার হাজবেন্ড এসেছেন। চলুন, আজকে আপনাকে উনার সাথে পরিচয় করে দিব।’
সাদরাজ হাসতে পারে না। তাও ঠোঁটের কোণে হাসির ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,
‘জি, অবশ্যই।’
মেহুল আগে আগে হাঁটছে। আর সাদরাজ পেছন পেছন। মেহুল দ্রুত ভার্সিটির গেইটের সামনে যায়। দেখে সত্যি সত্যিই রাবীর দাঁড়িয়ে আছে। সে হেসে রাবীরের কাছে গিয়ে বলে,
‘সেই তো আসলেন। আরেকটু আগে আসলে কী হতো, আমার পারফরমেন্সটা দেখতে পারতেন।’
রাবীর ফোনের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেহুলের দিকে চায়। শুভ্রতায় ছেঁয়ে যাওয়া এক মেঘবালিকা যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কানে গুঁজে রাখা রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া ফুলটা এত সৌভাগ্য নিয়ে কী করে জন্মাল? সে কত নিঁখুত ভাবে তার কুন্তলে জায়গা করে নিয়েছে। যেন আজ তার সুখের দিন। অথচ তার এই সুখ দেখে যে অন্যকারোর প্রচন্ড হিংসে হচ্ছে, সেটা সে বুঝতেই পারছে না। কত নিষ্ঠুর এই ফুল!
রাবীর বলল,
‘সাদা রঙে তো আপনাকে বেশ মানায়।’
‘ঐ যে আপনার বউ না। না মানিয়ে উপায় আছে।’
রাবীর মৃদু হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক।’
মেহুল তখন বলল,
‘ওহহ, আপনার সাথে আজকে একজনের পরিচয় করিয়ে দিব।’
এই বলে সে পেছন ফিরে চেয়ে দেখল, সাদরাজ নেই। মেহুল এদিক ওদিক ভালোভাবে খুঁজল। কিন্তু সাদরাজের আর দেখা পেল না। আশ্চর্য, লোকটা তো তার পেছন পেছনই আসছিলেন। হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলেন?
রাবীর জিজ্ঞেস করল,
‘কাকে খুঁজছেন?’
মেহুল তার দিকে চেয়ে বলল,
‘ঐ যে একটা লোকের কথা বলেছিলাম না, বাবাকে রক্ত দিয়েছিলেন। উনি আজ আমার ভার্সিটিতে এসেছিলেন। বলেছিলাম আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব, আমার পেছনেই তো আসছিলেন। হঠাৎ কোথায় চলে গেলেন?’
‘হয়তো কোনো কাজ পড়ে গিয়েছে তাই চলে গিয়েছেন। থাক, অন্য কোনোদিন নাহয় আবার পরিচিত হওয়া যাবে। এখন আপনি আমার সাথে চলুন, আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।’
‘কোথায়?’
‘চলুন, গেলেই দেখতে পারবেন।’
চলবে…