#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_১২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
গোধুলি লগ্নে পুরো ছাদটা মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে। বাসায় এসে এত কোলাহল দেখে স্মৃতি ছাদে চলে এসেছে। এত কোলাহলের মধ্যে পড়াশোনা করা যায় না। এমনিতেই বেশি মানুষ স্মৃতির পছন্দ না। বোনের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছে। স্মৃতির আঁখি জোড়া বইয়ের দিকে বিদ্যমান। হালকা বাসাত এসে স্মৃতির ঘনকালো কেশ গুলো উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ছাদের ফুল গাছ গুলো হালকা করে হেলেদুলে পড়ছে। মুহুর্তটা বেশ ভালো লাগছে। স্মৃতি খুব করে সময়টা উপভোগ করছে। নিরিবিলি পরিবেশ স্মৃতির ভিষণ পছন্দের। স্মৃতি পড়ছিল। এমন সময় ছাদে কেউ আসে। মানুষটাকে দেখে স্মৃতি দৃষ্টি নত করে নিল। আরাভ স্মৃতির কাছে এসে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–আমাদের বাসায় অনেক মানুষ। এত কোলাহলে কলেজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারছি না। আমার একটা নিরিবিলি পরিবেশ চাই। তাই ছাদে এসেছিলাম। কাল থেকে তো তোমাদের নির্বাচনী পরীক্ষা। আমি এখানে একটু থাকলে তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে? আরাভের কথায় স্মৃতি মাথা দুলায় যার অর্থ সে বিরক্ত হবে না। আরাভ কথা বাড়ায় না স্মৃতির থেকে দুরত্ব বজায় রেখে, ছাদের কর্ণারে গিয়ে বসলো। স্মৃতি পড়া বাদ দিয়ে আঁড়চোখে আরাভকে দেখছে। মানুষটা এত সুন্দর কেন? আমাকে এলোমেলো করে দিয়ে বলছে, আমি থাকলে তোমার পড়াশোনার সমস্যা হবে? যে পড়াশোনা করবে। তাকেই এলোমেলো করে দিয়েছেন আপনি? পড়াশোনা হবে কি করে? স্মৃতির ভাবনার মাঝে একজন শ্যাম বর্ণের যুবক আসে স্মৃতির কাছে। যুবকটিকে দেখে স্মৃতির চক্ষুদ্বয় জোড়া উত্তপ্ত হয়ে যায়। মুখশ্রী ঘুরিয়ে নেয় অন্য দিকে। কিছুতেই মানুষটার সাথে কথা বলবে না সে। মানুষটা স্মৃতির সামনে এসে, মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল,
–মিষ্টিপাখি আমার কেমন আছিস? স্মৃতির থেকে কোনো উত্তর আসলো না। সে নিরুত্তর রইলো। মানুষটা ডান হাত দিয়ে, ললাট ঘষে হাসোজ্জল মুখ করে বলে উঠলো,
–আমাকে ভুল বঝিস না মিষ্টিপাখি। আমি ইচ্ছে করে দেশ ছাড়িনি। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। না হলে আমি আমার মিষ্টিপাখিকে রেখে এতগুলো প্রহর কাটাতে পারি? তুই একটু আমার পরিস্থিতি বুঝ মিষ্টিপাখি। তুই যেমন আমাকে ভালোবাসিস। আমিও তোকে ভিষণ ভালোবাসি। কথা গুলো বলেই স্মৃতির ডান হাতটা হালকা ভাবে ধরে সামনের দিকে ঘোরালো। সামনের দিকে ঘুরতে ঘুরতে দেখলো আরাভ চলে যাচ্ছে। মুখশ্রীতে গম্ভীর্য ভাব বিদ্যমান। স্মৃতি রক্তিম চোখে মুনতাসীরের দিকে তাকালো। মুনতাসীর স্মৃতির হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
–দুঃখিত মিষ্টিপাখি। আমি ভুলেই গিয়ে ছিলাম? তুই বড় হয়ে গিয়েছিস। তুই আর আমার সেই ছোট্ট মিষ্টিপাখি নেই। এখন তোর অনুমতি না নিয়ে, তোকে স্পর্শ করা যাবে না। তোর অনুমতি না নিয়ে, তোকে স্পর্শ করে ফেলছি। আমার ভুল হয়েছে। প্লিজ আমাকে মাফ করে দে মিষ্টিপাখি। স্মৃতি বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল,
–কালকে আমার পরীক্ষা। আমি এখন পড়তে বসবো। আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হব। কারো জন্য আমার পড়াশোনার ক্ষতি হোক। এটা আমি চাই না। আপনি এখুন এখানে থেকে আসতে পারেন। মাকে কতবার বলে আসছি। ছাদে যেন কেউ না আসে। তবুও কেন যে, যাকে তাকে ছাদে পাঠিয়ে দেয়। স্মৃতির বিরক্তি মাখা মুখখানা দেখে, মুনতাসীর হেসে দিল। নিজের মাথা চুলকে কোনো কথা না বলে, ছাদ থেকে নেমে গেল। মুনতাসীর যেতেই স্মৃতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। মানুষটাকে আর দেখতে ইচ্ছে করে না। মানুষটার নিখুঁত অভিনয়ে আর ভুলতে ইচ্ছে করে না। একটা সময় মানুষটার জন্য মনের মধ্যে প্রচুর মায়া ছিল। এখন আর মানুষটার জন্য অনুভূতি কাজ করে না। সে কি এমন চেয়েছিল। একটু বড় ভাইয়ের ভালোবাসা ছাড়া। তার যদি নিজের বড় ভাই থাকতো। তাহলে কি মুনতাসীরের কাছে থেকে বড় ভাইয়ের ভালোবাসা চাইতো? মানুষটা নিজের স্বার্থের জন্য সবাইকে ছেড়ে যেতে দু’বার ভাবলো না। এমন মানুষ জীবনে থাকার থেকে না থাকাই অনেক ভালো। যেসব মানুষ আমার ভালোবাসা পাবার যোগ্য ছিল না। আমি সেই সব মানুষদেরও ভালোবেসেছি। অযোগ্য ব্যক্তিকে যখন যোগ্য করে তুললাম। সে নিজেকে মহান কিছু ভাবতে শুরু করল। মানুষ হয়তো জানে না। যে প্রচন্ড ভালোবেসে কাছে টানতে জানে। সে প্রচন্ড ঘৃণা করে, দূর সরাতেও জানে। নিজেকে এত মহা মূল্যবান ভাবার কিছুই নেই মুনতাসীর ভাইয়া। ভিষণের থেকে ভিষণ খারাপ মানুষ আমি। পায়ের নিচের জুতা যতই সুন্দর হোক না কেনো? সে কিন্তু সারাজীবন পায়ের নিচেই থাকে, কখনো মাথায় উঠতে পারে না। তুমিও ঠিক আমাদের বাসায় পায়ের জুতা ছিলে? আজ কিছু অর্থের মালিক হয়েছো বলে, সবাই তোমাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তুমি আমার সাথে যা করেছিলে, সেই সত্যিটা যদি সবাই জেনে যায়। তোমার ভালোবাসা কোথায় যাবে? এটা একবার ভেবে দেখেছো মুনতাসীর ভাইয়া? কথা গুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। অতীতের সেই ভয়ংকর রাতের কথা মনে হতেই স্মৃতির পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে উঠলো। চোখের কার্নিশে অশ্রুকণা জাম হলো। স্মৃতির নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে স্মৃতির। সে মেনেই নিতে পারছে না। তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা তার সাথে এমনটা করতে পারে। মানুষ একবার ভুল করলে তাকে সুযোগ দিয়ে হয় মুনতাসীর আরিয়ান। আমিও তোমাকে সুযোগ দিয়েছি। এরপরে আর কখনো আমার সাথে এমন করার চেষ্টা করলে, তোমার জীবন নিয়ে নিব আমি। ভুলে যেও না। আমি আর সেই ছোট্ট স্মৃতি নেই। স্মৃতি ভাবনার মাঝেই কিছু বাক্য স্মৃতির কর্ণকুহরে এসে পৌঁছালো। বাক্য গুলো কোথায় থেকে আসছে? তা দেখার জন্য স্মৃতি আঁখি জোড়া মেলে পেছনের দিকে তাকালো। আরাভ ফোনে কাউকে বলছে,
–আঘাত কি পর মানুষ করে? আঘাত নিজের মানুষেরাই করে। দুর্বলতার কথা তো বাহিরের মানুষ জানে না। আপন মানুষরাই জানে। মানুষ আমাকে যতবার অসহায় করতে চেয়েছে। আমার রব ততবারই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ছোট হতে দেয়নি। অসহায় হতে দেয়নি। শুকরিয়া। যাদের আমাকে ছাড়া চলবে না। তারা আমাকে বুঝিয়ে দেয়। তাদের ছাড়া আমি চলতে পারবো না। বলি কি এক মাঘে শীত যায়? কিছু কিছু মানুষকে ছাড়া আরাভের সারাজীবন চলে যাবে। তাদের কোনো প্রয়োজন আরাভের জীবনে নেই। তবে তারা আরাভকে ছাড়া চলতে পারবে না। একটা না একটা সময় আরাভের কাছেই আসতে হবে। এবার আর আরাভ গলবে না। মানুষ সরলতার সুযোগ নিয়ে বহুত আঘাত করেছে আর নয়। এবার আমার কাছে আসে যেন, আমিও বিষাক্ত কথায় শেষ করে ফেলবো। কোনো ময়লা আবর্জনার স্থান আমার জীবনে নেই। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। কথাটা আজ ভিষণ করে উপলব্ধি করতে পারছি। মানুষ আমার থেকে কতদিন পালিয়ে বেড়াবে। একদিন না একদিন আমার কাছে এসে ধরা দিতেই হবে। সেদিনের আর বেশি দেরি নেই। আনন্দ উল্লাস করার জন্য প্রস্তুত হ। ফোনে এতকিছু বলা সম্ভব নয়। আমি বিকেলে আসছি। বাকি কথা দেখা হলে বলবো। আপাতত সে তার বোনকে নিয়ে দেশে আসছে। কোথায় আছে খুঁজে বের কর। তার বোনকে আমার যেকোনো মূল্যে চাই মানে চাই৷ আমার কলিজাটা এতদিন জ্বলে পুড়ে, ছারখার হয়েছে। আমি প্রতিটি প্রহর, প্রতিটি সময় মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করেছি। আমাকে তুই বাঁচা প্লিজ। আমি আর পারছি না। আমি ম’রে’ যাব। এভাবে বাঁ’চ’তে পারবো না। কথা গুলো বলতে বলতে আরাভের পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। কথা গুলো গলায় এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। নিস্তেজ হয়ে ছাদেই গা এলিয়ে দিল। যখনই অতীতের কথা গুলো মনে এনে হানা দেয়। তখনই আরাভের পুরো শরীর অবশ হয়ে আসে। মনের গহীনে থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। এত কঠিন একটা মানুষের এমন রুপ রেখে, স্মৃতি বিস্ময় নয়নে মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটার কিসের এত কষ্ট? আমি কি যাব তার কাছে? আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে? দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে স্মৃতি। মাথা কাজ করছে না স্মৃতির। আরাভকে সে ভালো মতোই চিনে। নিজের কষ্ট গুলো কারো সাথে শেয়ার করার মতো ছেলে আরাভ না। সে দুঃখ পুষতে ভালোবাসে। দুঃখই নাকি তার জীবনের সঙ্গী। মানুষটাকে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে ইচ্ছে করে। কিন্তু স্রুতির মতো তাকে-ও যদি কষ্ট পেতে হয়। সে এটা মনে নিতে পারবে না। তাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আজকে তার সাথে হচ্ছেটা কি? সবকিছু কেমন জানি উলটা-পাল্টা হয়ে যাচ্ছে। পুরো পৃথিবী স্মৃতির কাছে এলোমেলো লাগছে। এমন সময় স্রুতি আর অভ্র আসে ছাদে। দু’জনকে দুই প্রান্তে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে, আঁতকে উঠলো অভ্র আর স্রুতি।
চলবে…..