#আম্মার_সংসার
#পর্ব৬
– আপা তুমি নতুন বউ,এতো কান্নাকাটি করলে চলে। আশেপাশের মানুষ কি বলবে? কেঁদো না তো আমরা আসছি।
টুনি আপার কান্না থামানো গেলো না।
আম্মা বললেন –
– জলদি করো, টুনি টার কি হলো কিছু বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তুমি বরং জামাই কে ফোন দাও ।
আব্বা জমসেদ দুলাভাই কে কল দিলেন। পর পর চারবার দুলাভাই ফোন রিসিভ করলেন না। বুঝতে পারছি আব্বার মনের অবস্থা কি। যদিও তিনি সবাই কে শান্ত হতে বলছেন। আম্মা তো কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে ও তার তৃষ্ণা নিবারণ করা যাচ্ছে না। দরদর করে ঘামছে,খয়েরী রংয়ের ব্লাউজ টা ঘেমে কালচে হয়ে গেছে।
টগর গেছে গাড়ি ডাকতে। টুনি আপাকে আমি কয়েক বার কল দিলাম,সে ও রিসিভ করলো না।
আম্মা কান্না করছে আর সব দোষ আব্বার ঘাড়ে ফেলছে। আব্বা কোন কথা বলছে না। টুনি আপার এখানে বিয়ের বিষয়ে আম্মার আগ্রহ বেশি ছিল।
তারপর ও নিয়ম হলো স্ত্রী রা ভুল করলে স্বামীরা নিরবে সেই ভুলের মাশুল গুনবে।
আব্বা ও এর ব্যাতিক্রম কিছু না।
যাইহোক কোন রকম তৈরি হয়ে টুনি আপার শ্বশুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম।
বিপদে রাস্তা দীর্ঘ হয় ,অসুখের রাত ফুরাতে চায় না।
আপার শ্বশুর বাড়ির বিশাল গেইট। মোঘলে-ই আজম একটা ভাব আছে। বাড়ির ভিউ চমৎকার। বাড়ির বাহিরে গ্রামীণ ভাব,ভেতরে উন্নত সব প্রযুক্তি।
এতো সুখের মাঝে আপার কি এমন দুঃখের গল্প মনেপরেছে? তাছাড়া সে নিজেই রাজি হয়েছে বিয়েতে।
জমসেদ দুলাভাই সোনালী রংয়ের একটা পাঞ্জাবি, হাতে সোনালী ঘড়ি কড়া পারফিউম দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছিলো।
আব্বা-আম্মা কে দেখে দ্রুত এসে কদমবুসি করলো।
অত্যন্ত আদবের সাথে সবাই কে গ্রহণ করলো তারা।
ঘরে ঢোকে আপা কে দেখলাম লাল টুকটুকে কাঞ্জিভরম শাড়ি সবুজ ব্লাউজ, হাত ভর্তি লাল টুকটুকে চুড়ির ফাঁকে ফাঁকে স্বর্নের চিকন চিকন চুড়ি।
আপার বিয়ের বয়স প্রায় বিশ দিন হয়ে গেছে দেখে মনে হচ্ছে গতকাল বিয়ে হয়েছে।
আম্মা-আব্বা আমরা একে অপরের মুখ দেখাদেখি করে চুপ হয়ে রইলাম। ঘটনা কি কিছুই আঁচ করা যাচ্ছে না। মার্বেল পাথরের ডায়নিং টেবিলে বুফে স্টাইলে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে।
আম্মা এসব কিছুতে আটকাচ্ছে না। বারবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত টুনি আপা কে দেখছে। আপার সাথে এখন পর্যন্ত আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি। হয়তো ইচ্ছে করে-ই সুযোগ টা তারা দিচ্ছে না। কিন্তু বুঝা যাচ্ছে না তারা যে সুযোগ দিচ্ছে না।
আম্মা আমাকে বললো –
– এতো আয়োজন এতো কিছু। ফোনে এতো কান্না করলো টুনির মুখ দেখে এখন তো বুঝা-ই যাচ্ছে না। তুই একটু কথা বলে দেখ তো টুনির সাথে। আর শোন টুনি যে কান্না করেছে,ফোন দিয়েছে আমাদের কিছু বলার দরকার নেই এদের কে।
জমসেদ দুলাভাই আমাকে আর টগর কে নিয়ে তাদের অবস্থা প্রতিপত্তি দেখাচ্ছে।
– দেখছো এই রাস্তা টা আমি পিচ ঢালাই করে দিয়েছি রাস্তার জায়গা ও আমার। বর্ষার মওসুমে হাঁটু পানি থাকতো এখানে।
ঐ যে দেখো আমার বাবার কবর।
এই যে শালা সাহেব এখানে দাঁড়িয়ে একটা ভিডিও বানাই। টিকটকে এই ধরনের ভিডিও ভালো ভিউ পায়। ড্রোন দিয়ে ভিডিও টা করব। ইনস্টাগ্রামে ড্রোন দিয়ে করা রিল ভিডিও কিন্তু দ্রুত ভাইরাল হয়।
কি বলবো কিছু বুঝতে পারছি না। চুপা খোর টগর টা ও কেমন জানি চুপ হয়ে গেছে।
বিকেলের দিকে আপার পাশে বসে আছি। জমসেদ দুলাভাই কোথায় আছে বলতে পারবো না।
– আপা তুমি এতো কাঁদছিলে কেনো? এখানে তো সব ঠিকঠাক চলছে। তোমার টিকটিক সেলিব্রিটি জামাই টা কিন্তু খুব মজার।
– টায়রা তোরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা। বাড়ি ফিরে বলবি দাদি গুরুতর অসুস্থ। আমি বাড়ি এসে সব বলবো। এখানে আমি ভালো নেই।
– আপা বলছো কি এইসব? তুমি কি এই কারনে বিয়ের পরে আমাদের সাথে ফোনে কথা বলোনি?
– হ্যা।
– আমরা তো ভাবলাম তুমি রাগ করে কথা বলো না কিংবা নতুন বিয়ে আত্মীয়-স্বজনের ভিড়। বেড়াতে যাচ্ছো এইসব। আপা তোমাকে দেখতে পটের বিবির মতো লাগছে।
– তুই বুঝতে পারবি না। যে যেই পরিস্থিতির স্বীকার সে বুঝতে পারে।
– আপা তোমাকে আমাদের সাথে আজ-ই নিয়ে যাবো। তোমার অবস্থা টা কি আমি জানি না। তুমি ভালো নেই শুনে তোমাকে রেখে যেতে পারবো না আপা।
– জমসেদ যেতে দিবে না,তারপর ও যদি পারিস বলে দেখ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আব্বা কে আমি বলেছি, আপা কে আমাদের সাথে বাড়ি নিয়ে আসতে। আব্বা বলেছে বাড়ি ফিরে ব্যাবস্থা করবে।
সামনে পরীক্ষা রাত জেগে পড়তে হচ্ছে। সকাল নয় টা বাজে। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আকাশ টা ঝকঝকে পরিষ্কার। এখন শরৎ কাল। শরৎতের আকাশ আমার খুব পছন্দ। তুলো ওড়া স্বচ্ছ নীল আকাশ। রক্ত জবা গাছ ভর্তি ফুল। একটা হলুদ প্রজাপতি অনেকক্ষণ ধরে ফুলে ফুলে উড়ছে। দেখেই কেমন সুখ সুখ লাগছে। প্রজাপতি টা খুব কাছ থেকে দেখার জন্য গাছের কাছে গেলাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে পাখা নাচাতে নাচাতে চলে যাচ্ছে। আমি ও নাছোড়বান্দা প্রজাপতির পেছনে পেছনে হাঁটছি।
ফয়সাল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো।
– কেমন আছো ছোট বোন?
– ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?
– বুঝতে পারো না, কেমন থাকার কথা। টুনি কেমন আছে?
– আপা ভালো নেই,কোথাও একটা সমস্যা আছে। ফয়সাল ভাই একটা কথা বলি,
আপার বিয়ের দিন ভয়ে আপনাকে বলতে পারিনি।
আপনি যখন কেয়ামত হয়ে গেছে বলে কাঁদছিলেন আমি তখন অনুশোচনায় পুড়েছি। আপনার চিঠি টা আমি পড়তে গিয়ে রঙ্গন ভাইয়ার হাতে ধরা পরে গিয়েছিল।
এরপর ভাইয়া আপা কে
বুঝালো আপা রাজি হয়ে গেলো বিয়েতে। আমি খুব লজ্জিত।
– ছোট বোন তোমার লজ্জিত হওয়ার কোন কারন নেই। আমাকে যদি এমন চিঠির পিওন বানাতে আমি ও খুলে দেখার লোভ সামলাতে পারতাম না। সবচেয়ে বড় কথা টুনি কারো কথায় বিয়েতে রাজি হয় নাই। আমি টুনি কে বুঝিয়ে বলেছিলাম মা-বাবার মনে দুঃখ দিয়ে আমাদের সুখী হবার দরকার নাই। তারচেয়ে বরং তাদের সুখের জন্য নিজেদের ত্যাগ করা-ই সুখ।
আমার কাছে পরিবার নাই,আমি জানি পরিবার কি জিনিস।
তুমি এই বিষয় নিয়ে লজ্জা পাইও না ছোট বোন।
– ভাইয়া আপনি এসব কি বলছেন! এতো বিশাল একটা হৃদয়ের মানুষ আম্মা-আব্বার চোখের সামনে ছিল তারা বুঝতে-ই পারলো না
সন্ন্যাসীর জীবন বাদ দেন আপনি।
– সংসারীর স্বপ্ন থাকে একদিন সন্ন্যাসী হবে। সন্ন্যাসীর আজন্ম গৃহী হবার গোপন সাধ থাকে,ছোট বোন। গৃহী হতে খুব ইচ্ছে করে।
চলবে….
#তানজীনা_আফরিন_মেরিন