#আম্মার_সংসার
#পর্ব১০(শেষ পর্ব)
নতুন বউ কে নিয়ে আমাদের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব হয়।
টুনি আপা ফুস ফুস করে ভাবির ব্যাবহারের কথা বলে এসেছে আম্মা আব্বা কে।
আম্মা আমরা দুই বোন কে আলাদা ডেকে বললেন –
– রিনি যা বলেছে মনে রাখার দরকার নাই। আমরা যতটুকু পারি তার সাথে ভালো ব্যাবহার করবো। মানুষ প্রথম দিনের আচরণ সারা জীবন মনে রাখে।
টুনি আপা বললো-
– ভাবির প্রথম দিনের আচরণ আমরা কেন তবে ভুলে যাবো?
– তোর মনেরাখতে মনে চাইলে মনেরাখ গিয়ে। এতে খারাপ ছাড়া ভালো কিছু হবে না।
আম্মা রান্নার যোগাড় করছে। গরুর মাংসের কালো ভুনা টা আমার হাতে খুব ভালো হয় সবাই বলে। এই কারনে কালো ভুনা টা আমি রান্নায বসিয়ে অরণ্য কে কল দিলাম।
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম সে এর মাঝে বেশ কয়েক বার কল দিয়েছিল।
ফোন রিসিভ করে প্রথমেই বললো –
– বাসার অবস্থা খুব জটিল নাকি? রঙ্গন ফিরেছে?
– জ্বি ফিরেছে, জীবন সঙ্গী নিয়ে। আপনি বিষয় টা জানতেন?
– না, জানার কি আছে। আমার বন্ধু রঙ্গন। রিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে-ই পড়ে,ক্লাসমেট।
এমনিতে ভালোই সমস্যা হচ্ছে বদরাগী। কখন কি বলে কি করে নিজে ও বুঝতে পারে না।
– হুম তার আচরণে বুঝতে পেরেছি।
– আম্মা-আব্বার প্রতিক্রিয়া কি? কোন ঝামেলা হয়নি তো?
– আম্মা কে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। আম্মা-ই সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিক। তাই আমরা এসব নিয়ে ঝামেলায় যাচ্ছি না।
– টায়রা একটা কথা বলবো?
– হুম বলুন।
– একটা ওম্মা দিবে? বেশি না একটা।
– আরে কি নির্লজ্জ রে বাবা!
– তুমি আদর না দিলে আমি খারাপ হয়ে যাবো।
– খারাপ কি ভাবে হবেন?
– এই তো সিগারেট -বিগারেট খাবো।
– সিগারেট খেল যদি মানুষ খারাপ হতো তাহলে তো আমার আব্বা সবার আগে থাকতো।
– সিগারেট খেলে মানুষ খারাপ হয় না বলছো? কি করলে খারাপ হয় বলো?
– উম্মা দিলে মানুষ খারাপ হয়।
– তাই না কি,আগে বলবা না। তোমাকে উম্মা, উম্মা দিতে দিতে খারাপ হয়ে যেতে চাই টায়রা।
– কি অসভ্য রে বাবা? আমি রাখছি।
– একটা ছোট্ট করে আদর দিয়ে তারপর রাখো লক্ষী মেয়ে।
– রাখলাম।
সকাল বেলা রিনি ভাবি কে নিয়ে সবার ব্যাস্ততা৷ বাড়ির বড় বউ যতটুকু পারা যায় পারিবারিক ভাবেই আয়োজন চলছে।
টুনি আপার শ্বশুর বাড়িতে বলবে কি না এটা নিয়ে সাদিক চাচা আব্বার সাথে বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কারন আপা কে ঐ বাড়িতে আর দিবে কি না এইটা নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থা।
এর মাঝে রিনি ভাবি আপাকে বেশ কয়েকবার খুঁচানোর চেষ্টা করেছে। একটা সময় আপা চোখ-মুখ লাল করে কান্না করতে করতে আব্বা কে বলেছে।
দেখলাম আব্বা ভাবি কে ডেকে বলেন –
-বৌমা দুই কাপ চা আনতে পারবে?
– পারবো।
আমি সম্পূর্ণ বিষয় টা খেয়াল করছি। আব্বা ভাবি কে তার কাছে ডেকে বসালেন। ভাবি টি টেবিলে চা রেখেছে। প্রথম কাপ চা টা হাতে তুলে আব্বা ভাবি কে দিয়ে বলেন –
– আমার সাথে বসে চা খাও বৌমা।
ভাবি একটু ইতস্তত বোধ করে হাতে কাপ নিল।
আব্বা চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন-
– বৌমা মেয়ে বিয়ে দিলে নতুন আরেক টা সম্পর্ক তৈরি হয়। ছেলে বিয়ে দিলে ও নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়। তাই বলে ছেলে মেয়ে পর হয়ে যায় না। তাদের আলাদা সংসার হয় বড়োজোর।
তুমি কি তোমার মা-বাবার পর হয়ে গেছো?
টুনি আমাদের পর হয় নাই।
তুমি যখন বাবার বাড়ি যাবে তোমার ননদরা তোমাকে কত ভালোবাসে এই গল্প টা শোনাবে। দেখবে মা-বাবা কত খুশি হবে,তোমাকে নিয়ে তারা নিশ্চিন্তে থাকবে। তোমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে তোমার মূল্যায়ন সবচেয়ে বেশি থাকবে। তোমার ননদের সাথে যদি সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকে এই গল্প তোমার মা-বাবা কে হতাশ করবে। তারা দুশ্চিন্তায় থাকবে। টুনি, টায়রা খুব সহজ ভাবে চলাচল করে অভ্যস্ত। তারা চাইলে তোমাকে খুঁচানোর চেষ্টা করতে পারে কিন্তু তারা এসব করবে না।
শোন মা,তুমি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপিঠে পড়াশোনা করছো। তোমার জীবনের লক্ষ্য অনেক দূরে থাকবে। এইসব ছোট খাটো বিষয়ে নিয়ে মাথাখাটানো তোমার কাজ না।
আব্বার কথা শুনে ভাবি লজ্জায় গুটিয়ে গেছে বুঝা যাচ্ছে।
ফয়সাল ভাই এসেছে তার সাথে আমাদের পারিবারিক ভাবে সম্পর্ক ভালো। ভালো হবার -ই কথা, সে কোন রকম ঝামেলা করেনি।
আমার রুমে ফয়সাল ভাই বসে আছে।
কিছু নাস্তা নিয়ে টেবিলে রাখলাম। আপা খাটে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো –
– কেমন আছো?
– আছি,দিন চলে যাচ্ছে।
– তোমার চোখ অনেক লাল হয়ে আছে।
– আজকাল চোখ লাল-ই হয়ে থাকে। চোখে কোন সমস্যা বোধহয়। ডাক্তার দেখাতে হবে। তোমার কথা বলো। তুমি কি করতে চাইতেছো?
– আমি তোমার কাছে থাকতে চাই বললে কি রেখে দিবে?
– যে পছন্দের জিনিস ভালো রাখার জন্য অন্য কে দিয়ে দিতে পারে। পছন্দের জিনিস টা খারাপ থাকলে সে নিয়ে আসাতে ও পারে। তুমি কি বুঝতে পারো না আমার কলিজার দৈর্ঘ্য,প্রস্থ?
তোমার সম্মতি দিয়ে-ই দেখো। কোন আইনের তোয়াক্কা করার মানুষ আমি না। যার সব কিছুই হারিয়ে যায় তার কি কোন হারানোর ভয় থাকে।
শুধু মৃত্যু টা-ই বাকি।
– তুমি বরং সংসার করো ফয়সাল। আমাকে নিয়ে আর ভেবো না।
আপা উঠে চলে আসলো। এটা ও আরেক রকম যন্ত্রণা।
আপার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াতের জন্য কল দেয়া হয়েছে।শুক্রবার ভাইয়া -ভাবির রিসিপশন।
বিকেলের আগে আগে বাড়ি উঠোনে কার এসে থামলো। সাদা সোনালী পাড়ের শাড়ি পরে গাড়ি থেকে নেমে আসলো আপার সতীন মানে টুনি আপার বড় আপা।
আপা তার সতীন কে আপা ডাকে। হাতে শঙ্খচূড় গলায় সীতা হার,ঠোঁটে লিব বাম। খোঁপায় গাঁথা রুপার কাঁটা। অত্যন্ত রুচিশীলতা প্রকাশ পাচ্ছে।
টাকা মানুষ কে স্টার প্লাসের সিরিয়ালের রংচং সাজাতে পারলে ও রুচিশীল করতে পারে না।
এই নারী অত্যন্ত রুচিশীল এবং ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন।
বড় ফুফু অনেক কথা বললে ও তিনি খুব বেশি কথা বলছেন না।
তার কথায় বুঝা গেল জমসেদ দুলাভাই কঠোর পরিশ্রমের পরে আজকের এই জায়গায়। সেই শূণ্য পকেটের মানুষটার হাত ধরে ছিল নূরজাহান আপা মানে আপার সতীন। এখনো সেই হাত শক্ত করেই ধরে আছে।
দুলাভাইয়ের বিজনেস এখন নূরজাহান আপা-ই দেখা-শোনা করেন। একটা এগ্রো কোম্পানি দাঁড় করানোর জন্য ব্যাস্ততায় থাকতে হচ্ছে আপা কে।
জমসেদ দুলাভাই অধিকাংশ সময় বিনোদন মূলক কাজে নিজেকে ব্যাস্ত রাখেন। নূরজাহান আপার কথায় বুঝতে পারলাম দুলাভাইয়ের বিয়ে নিয়ে তার চিন্তা করার মতো কোন সময় নেই কারন তার মাথায় আরো অনেক চিন্তা আছে। তারচেয়ে বড় বিষয় দুলাভাই এমন আরেক টা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলুক তিনি চাচ্ছেন না।
নূরজাহান আপা টুনি আপা কে ডেকে বললো-
– তৈরি হও বাড়ি যেতে হবে,শুক্রবার রঙ্গনের রিসিপশন।
টুনি আপা বাধ্য মেয়ের মতো তৈরি হয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। আপার চোখে মুখে কোন চিন্তার ছাপ দেখা গেলো না।
দাদির চোখ এখন অনেক ঘোলাটে দেখায়। আপা কে কাছে ডেকে বললো-
– সারাজীবন পথে পথে কান্দনের তে এসির বাতাসে বইয়্যা কান্দন ভালো। পড়াশোনা কইরা হ্যান করবা ত্যান করবা করো সমস্যা নাই। যেই জায়গায় আছো সেই জায়গা থেকে করো।
তোমার সতীন রে দেখো।
জীবন টা খালি হাসনের লাইগা না,জামাই নিয়া মজা মাস্তির জন্য না। দুনিয়ায় এর চেয়ে ভয়ংকর ভয়ংকর ঘটনা ঘটে।
বুঝতে পারলাম দাদির ঘোলাটে চোখ জীবন টা কে অনেক স্বচ্ছ দেখে।
আম্মা দাদির পানের বাটা থেকে দুইটা পান এক সাথে খিলি বানিয়ে মুখে দিতে দিতে বললেন-
– টুনি চোরাবালি তে পরে গেলে মানুষ সেখানেই থেকে যেতে চায় না। উঠে আসার চেষ্টা করে,শরীর পরিষ্কার করে নতুন করে আবার বাঁচতে চেষ্টা করে।
এটাই জীবনের নিয়ম। তোর নূরজাহান আপা কে দেখ। যে নারী শূন্য পকেটের পুরুষের সাথে ছিল। বিত্তবান পুরুষ হওয়ার সাথে সাথে তার অতীত ভুলে গেছে বলে নূরজাহান কিন্তু ভেঙ্গে পরেনি। মানুষ ভাঙা মানুষের গল্প পছন্দ করে না। কঠিন ভালোবাসা ও একদিন রংবদল করে। ফয়সালের ভালোবাসা ও একদিন হয়তো বদলে যেতো। এর চেয়ে কঠিন সমস্যা হয়তো সৃষ্টি হতে পারতো।
জমসেদ ভাই বিবাহিত এটা আপা প্রথম দিকে মানতে না পারলে ও এখন সে মেনে নিতে পেরেছে।
আপা চলে গেছে।
আগের রাত থেকে মেহমান, আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। শুক্রবার দিন কোলাহল আর আনন্দে কখন যে শেষ হয়ে গেল বুঝতে পারা গেলো না।
দুইদিন পর রঙ্গন ভাই আর ভাবি সকালে ঢাকা চলে গেলো। টুনি আপা আর জমসেদ দুলাভাই আমাদের বাড়িতেই ছিল। বিকেলে তারা ও চলে গেলো।
টগর টা ও হোস্টেলে চলে গেছে কিছু আগে। আব্বা সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী টা পরে আতর মেখে আসরের নামাজ পরতে বের হয়েছে।
আম্মা উঠানের দিকে তাকিয়ে
চুপচাপ বসে চোখের পানি ফেলছে।
একটা সময় আমরা চার ভাই বোন লাটিম ঘুড়িয়েছি,এক্কা দোক্কা খেলার সময় কুত কুত শব্দে বাড়ি মুখর করে রেখেছি।
আজ উঠান জুড়ে নিরবতা নেমেছে।
কেমন জানি নিথর নিস্তব্ধ লাগছে আম্মার কোলাহল পূর্ণ সংসার টা। একটু একটু করে জেনো নিরবতা গ্রাস করছে।
(ধন্যবাদ পাঠক দীর্ঘ সময় ধরে গল্পের পাশে থাকার জন্য।)
#তানজীনা_আফরিন_মেরিন