তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ২২ ||

0
566

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ২২ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

শহর থেকে গ্রামের পরিবেশ নিতান্তই দারুণ। গ্রামে আছে ফুরফুরে শীতল বাতাশ। পথের ধারে সারি সারি গাছ। পুকুর জুড়ে ছোট বড়ো মাছের সমারহ। ঝাক বেঁধে হাসেরা খেলা করছে। দামাল ছেলেরা মাঠে ছোটাছুটি করছে। কোলাহল কম। সারি সারি ঢেউ খেলানো সবুজ ধান ক্ষেত।

আহানদের গ্রামের বাড়িতে আহানরা সবাই এসেছে। মাসখানেক ধরেই আহান এর দাদি অসুস্থ। তাই তিনি আহানের বাবাসহ সবাইকে দেখতে চেয়েছেন। যখন শুনেছেন আহান বিয়ে করেছে, উনি মীরাকে দেখার জন্য ছটপট করতে থাকেন। তাই আহানও তিন দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে সবার সাথে। আহানদের দাদার বাড়ি মাটির গুদাম ঘর। অনেক বছরের পুরোনো। আহানদের কাকারা এটা ভেঙে নতুন ঘর বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু আহানের দাদি নিজের স্বামীর শেষ স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চান, তাই উনি এটা ভাঙতে দেননি। এ জন্য আহানের এক কাকা রাগারাগি করে অন্য জায়গায় বাড়ি করে। দাদির সাথে আরেক কাকা থাকেন তার স্ত্রী ও সন্তানসহ।

মীরা এই প্রথম এমন মাটির গুদাম ঘর দেখেছে। মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখতে ব্যস্ত সে। আহানের দাদি, কাকা ও চাচির সাথে তার আলাপ হয়েছে। দাদি যেন প্রথম সাক্ষাৎতেই মীরাকে আপন করে নিয়েছেন। মীরা ভাবে, মাটির ঘরও এতো সুন্দর হয়! অনেকদিন পর আহানরা আসায় আহানের কাকা আজ পুকুর থেকে মাছ উঠাবেন বলেছেন। তাদের বাড়ির সামনেই এক বিশাল পুকুর রয়েছে। আরও বিভিন্ন ফল, শাক সবজির গাছ লাগানো পুরো বাড়ির অর্ধাংশে। পুকুরে মাছ ধরার কথা শুনেই আহান আর আয়ান লাফ দিয়ে উঠে। মুহুর্তেই নিজেদের পোশাক পালটে নেয়। শার্ট পেন্ট ছেড়ে সেন্টু গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে নেয়। আহানকে লুঙ্গি পরা অবস্থায় দেখে মীরার চক্ষু চড়কগাছ! একদম গ্রামের ছেলেদের মতো লাগছে ওদের। আহানের কাকা জাল নিয়ে যায়। আহান ও আয়ান বালতি নিয়ে তার পিছু পিছু যায়। মীরা ওদের কাণ্ড দেখছিল।

আহানের এক চাচাতো বোন নাম অনু। ক্লাস টেনে পড়ে সে৷ অনু মীরার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। মীরাকে নিয়ে সে পুরো বাড়ি ঘুরাতে নিয়ে যায়। মীরা শাড়ি পরে এসেছে। প্রথমবার কোথাও বেড়াতে এলে শাড়ি পরে যেতে হয়। এটাই মীরার মা তাকে শিখিয়েছে। বড়ো বড়ো ফল গাছ গুলো দেখে মীরার ইচ্ছে হলো গাছে উঠার। মীরার অনেকদিনের শখ, সে গাছে উঠে ফল ছিড়ে খাবে। যেমনটা সে নানার বাড়িতে করত। তার নানার বাড়িতে একটা বাঁকা বড়ই গাছ ছিল, যখনই বড়ই ধরতো ও গাছে উঠে ছিড়ে ছিড়ে খেত। এখানেও অনেক গাছ আছে। জলপাই, বড়ই, চালতা ইত্যাদি। মীরা জলপাই গাছে জলপাই দেখেই লাফিয়ে উঠল। শাড়ি নিয়েই জলপাই গাছে উঠার প্রস্তুতি নিল সে। অনু বড়ো বড়ো চোখ করে বলল, “অ্যাঁই ভাবি! শাড়ি পরে তুমি গাছে উঠবে?”
মীরা বলল, “কেন শাড়ি পরে কেউ গাছে উঠে না?”
অনু বাঁকা হেসে বলল, “যদি পড়ে যাও?”
“পড়ব না। তুমি দেখো আমি কিভাবে গাছে উঠি। একটা ঝুড়ি নিয়ে আসলে ভালো হতো, জলপাইগুলো নিতে পারতাম।”
“তুমি ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচে ফেল। আমি কুড়িয়ে আমার ওড়নার নিচ্ছি।”
মীরা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে নিল। আস্তে আস্তে গাছ বেয়ে উপরে উঠতে লাগে।
অনু তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। গাছে উঠে একটা ঢালের উপর বসে জলপাই পারতে থাকে। তারপর সেগুলো অনুর উদ্দেশ্য নিচে ফেলে দেয়। অনু জলপাইগুলো কুঁড়িয়ে নিজের ওড়নায় নিয়ে নেয়। শেষে মীরা একটা ঢালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। অনুকে বলে, “গাছটা মোটা না হলেও লম্বা বেশি। দেখো কত উঁচুতে আমি বসে আছি।”
“ভাবি, নিচে নেমে এসো। পড়ে যাবে।”
“এভাবে পা ঝুলিয়ে রাখতে আমার ভিষণ ভালো লাগছে।”
মীরা একটা চিকন ঢালে বসে ছিল। হঠাৎ করেই ঢালটা অর্ধেক ভেঙে যায়। মীরা পড়ে যেতে নেয়। এক হাত দিয়ে অর্ধেক ভেঙে যাওয়া ঢালটা ধরে ঝুলছে সে। অনু ভয় পেয়ে যায়। মীরা চিৎকার করে বলে, “অনু! প্লিজ হেল্প।”
“আমি বলেছিলাম ভাবি তুমি শোননি। এখন কি করব! তুমি তো অনেক উঁচুতে আছো।”
“ঢালটা ভেঙে যাচ্ছে, প্লিজ কিছু একটা করো।”
.
আহান পুকুরের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল। ডান দিকে বাগানটায় চোখ পড়তে দেখে ওখানে কিছু একটা ঘটেছে। অনু নিচে দাঁড়িয়ে আছে, আর কেউ যেন গাছে ঝুলছে। আহানের হঠাৎ মনে পড়ল মীরার কথা। অনুর সাথেই তো মীরা ছিল। এ আবার মীরা নয়তো? আহান বালতি রেখে পুকুর থেকে উঠে যায়। তা দেখে আয়ান জিগ্যেস করে, “ভাই কি হয়েছে?”
আহান যেতে যেতে বলে, “তোর ভাবির বিপদ।”
আয়ান বুঝলো না কি বিপদ। তার কাকা তাকে ডাকছে, সে কাকার ওখানেই চলে যায়।

আহান দৌড়ে এসে থামে জলপাই গাছে সামনে। মীরাকে ঝুলতে দেখে গাছের ঢালে। আহান বলে, “গাছে উঠেছ কেন? অনু? কি হয়েছে?”
“ভাইয়া কি বলব, ভাবি জলপাই পারতে গাছে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ ঢালটা অর্ধেক ভেঙে যায়, যার ফলে ভাবিও পরে যেতে চায়। কিন্তু ঢালটা বোধয় এক্ষুনি ভেঙে পরবে। আর ভাবি সোজা নিচে।”
“তুমি হাত ছেড়ে দাও।”
“আপনি পাগল হয়ে গেছেন? হাত ছেড়ে দিলে আমি পরে যাব।”
“পরলে আমি আছি। হাত ছেড়ে দিন।”
“আপনি কি আমাকে মেরে ফেলার প্লান করছেন নাকি?”
“বললাম না হাত ছাড়তে।”
আহানের ধমকে মীরা হাত ছেড়ে দেয়। আর পরে যেতে যেতেই চিৎকার দিয়ে উঠে। “আয়ায়ায়ায়ায়া!!”
আহান নিজেকে শক্ত রেখে মীরাকে ধরে ফেলে৷ কিন্তু তাল সামলাতে পারে না। মীরাকে নিয়েই ধপ করে মাটিতে পরে যায়। আহান নিচে আর মীরা আহানের উপরে। দুজনেই ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে থেকে। একটু পর মীরা মাথা তুলে আহানের দিকে তাকায়। আহানের ভেজা শরীরের সাথে লেগে মীরাও কিছুটা ভিজে যায়। আহান ও মীরা একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা আহানকে মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিচ্ছে। আজ আহান না থাকলে হয়তো মীরার হাত পা ভেঙেই যেত। অনু লাজুক হেসে বলে, “আর কত রোমান্স করবে তোমরা? এবার তো ছাড়ো।”
অনুর কথায় ভিষণ লজ্জা পায় মীরা। চট করেই উঠে যায় আহানের শরীরের উপর থেকে। নিজের হাত পা ঝাড়তে থাকে। আহান উঠে কড়া ধমক দিয়ে বলে, “আর কখনো যেন আমি গাছে উঠতে না দেখি।”
একথা বলেই আহান চলে যায়। তখন অনু বলে, “শিক্ষা হলো? এবার চলো, লবণ মরিচ দিয়ে এগুলো খাব। উফফ, এক্ষুনি জ্বিভে পানি এসে গেছে। চলো চলো।”
মীরার হাত ধরে অনু তাকে ঘরে নিয়ে যায়।


রাত নয়টা সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করল। পুকুরের বড়ো মাছ রান্না করা হলো। সবাই তৃপ্তী ভরে খেল। মীরার কাছে বেশ ভালোই লেগেছে রান্নাটা। একদম ঠিক তার মায়ের হাতের রান্না যেন। উঠনে পাটি বিছিয়ে আহান, আয়ান, মীরা ও অনু বসে আছে। অনেক আড্ডা দিতে থাকে তারা। আহানের একটা ফোন আসায় সে ওখান থেকে উঠে যায়। মীরার অনেক পানি পিপাসা পায়, তাই সে অনুকে বলে এক গ্লাস পানি আনার জন্য। এখন শুধু আয়ান আর মীরা বসে আছে। আয়ান মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “সাবধানে থাকবে।”
মীরা ভ্রু কুচকিয়ে জিগ্যেস করে, “কেন?”
“এখানে ভুতের আনাগোনা বেশি। রাতের বেলা অদ্ভুত আওয়াজ শোণা যায়। কালো ছায়া ঘুরঘুর করে। লোকজন দেখেছে।”
“তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? আমি এসব বিশ্বাস করিনা।”
“তোমার ভালোর জন্য বললাম। বিশ্বাস করো না করো তোমার ব্যাপার।”
মীরা কিছু বলল না। একটু পর অনু পানি নিয়ে আসে। মীরা পানি খেয়েই ঘরে চলে যায়।


মাটির ঘরে ডিপ ডিপ করে হারিকেনের আলো জ্বলছে। পুরো ঘর আলোকিত করে রেখেছে ওই ক্ষুদ্র আলো। একটা ছোট জানালা আছে, তবে সেটা খোলাই। মীরা তাদের রুমটা ভালো করে দেখছে। বেশি কিছু নেই, একটা খাট আর একটা আলমারি আছে এখানে। আহান ফোনে ফেসবুক স্ক্রল করছে। মীরা জানালার পাশে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার আলো দেখছে। হঠাৎ করেই সে যেন কিছুর আওয়াজ শুনতে পায়। মীরা প্রথমে ধ্যান দিল না। কিন্তু আওয়াজ টা তীব্র হয়ে জানালার ধারেই আসছিল। মীরা একটু ভয় পায়। আয়ানের কথাগুলো মনে পড়ে। জানালা থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। আহান ফোন রেখে ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে, “কি হয়েছে?”
মীরা কিছু বলা না। হারিকেনের তেল শেষ হয়ে যাওয়ায় মৃদু মৃদু আলো জ্বলছে। কাঁপা আলোতে মীরার আরও ভয় হচ্ছে। আহান মীরার কাছে যায়। কাঁধে হাত রেখে বলে, “কি হয়েছে বলবে?”
“কিছুনা।”
“আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছ। কি হয়েছে খুলে বল।”
মীরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে মাটির দেওয়ালে একটা ছায়া দেখতে পায়। বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করছে সেই ছায়াটা। মীরার আত্মা শুকিয়ে যায়। সে জোরে এক চিৎকার দিয়ে আহানকে জড়িয়ে ধরে। আহান বাকরুদ্ধ! মীরার এমন জড়িয়ে ধরা আহানের কাছে অন্যরকম ভালো লাগার সৃষ্টি হচ্ছে। বুকের ভিতর উথাল-পাতাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন রয়ে গেছে, হঠাৎ কি হলো মীরার? পুরো ঘরের মাঝে পিন পিন নিরবতা বিদ্যমান। হারিকেনের আলো নিভে গেছে। অন্ধকার হয়ে আছে সারা ঘর। মীরা আরও আকড়ে ধরলো আহানকে। আহান কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছেনা। মীরা কেমন যেন কাঁপছে। আহান নিজের দু’হাতে মীরাকে আগলে নিল। এক হাত দিয়ে মাথা বুলাতে বুলাতে বলল, “আমি আছি। ভয় পেও না।”
জানালার পাশ থেকে ঝিঝি পোকা ডাকছে। তার সাথে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ছমছমে সেই আওয়াজে মীরা বারবার শিউরে উঠছে। বিড়বিড় করে বলছে, “আমায় ছেড়ে যাবেন না। আমায় ছেড়ে যাবেন না।”
“আমি কোথাও যাচ্ছিনা মীরা।”
আহান এখন মীরাকে তুমি বলে ডাকে। মীরা এতে খুব খুশি হয়। ভয় পেয়ে মীরা নিজেও নড়ছেনা। আর আহানকেও ছাড়ছেনা। ওভাবেই আহানকে জড়িয়ে ধরে আছে।
বাধ্য হয়ে আহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মীরা ঘুমিয়ে পড়ে আহানের বুকে। আহান তা বুঝতে পেরে মীরাকে কোলে তুলে নেয়। বিছানায় শুইয়ে কাঁথা টেনে দেয়। নিজেও মীরার অপরপাশে শুয়ে পড়ে। মীরার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আহান। কি নিষ্পাপ মুখশ্রী! কোমল ও স্নিগ্ধ। মীরার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আহানও ঘুমিয়ে যায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here