#আম্মার_সংসার
#পর্ব৯
বড় ফুপু আর জমসেদ দুলাভাই মিলে ছোট খাটো ঝগড়ার হাট বসিয়ে দিয়েছে।
আব্বা নিরীহ গোত্রের মানুষ। একটার পর একটা সিগারেট টানছেন। অথচ তিনি কিন্তু চেইন স্মোকার না।
বাড়ির পরিস্থিতি সান্ধ্য ভাষার মতো। কি হবে এখনো ধারনা করতে পারছি না। রঙ্গন ভাইয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে আমাকে কল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে।
আরেক টা কি জানি ঝামেলা তৈরি হয়েছে বললো।
কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম।
শুধু বললো এসে বলবো।
জমসেদ দুলাভাই চলে যাবার সময় আমাকে তার কাছে ডাকলো-
– কিছু বলবেন দুলাভাই?
– টুনি কে বুঝিয়ে বলো,সে আমার কাছে খারাপ থাকবে না। টুনি যে ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল এটা মেনে নিয়ে কিন্তু আমি তাকে বিয়ে করেছি।
– দুলাভাই আপনি আগে বিয়ে করেছেন, এটা আমাদের জানালে পারতেন। আপনি জানাননি কেন , বলেন তো? আপনি জানেন আমাদের পরিবার টা ক্রাইসিস এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে অনেক দিন ধরে। এখন নতুন আরেক ঝামেলা হয়ে গেল। আম্মা কে নিয়ে আমরা খুব চিন্তায় আছি।
– আমার ভুল হয়েছে মানছি,তারপর ও টুনি কে বুঝিয়ে বলো।
আকাশের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। আকাশ টা তেমন আহামরি সাজে সাজেনি।
পেছন থেকে একটা হাত আমার তর্জনী আঙুল ধরেছে। বেশ ভালোই অনুভব করতে পারছি কে। কোন কোন স্পর্শ না দেখেই বুঝতে পারা যায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম –
– আপনি আমার পাশে আরো কিছুক্ষণ থাকবেন?
– মন খারাপ কেন?
– মন খারাপ কি না জানি না। কিছু মানুষ নদীর মতো স্নিগ্ধ,শীতল। সেই মানুষ গুলোর পাশে অকারনে-ই চুপ করে বসে থাকতে ভালো লাগে। আপনি নদীর মতো মানব।
– তুমি তবে আমাকে নদী মানব বলেই ডেকো। তুমি চাইলে আমার পাশে বসতে পারো।
– না। বসতে ইচ্ছে করলে ও বসবো না। সব ইচ্ছা কে আশকারা দিতে নেই।
– টায়ার আমরা কি একে অপর কে ভালোবাসবো না?
– আমার জন্য ভালোবাসা শব্দ টা হয়তো সৃষ্টি হয়নি অরন্য ভাইয়া।
– আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।
– জানেন নদী মানব?
মানুষ যখন কিছু পাবে না জানে তখন আন্দোলন করে, বিক্ষোভ করে।
সেই আন্দোলন, সেই বিক্ষোভ আমরা, না হয় পাথর চাপা দিয়ে হাঁটবো।
আমরা ভিতরে ভিতরে একে অপরের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবো। একটা নগর ধ্বংসের খবর সবাই রাখলেও দুইটা হৃদয় ধ্বংসের খবর কেউ কখনো জানতে পারবে না।
– টায়রা আমি বিক্ষোভ পাথর চাপা দেয়ার মানুষ না।
– আমি না হয় পাথর চাপা দিলাম।
– তুমি মনেরেখো,আমরা কেউ কাউ কে ছেড়ে যাইনি শুধু নিজেদের মন কে শাসন করে আলাদা পথে হাঁটতে শুরু করেছি। সময় এলে ঠিক একই পথে হাঁটবো।
লটকন চলে গেছে। আমার মন খারাপ লাগছে। শুধু খারপ লাগলে ও একটা কথা ছিল। রীতিমতো চোখ বেয়ে বড় বড় ফোঁটায় পানি পরছে।
এই মানুষ গুলো মেঘের মতো আসে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে যায়। আমার হয়েছে জ্বালা,ভুলতে পারছি না।
আমার মন বলছিল সে ফিরে আসবে। চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলবে,কেঁদো না।
সে ফিরো এসেছে আমার চোখের পানি শুকিয়ে যাবার অনেক পরে। আচমকা গালে আলতো করে তার হাত বুলিয়ে বলেছে-
– কান্না করার মতো কিছু হয়নি,বলছি তো আমার বিক্ষোভ থামেনি।
টুনি আপার বিষয় টা কি থেকে কি হয়ে গেলো। ছোট্ট একটা ভুল কত গুলো মানুষ কে পুড়াচ্ছে।
টুনি আপা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে হাঁটাহাঁটি করছে। মনে হচ্ছে কিছুই জেনো হয়নি।
এই এক মাসে আপার পরিবর্তন যা হয়ে তা হলো নাক উঁচু স্বভাব।
আমি দাদির চুল আচঁড়ে বিনুনি করতে বসেছি।
টুনি আপা হাত ইশারায় কাছে ডাকলো-
– কিছু বলবে আপা?
– ফয়সালের কোন খবর জানিস?
– আপা যা গেছে তা গেছে। নতুন করে আরেক ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার?
শুনেছি ফয়সাল ভাইকে একটা মেয়ে নিজে থেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। মেয়েটা ডিভোর্সি।
– ফয়সাল রাজি হয়েছে?
– তোমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে আছে হয়তো। তুমি তো তার সিদ্ধান্তে বিয়ে করেছো, তোমার সিদ্ধান্তে সে বিয়ে করবে।
– তুই একবার ফয়সাল কে ডেকে আনতে পারবি?
– তুমি কল দিলেই পারো।
– ফয়সাল নাম্বার বদলে ফেলেছে।
– আপা জমসেদ দুলাভাই কে নিয়ে কি চিন্তা করেছো?
– এই বিষয়ে পরে তোর সাথে কথা বলছি। তুই ফয়সালের সাথে আমার দেখা করার সুযোগ করে দে।
রাত নয়টা ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির চেয়েও সুন্দর একটা দৃশ্য দেখলাম। এক ঝাক জোনাকি বাড়ির পূবের ভিটার ঝাউ গাছ থেকে টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে দিগবিদিক উড়তে লাগলো।
এমন দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি,দেখবো বলে ও মনে হচ্ছে না।
ঝিকঝিক করে কত গুলো পোকা ডাকছে, এদের শব্দে মাথা ধরে গেছে।
ভাবছিলাম এই সময় এক কাপ চা পেলে ভালো লাগতো। টুনি আপা চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
রঙ্গন ভাইয়া এই ঝুম বৃষ্টি তে সাথে একটা লম্বা মতন মেয়ে কে নিয়ে দৌড়ে আসছে।
এই দৃশ্য টা ও অসম্ভব সুন্দর। মেয়ে টা কে উপন্যাসের বৃষ্টি স্নান এক নায়িকা মনে হচ্ছে। খয়েরী রংয়ের শাড়ি চুড়ি হাত ভর্তি মেহদী, উজ্জ্বল শ্যামলা মেয়েটার নাম রিনি।
চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলাম-
– ভাইয়া এই আপু টা কে?
– তোদের ভাবি। আম্মা অসুস্থ তুই পরিক্ষার পর চলে যাবি ভার্সিটির কোচিং করতে। টুনি টা ও শ্বশুর বাড়িতে থাকবে। রিনি খুব ভালো মেয়ে আম্মার সংসার টা দেখা-শোনা করবে।
রিনি ভাবির রঙ্গন ভাইয়ার কথা ভালো লাগেনি। মুখের উপর বলে বসলো-
– আরে বাপরে! বিয়ের আগে তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না রিনি। বিয়ের পরে এখন বায়েজিদ বোস্তামি। বিয়ের আগেই বলতে তোমাদের একজন কেয়ারটেকার চাই।
আমার তিন ভাই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রিনি ভাবি কে নিয়ে ঘরে গেলাম।
আম্মা কি চিন্তা করবে? আব্বা কি করবে? এসব কোন চিন্তা মাথায় আর কাজ করছে না।
দুর্যোগ যখন আসে তখন এক সাথেই আসে।
রিনি ভাবি আম্মা আব্বা কে কদমবুসি করলো। আম্মা কাঁদছিলো। রঙ্গন ভাইয়া কে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে স্বার্থপর মানুষ মনে হচ্ছে।
পরিবারের এমন অবস্থায় সে এই কাজ টা পরে করলে ও পারতো।
রিনি ভাবি কি জিনিস এটা তার মুখের প্রথম ভষায় বুঝতে পেরে গেছি আমরা দুই বোন।
চলবে…
তানজীনা আফরিন মেরিন