#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব পঁচিশ
২৫.
‘তোমার ভালোবাসা জিতে গিয়েছে। ভালোবাসি অপরাজিতা। ভালোবাসি তোমাকে।’
অপরাজিতা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।তার মনে হচ্ছে সে ভুল কিছু শুনে ফেলেছে।সে কি আদও সঠিক শুনেছে কি না তা নিয়ে তার সন্দেহ হচ্ছে। ফায়াদ এখনো তাকিয়ে আছে অপরাজিতার দিকে। অপরাজিতার মনোভাব এখন তার চেহারা দেখে বুঝতে পারছে না সে।
অপরাজিতা কি বলবে তার তো মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মনে হচ্ছে।তার লাগছে যেনো সে সব কিছু একসাথে পেয়ে গিয়েছে হঠাৎ যার কারনে অনুভূতিরা সব একসাথে দলা পাকাচ্ছে।
সে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু তার কথা আটকে যাচ্ছে।সে কথা গুছাতে পারছে না।অনুভূতিরা আটকে যাচ্ছে। সুখ সুখ লাগছে আবার সেই সুখে কান্নাও পাচ্ছে তার। সে বলতে চেষ্টা করলো,
‘আ আপনি আ আমাকে আপনি–‘
থেমে গেল অপরাজিতা সে বলতে পারছে না। অস্থির লাগছে তার। এতো খুশি সে রাখবে কোথায়? তার ডাক্তার সাহেব তাকে ভালোবাসে বলেছে। তার ভালোবাসা সফল! ডাক্তার সাহেব তাকে ভালোবাসে। তার ভালোবাসা পরিপূর্ণভাবে দুপাক্ষিক। এসব ভেবে ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে সে।
অপরাজিতাকে এমন অস্থির হতে দেখে ফায়াদ তার হাতের মুঠোয় অপরাজিতার হাত নিয়ে বলল,
‘রিল্যাক্স রিল্যাক্স! Take a deep breath!’
অপরাজিতা ফায়াদের কথা শুনলো।লম্বা করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় কেদে দিবে। ফায়াদ কিছু বলতে যাবে তখনি সামির এসে বলল,
‘ভাইয়া! আমাদের নিচে যেতে বলেছে।’
ফায়াদ সেদিকে তাকিয়ে বলল,
‘আসছি’
অপরাজিতা নিজেকে সামাল দিল। ফায়াদ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
‘ঠিক আছো?’
অপরাজিতা মাথা নাড়িয়ে বলল ঠিক আছে।
তারা সবাই নিচে নামলো। নিচে গিয়ে বসতেই আসিফ ইসলাম এবং ফারদিন আহমেদ জানালেন সবাইকে যে আগামী শুক্রবার জুম্মা নামাজের পর তাদের আকদ হবে ঘরোয়াভাবে। পরবর্তী তে অনুষ্ঠান করে মেয়ে তুলে দেওয়া হবে।
খবর শুনে উপস্থিত সবাই খুশি হলো।ছোট আবির তো লাফাচ্ছে আপুর বিয়ে বিয়ে করে। সবার মুখেই হাসি।
হঠাৎই অপরাজিতা এর মাঝে ভ্যা করে কেঁদে দিল। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল সে। ভীষণ ভাবে কান্না করছে।
কান্না দেখে সকলে অস্থির হয়ে উঠলো। রামিসা বেগম তো মেয়ের কাছে এসে মেয়েকে শান্তনা দিচ্ছেন।সবার ধারনা বিয়ে হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি এজন্য সে কাদছে। কিন্তু সে কেনো কাদছে তা একমাত্র ফায়াদ জানে।ফায়াদের মন চাচ্ছে মেয়েটাকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে। উফ মেয়েটাকে কান্না করতে সে নিষেধ করেছিল।অপরাজিতার কান্না তার সহ্য হচ্ছেনা।
রামিসা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আরে পাগলী মেয়ে আমার কান্না করছিস কেন?এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি না।’
আসিফ ইসলাম মেয়েকে বললেন,
‘আম্মাজান তুমি খুশি না?’
অপরাজিতা ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল,
‘তুমি যা করবে তাতেই খুশি আমি।’
বলে সে আড়চোখে ফায়াদের দিকে তাকাল।ফায়াদ তাকে ইশারায় কাদতে মানা করলো।অপরাজিতা মাথা হেলিয়ে বুঝালো সে ঠিক আছে। ফায়াদ চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো যে সে আছে অপরাজিতার সাথে।
অপরাজিতার কান্না থামলো ধীরে ধীরে।রিজু বলল,
‘ভাইয়া আর অপরাজিতা পাশাপাশি আসো একটু।ছবি তুলি কয়েকটা।’
রামিসা বেগম তখন বললেন,
‘হ্যা তোমরা ছবি তুলো।ততক্ষণ না হয় ভাই আপা আপনারা আসুন খাবার খেয়ে নেন।বাচ্চারা সবাই একসাথে খাবে নে।’
বড়রা সবাই ডাইনিংএ গিয়ে বসলো।
ফায়াদ অপরাজিতা পাশাপাশি বসলো। রিজু ছবি তুলবে তাদের। ছবি তুলার মধ্যেই ফায়াদ সবার আড়ালে অপরাজিতার হাত মুঠোবন্দি করলো।ফায়াদ জানে তবুও আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেদেছো কেন?’
অপরাজিতা মাথা টা নিচু করে বলল,
‘আমি আসলে অনুভূতি সামলাতে পারছিলাম না। সব একসাথে কান্না হয়ে গিয়েছে।’
‘উফ কথা পরে বলো তোমরা। ফোনের দিকে তাকাও’
রিজু বলল।
তারপর সকলে মিলে বেশ অনেকগুলো ছবি তুলল।ছবি তুলার পর্ব শেষ হতে তাদেরও ডাক পড়লো ডাইনিং এ।
খাবার খেতে বসে রিজু পড়লো বিপাকে। খেতে বসার শুরু থেকেই সে খেয়াল করছে সামিয়া নামের মেয়েটি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।এ আবার কেমন জালা।এভাবে তো খাওয়া যায় না। রিজু তার পাশে বসা রাফিয়াকে খোচা মেরে নীচু স্বরে বলল,
‘এইহ! এই পিচ্চি মাইয়া আবার আমার দিকে তাকায় আছে কেন?’
রাফিয়া ভালোভাবে দেখলো সামিয়াকে। তারপর মাথা নিচু করে হেসে দিল।রাফিয়াকে হাসতে দেখে ভ্রু কুচকালো রিজু।রাফিয়া রিজুকে একইভাবে নীচু স্বরে বলল,
‘আরো বুঝা যাহ! দেখ গিয়ে এই মেয়ে তোর উপর বা’শ খেয়েছে।সামলা এবার ঠ্যালা।আমি হেল্প করবো না এবার।’
বলে সে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। রিজু সামিয়ার দিকে তাকিয়ে ফাকা ঢোক গিলল।সে এইসব বাচ্চার ঝামেলায় জড়াতে চায় না।কোন দুঃখে গিয়েছিল এরে বোঝাতে। এরই মাঝে রিজু দেখলো সামিয়া তার দিকে তাকিয়ে লজ্জা মাখা হাসি দিয়েছে।তা দেখে রিজু সাথে সাথে খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল,
‘আল্লাহ বাচাও!’
বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো ফায়াদের। বাসায় প্রবেশ করেই ছেলেগুলো সব রুমে না গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল আগে। নীতি, রাফিয়া রুমে গিয়েছে ফ্রেশ হতে। ফায়াদ কিছুক্ষণ বসে তারপর তার বাবা আর ভাইদের ঠেলেঠুলে পাঠালো ফ্রেশ হতে। সকলে ফ্রেশ হয়ে আবার সোফার রুমে বসলো।ফারদিন আহমেদ বসেই বললেন,
‘শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছো তাহলে?’
ফায়াদ মুচকি হাসলো। ফারাজ বলল,
‘করবেনা আবার! তোমার ছেলে প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খেয়ে ডুবে গিয়েছে। খেয়াল রাখা,চোখে চোখে কথা আরো কতো কি যে দেখলাম’
রাফিয়া বলল,
‘আরে ভাই তুমি এতো রোমান্টিক কিভাবে হলে বলো তো!কোনো মেয়ের সাথে কখনো ফ্লার্টও তো করতে দেখলাম না।’
নীতি তাদের কথাবার্তা শুনে অবাকই হচ্ছে। এদের সাথে যত থাকে তত অবাক হয়। এরা এমনভাবে কথা বলে যেন সবাই সবার বন্ধু। কতো সুন্দর বন্ডিং তাদের।মাশাআল্লাহ।
আখি বেগম সবার জন্য চা নিয়ে এসেছে। রিজু সবার আগে এক কাপ চা নিয়ে বলল,
‘এটার এখন খুব দরকার ছিল ফুপ্পি।থ্যাংক ইউ!’
ফায়াদ আর ফারাজ একসাথে বলে উঠলো,
‘চা খাবো না মা।’
আখি বেগম দুজনের দিকেই তাকালেন একবার একবার করে। তারপর হেসে দিয়ে বললেন,
‘জানি জানি। এনেছি কফি। আর নীতি চা খাও তো?’
নীতি বলল,
‘হ্যা হ্যা।’
আখি বেগম আর রাফিয়ার আম্মুও বসলো চা নিয়ে। সকলে ফায়াদের বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। ঘরোয়া ভাবে আকদ হলেও কিছু আয়োজন তো করা লাগবেই। সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
অপরাজিতা শাড়ি টাড়ি খুলে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তখন আবির এসে বলল,
‘আপু৷ তুমি কি চলে যাবা?’
অপরাজিতা ভাইকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘এখন না। তোকে আরো বকা বাকি আছে আমার!’
আবির অভিযোগ করে বলল,
‘বকবে কেন?’
অপরাজিতা গাল গুলো টেনে দিয়ে বলল,
‘চলে গেলে তো আর কেউ বকবে না। তাই সব বকা একসাথে দিয়ে যাবো। ভালো হবে না?’
আবির গাল ফোলাল। অপরাজিতা হেসে দিল। তার ডাক পড়েছে। বসার রুমে গিয়ে দেখলো। মা, খালামণি সব কিছু গুছিয়ে রাখছে। আসিফ ইসলাম সোফায় বসে আছেন। ডাকলেন,
‘এদিকে আসো আম্মা।’
অপরাজিতা গিয়ে বাবার পাশে বসলো।আসিফ ইসলাম মেয়ে বললেন,
‘তুমি আমার উপর রাগ করো নি তো?’
অপরাজিতা বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বাবার বুকে মাথা রেখে বলল,
‘মোটেও না বাবা। আমি তোমার উপর একটুও রাগ নেই।’
আসিফ ইসলাম আবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমি খুশি তো আম্মা?’
অপরাজিতা সে কথার জবাব না দিয়ে বাবাকে বলল,
‘ বাবা কখনো বলা হয় নি তবে জানো তো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’
মেয়ের কথা শুনে আসিফ ইসলাম হেসে দিলেন। তার চোখের কোণে পানি চলে আসলো।তবে তিনি তা প্রকাশ করলেন না। বললেন,
‘আমিও ভালোবাসি আম্মা’
আবির এসে গাল ফুলিয়ে বলল,
‘আমাকে বাসো না?’
আসিফ ইসলাম কিছু বলার আগে অপরাজিতা বলল,
‘না বাসে না’
আবির গাল ফুলিয়ে বাবার দিকে তাকালো। তা দেখে আসিফ ইসলাম হেসে বললেন,
‘বাসি তো আব্বা। আপনাকে ভালোবাসবো না তো কাকে বাসবো?’
অপরাজিতা আবিরকে ভেঙচি কেটে বলল,
‘আমাকে বেশি বাসে।’
রামিসা বেগম ছেলেমেয়েদের কাণ্ড দেখে কাজ করছেন আর মুচকি হাসছেন।আমিনা বেগম বোনকে বলল,
‘তোমার মেয়েটা বড় হয়ে গিয়েছে আপা’
রামিসা বেগম একপলক মেয়ের দিকে তাকালেন। তার মুচকি হাসলেন। মনে মনে বললেন,
‘হুম বড় হয়ে গিয়েছে। কাউকে মনের মাঝে যতন করে ভালোবাসতেও জানে আমার মেয়ে এখন।সুখে থাকুক সে ‘
শুতে শুতে বেশ রাত হয়ে গেল।ফায়াদরা অনেকটা সময় গল্প করে তারপর শুতে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিরা সব সয়ে গেল।প্রশান্তি বয়ে গেল। দেহের শান্তির সাথে মনের শান্তিও বিরাজ করছে।চোখ বন্ধ করলেই সেই মায়াময়ী ফুল ভেসে আসে চোখের সামনে।এ যে কি অনুভূতি তা কেবল যে ভালোবাসে সে জানে।
বেশ কিছুটা সময় পর ফায়াদ গিটারের সুর শুনলো। রাতের সাথে গিটারের সুর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তা বুঝতে পারলো ফায়াদ।তার রুম থেকে আবছা আবছা শুনা যাচ্ছে। এই সুর কোথা থেকে আসছে তা বুঝলো ফায়াদ। দিনের বেলা সকলের সাথে হাসি খুশি থাকলেও রাতে কার সাথে অভিনয় করবে? রাতের আধারে অভিনয় করা যায় না। নিজের সাথে অভিনয় করতে করতে রাতে সে অভিনয়ের বাধ ভেঙে যায়।
সবাই হয়তো শুনলো সে গিটারের সুর। কিন্তু কারো কিছু করার নেই। যার বেদনা, সেটা শুধুই তার। বাকিরা যতই বলুক আমি বুঝি কিন্তু কেউ কারো বেদনা বুঝে না।
ফায়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো।চোখের পাতায় তার ভালোবাসা ভাসছে। কিন্তু কানে কারো ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার করুন সুর আসছে। কিছু লাইন আবছা ভাবে ভেসে আসলো কানে,
‘তুমি আমায় ডাকলা না গো, তুমি রইলা দূরে
তোমার হইয়া অবাক জোছনা ডাকলো অচিন সুরে…’
(চলবে)