#আম্মার_সংসার
#পর্ব৭
– যে মায়া ত্যাগ করেছেন সে মায়া আঁকড়ে ধরে বাঁচতে গেলে আপনি চিতায় জ্বলতে থাকা চন্দন কাঠের মতো দগ্ধ হবেন,ফয়সাল ভাই।
– কি যে করবো ছোট বোন এখনো বুঝতে পারছি না। একটু তো সময় লাগবে সব কিছু ঠিকঠাক হতে।
– আপনি যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে ফেলেন।
– যার সাথে এতো মায়ায় জড়িয়ে পরেছিলাম সে মায়া একদিনে তৈরি হয়নি ছোট বোন। দিনের পর দিন ধীরে ধীরে এক সিন্ধু মায়া জমেছিল। সেই মায়ার সিন্ধু কি এক নিমিষেই কাটিয়ে ফেলা সম্ভব?
যন্ত্রণা বেড়ে গেলো টুনি ভালো নেই শুনে। যার জন্য এতো মায়া তার বিরহ অদৃষ্টে লিখে রাখেন কেনো বিধাতা। বিরহ যদি লিখে-ই রাখেন তার জন্য এতো টান এতো মায়া জমিয়ে দেন কেন অন্তরে।
– ফয়সাল ভাই আমি আপনার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। শুধু বলবো এতো প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে আপনি ভালো থাকেন তাতে টুনি আপা কিছু টা হলে শান্তি পাবে। টুনি আপা ভালো নেই শুনে আপনার যেমন লাগছে আপার ও তেমন লাগবে। আপনি কি চান আপনার টুনি খারাপ থাকুক, আপনার খারাপ থাকার কথা শুনে।
ফয়সাল ভাই আর কিছু বললো না। তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মুখ ভর্তি দাঁড়ি,চোখ গুলো স্বাক্ষী দিচ্ছে তার নির্ঘুম রাতের। শুকনা একহারা গড়নের লম্বা শ্যামলা, দেখতে ছেলে টা খুব আহামরি কিছু না । কিন্তু তার মধ্যে যা আছে তা দ্বিতীয় টি মেলা ভার।
বাড়ি ফেরার পথ তার সাথেই পা ফেলে হাঁটছি৷ প্রজাতির পেছনে গুটি গুটি পা’য়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক খানি পথ হেঁটে ফেলেছি কখন, ঠাওর করতে পারিনি।
পলিথিন মোড়ানো গোলাপি রংয়ের হাওয়াই মিঠাই নিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কাঁচাপাকা চুলের মাঝ বয়সী এক চাচা।
– ফয়সাল ভাই হাওয়াই মিঠাই খাবেন?
– আচ্ছা, দুইটা নিয়া নেও।
আমার মোবাইলের কাভারের ভিতরে কিছু টাকা থাকে সবসময় । টাকা বের করে চাচার হাতে দিলাম।
ফয়সাল ভাই তো ধমক দিয়ে বসলো-
– খুব বড় হয়ে গেছিস তাই না রে টায়রা।
– মাঝে মাঝে একটু বড় হতে ইচ্ছে করে ফয়সাল ভাই।
ফয়সাল ভাই ঐ যে দেখেন শ্যাম্পুর বাবল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে আসছে একটা কিনে দেন।
– ছোট বোন তুমি কিন্তু চমৎকার একটা মানুষ তুমি নিজে ও জানো না তোমার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
– আপনি তুই করে বললেই বেশি ভালোলাগে।
ফয়সাল ভাই আমার মাথায় হাত রেখে বললেন-
– পাগলী ।
আমি সারা রাস্তা ফুঁ দিয়ে বাবল উড়াতে উড়াতে খুশ মেজাজে এসেছি। আম্মার সংসারের ঝামেলার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
বাড়ি ফিরে দেখলাম আম্মা বেলুন পিঁড়ি নিয়ে বসে পরোটা বানাচ্ছে আর বকাবকি করছে-
– সংসার, সংসার করতে করতে জীবন শেষ। হিসেব করে দোখি আমার বলতে এই সংসারে আসলে কিছুই নাই।
– আম্মা তুমি উঠো আমি পরোটা বানিয়ে ভেঁজে নিয়ে আসছি। তুমি বরং শুয়ে আরাম করো।
আম্মার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারছি তিনি ভালো নেই। যে কোন সময় একটা দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আর কোন দূর্ঘটনার সম্মুখীন হতে ভালোলাগবে না। অনেক তো হলো এবং হচ্ছে। আজ টুনি আপা কে নিয়ে আসা খুব প্রয়োজন। বেচারি না জানি কেমন করে দিন গুলো পার করছে।
আম্মা উঠে দাঁড়িয়ে কেমন একটা দুল খেলো। দ্রুত তাকে ধরে বসিয়ে আব্বা আর টগর কে ডাক দিলাম।
আম্মা কে নিয়ে এতো বিজি হয়ে পরলাম,কে কখন এ্যাম্বুলেন্স ডাকলো বলতে পারবো না।
রঙ্গন ভাইয়া, টুনি আপা কে জানানো হয়েছে। মাঝ রাতের দিকে এসে রঙ্গন ভাইয়া হসপিটালে এসে পৌঁছেছে। একটু অবাক হয়েছি সাথে অরন্য ও এসেছে।
যদিও তার সাথে আমার টুকটাক কথা ছাড়া তেমন কোন কথা হয়নি।
টুকটাক কথা ছাড়া লম্বা কথা বলার মতো অবস্থা ও নেই।
সিস্টার কে ডাকতে যাওয়ার সময় আমার পেছনে পেছনে এসে বললো-
– এই মেয়ে কেমন আছি জিজ্ঞেস করছো না কেন?
– ভালো আছেন বলে-ই তো এসেছেন।
– আমার কথা বাদ দাও,তুমি কেমন আছো বলো, মানে কেমন ছিলে?
– ভালোই তো আছি,বেঁচে আছি।
– তুমি অভিমান করেছো,আমি বুঝতে পেরেছি।
– না,একদম না। রাগ,অভিমানের সাথে আমার পরিচয় নেই। তবে খুব খারাপ লাগলে নিরবে ফিরে আসি। আপনি আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছেন।
– মেয়ে,এই তো দিলে খুন করে। শোন আগামীকাল বিকেলে চলে যাবো।
– ঠিক আছে সাবধানে যাবেন।
– তোমার খারাপ লাগবে না?
– ‘চলে যাবেন না’ বললে আপনি কি থেকে যাবেন?
আমি যদি বলি আপনার জন্য আমার কষ্ট হয়। আমার সেই কষ্ট কি আপনার বাম অলিন্দ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে? দম বন্ধ হয়ে আসবে আপনার।
না- কি আপনার মস্তিষ্ক একধরনের আনন্দ পাবে এই ভেবে, আপনার জন্য একটা মেয়ের কষ্ট হয়।
– ‘চলে যেও না’ একবার বলে দেখো মেয়ে তোমাকে আমার করে রেখে দেবো।
তার কথায় কর্ণপাত করে লাভ নেই, আরেক ঝামেলায় পরতে হবে। তারচেয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম অরন্য কে পেছনে ফেলে।
পেছন থেকে নিজের হাতে টান অনুভব করলাম। কিছু বুঝে উঠার আগে তার বুকের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম।
চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে কোন রকম তার নেশার ঘোর কাটিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম –
– কি?
– সরি, আমি তোমাকে আটকাতে চাইছিলাম। হ্যাঁচকা টান পরবে বুঝতে পারিনি। তবে তুমি আমার বুকে যে কয়েক সেকেন্ড লেপ্টে ছিলে মনে হচ্ছিল প্রচন্ড তাপে আমাকে পুড়ানো হচ্ছে।
এই মেয়ে আরেক বার আমাকে চেপে ধরবে? প্রচন্ড তাপে পুড়ানো যাবে?
– তাপমাত্রা যত বাড়ানো যাবে চাপের পার্থক্য ততই কমতে থাকবে। তাপমাত্রা আরো বাড়িয়ে চাপ পরিমাপ করতে থাকলে একসময় দেখবেন প্রত্যেকটি গ্যাস-ই p V = n R T p V=n R T pV=nRT সমীকরণ মেনে চলছে।
– রেনোর চাপের সূত্র প্রয়োগ করা লাগবে না ম্যাডাম, আপনাকে লাগবে।
আম্মার স্যালাইন চলছে। অধিকাংশ সময় টুনি আপা কে ডাকছে। আপা কে কল দিয়ে ও লাভ হচ্ছে না। দুলাভাই জানিয়েছে সকালের দিকে আপা কে নিয়ে আসবে।
চলবে….
#তানজীনা_আফরিন_মেরিন