বিয়ে বাড়িতে অচেনা এক যুবকের সাথে ধাক্কা খেয়ে সোজা কাঁদায় পড়ে গেল মীরা। পড়নের শাড়িটি কাঁদা লেগে ভরে গেছে। মীরার বান্ধবীরা তাকে ধরে কাঁদা থেকে টেনে উঠালো। অচেনা যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে স্যরি বলার জন্য। মীরার বান্ধবীরা সবাই তেড়ে আসলো সে যুবকটির দিকে। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলো, “চোখে দেখেন না? একজনকে ধাক্কা দিয়ে কাঁদায় ফেলে দিলেন। এটা কোন ধরণের অসভ্যতা।”
অচেনা যুবকটি অপরাধী হয়ে বলে, “স্যরি, আমি ওনাকে খেয়াল করিনি আসলে।”
অন্য একটি মেয়ে বলল, “খেয়াল করেননি মানে কি? এভাবে কাউকে ধাক্কা দেয়?”
ছেলেটি আবারও বলে, “স্যরি বললাম তো।”
মীরা এবার সবাইকে থামিয়ে বলে, “হচ্ছেটা কি এখানে? কেন ওনাকে এভাবে বলছিস? উনিতো স্যরি বলেছেন নাকি? এতো কথা বাড়াস কেন?”
মীরা মুড অফ করে ওখান থেকে চলে গেলো। শাড়িটি ওর খুব পছন্দের ছিল। এটা তার ভাইয়ের দেওয়া প্রথম শাড়ি। খুব যত্ন করে ও রেখে দিয়েছিল। ভেবেছিল ভাইয়ের বিয়ের সময় এটা পড়বে। এবং সে পড়েছিলও। আজ তার ভাইয়ের হলুদ সন্ধ্যা। সে আজ তার ভাইয়ের দেওয়া শাড়িটিই পড়েছিল। কিন্তু সেটা অনুষ্ঠান পর্যন্ত গায়ে রাখতে পারলো না। মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে গেলো তার। রুমে এসে আলমারি থেকে অন্য একটা শাড়ি বের করে নিল। কাঁদাযুক্ত শাড়িটি পরিবর্তন করে নতুন শাড়ি পড়ে নিল। নিজেকে একটু পরিপাটি করে রুম থেকে চলে গেল সবার কাছে।
পরপর দুইদিন বৃষ্টি হওয়ার পর আজ চারদিন হলো রোদ উঠেছে। মীরাদের বাসার আশপাশ পরিষ্কার করে আজ ওদের বাসার সামনের জায়গাতে স্টেজ করা হয়েছে। তবে হাটার রাস্তায় একটু কাঁদা আছে। আজ সেই রাস্তাতেই মীরা পড়ে গেল। মীরা সবার সাথে যোগ দিল। হেসে হেসে বান্ধবীদের সাথে কথা বলছিল সে। হঠাৎ চোখ পড়লো তার ভাইয়ের পাশে থাকা একটা সুদর্শন ছেলের উপর। এই ছেলের সাথেই তো একটু আগে সে ধাক্কা খেল। এই ছেলেটা কে? আগে তো তার ভাইয়ের সাথে কখনো দেখেনি তাকে। ভাইয়ার ফ্রেন্ড? এইসব ভাবার মাথায়ই দেখল তার ভাইয়া তাকে ডাকছে। মীরা পা চালিয়ে তার ভাইয়ের কাছে গেল। তার ভাইয়া তাকে দেখে বলে, “মীরা তোকে আজ একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব। তোকে সবসময় বলতাম না আমার একটা ফ্রেন্ড আছে, সে ভিষণ লাজুক। এই যে এ-ই হচ্ছে আমার সে-ই লাজুক ফ্রেন্ড আহান।”
মীরার ভাই সামনে থেকে সরে গিয়ে তার ফ্রেন্ডকে দেখিয়ে দেয়। মীরা মুখে হাসির রেখা টেনে ছেলেটাকে বলে, “আসসালামু আলাইকুম।”
ছেলেটাও মুচকি হেসে সালামের জবাব দেয়। মীরার ভাই বলে, “জানিস ও আমাদের থানায় নতুন পুলিশ ইনিস্পেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছে।”
মীরার মুখ মলিন হয়ে গেল। পুলিশ? এই পৃথিবীতে যদি বিরক্তি কিছু থাকে, তাহলে মীরার কাছে সেটা হচ্ছে পুলিশ। সে পুলিশদের একেবারেই দেখতে পারে না। তার ভাই আবার হাসতে হাসতে বলে, “জানিস আহান, মীরা আবার পুলিশদের একটুও সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু কি করে বুঝাই, সব পুলিশ এক না।”
মীরার ভাই মিরাজের চোখ গেল মীরার পড়নের শাড়িটির দিকে। মুহুর্তেই সে যেন রেগে গেল। মিরাজ মীরাকে বলল, “কি ব্যাপার? তোর পড়নে এই শাড়ি কেন?”
মীরা আমতা আমতা করে জবাব দেয়, “না মানে ভাইয়া ওই শাড়িতে একটু কাঁদা লেগেছে।”
“কাঁদা লাগলো কি করে? তোর কতো শখ ছিল ওই শাড়িটি পড়ে তুই আমার হলুদ করবি।”
মিরাজের চ্যাঁচামেচি শুনে সবাই ওখানে জড় হয়ে যায়। মীরার ফ্রেন্ডরা এসে আহানকে দেখিয়ে বলে, “ওই যে উনিই তো মীরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন।”
মীরা চোখ রাঙ্গীয়ে ওর ফ্রেন্ডদের বলে, “তোরা চুপ থাকতে পারিস না? ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। উনি তো জেনে বুঝে আমায় ধাক্কা দেননি।”
এদিকে মীরার মা আর দাদি ওখানে এসে দেখেন মিরাজ বেশ রেগে আছে। মীরার দাদি বলেন, “সামান্য একটা শাড়ির জন্য এমন করো কেন ভাই?”
মিরাজ আরও রেগে যায়। সে তার দাদির মুখের উপর বলে, “এটা সামান্য শাড়ি দাদি? এটা আমার প্রথম রোজগার করা টাকায় কেনা শাড়ি। যেটা আমি আমার বোনকে দিয়েছি। এই শাড়িটি খুব যত্ন করে আমার বোনকে তুলে রাখতে দেখেছি। একটা দাগও লাগাতে দেয়নি ও। মীরা সবসময় বলতো যে আমার বিয়েতে ও আমার দেওয়া শাড়িটিই পড়বে। কিন্তু ওর সেই শখের শাড়িতে আজ কাঁদা লেগে গেল। এই শাড়ির থেকেও আমি আরও ভালো শাড়ি ওকে এনে দিতে পারবো কিন্তু এই শাড়িটায় একটা ভালোবাসা জড়িয়ে আছে, একটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেলে আমি কষ্ট পাবো না?”
আহান এবার নিজেকে অনেক অপরাধী ভাবলো। ও মিরাজকে নিচু কণ্ঠে বলল, “স্যরি মিরাজ। আমি বুঝতে পারিনি।”
“তুই চুপ থাক। এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। আর পুলিশদের মাথা নিচু করে নয়, মাথা উঁচু করে কথা বলতে হয়।”
এই বলেই মিরাজ একটা হাসি দিল।
–
মীরা তার রুমে বসে একটা থালায় কয়েক রকমের ফুল ছিঁড়ে তার পাপড়িগুলো একসাথে করছিল। থালা সাজানো শেষে ঐ থালাটা নিয়ে বের হচ্ছিল। এমন সময় হুট করেই তার রুমটা অন্ধকার হয়ে যায়। মীরা স্থির হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ আলো নিভে গেলো কেন? বাইরে তো দিব্বি আলো জ্বলছে। হুট করে পিছন থেকে কেউ মীরার মুখ চেপে ধরলো। মীরার হাত থেকে থালাটা পড়ে যেতে নিল। কিন্তু পিছনে থাকা ব্যক্তিটি থালাটা ধরে ফেললো। মীরা তার হাত দিয়ে মুখ ছোটাতে ব্যস্ত। মীরার আজব লাগছে কে আবার তার মুখ চেপে ধরলো? ব্যক্তিটি মীরাকে ছেড়ে দিল।। মীরার বেশ রাগ উঠলো। সে পিছন ঘুরে ব্যক্তিটিকে বলল, “আপনি কে যে আমার মুখ চেপে ধরেছেন? অদ্ভুত।”
ব্যক্তিটি বলে উঠলো, “আমার গায়ের স্মেল তো তোর চেনা উচিৎ মীরু। আজ হঠাৎ এতো অপরিচিত হয়ে গেল কি করে?”
মীরা চমকে উঠে! এ তো তার পরিচিত একজন। তার তুর্য ভাই। মীরার রুমে আলো জ্বলে উঠলো। সামনে থাকা মানুষটির দিকে সে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। “আমি এখন তোর কাছে অপরিচিত ব্যক্তি। তুই এখন আমাকে অন্ধকারেও চিনিস না।”
মীরা বলল, “এসব কি তুর্য ভাই? আমি তো বলিনি তুমি আমার অপরিচিত।”
তুর্য তার হাতে থাকা থালাটির থেকে কিছু ফুলের পাপড়ি নিয়ে মীরার মাথার উপর দিতে লাগলো। মীরা সামনের মানুষটিকে বোঝার চেষ্টা করছে। কি চলছে তার মনে? তুর্য বলল, “আমার হাতের স্পর্শও তোর অচেনা?”
মীরা বিরক্তি নিয়ে বলল, “চুপ করবে একটু! তুমি এতো লেইট করে কেন এলে শুনি?”
তুৃ্র্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “আগে আসলে তো তোকে কাঁদায় পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারতাম।”
মীরা ভ্রু কুচকালো। তুর্য জানলো কিভাবে সে কাঁদায় পড়ে গেছিল? “তুমি জানো কিভাবে?”
“আমার কাজিনরা বলেছে।”
মীরা বললো, “নিচে চলো।”
মীরা তুর্যর হাত থেকে থালাটা নিয়ে নিচে চলে গেল।
–
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবাই মিরাজকে হলুদ লাগাচ্ছে। কেক, মিষ্টিসহ অন্যান্য আইটেম একটা একটা করে মিরাজকে খাওয়ানো হচ্ছে। ক্যামেরারম্যান ভিডিও করছে। মীরা তার ভাইয়ের হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে। মেহেদী লাগানো শেষ হলে সব কাজিনরা মিলে ঠিক করে নাচ গানের আসর হবে। প্রথমে হবে নাচ। আর নাচ করবে তুর্য ও মীরা। মীরাদের আগে থেকেই প্ল্যান ছিল তুর্য আর মীরা হলুদের অনুষ্ঠানে জুটি বেঁধে নাচ করবে। একজন একটা রোমান্টিক গান চালিয়ে দিল। তুর্য মীরার সাথে নাচ করছে। সবাই হাত তালি দিচ্ছে। ওদের সুন্দর নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে আছে সবাই। আহান দূর থেকে দাঁড়িয়ে ওদের নাচ দেখছে। নাচ শেষে মীরা একটা চেয়ারে বসে পড়ে। মিরাজ আহানকে ডেকে উঠে। আহান ধীর পায়ে মিরাজের কাছে আসে। মিরাজ একটু হেসে বলে, “চুপচাপ ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বন্ধুর বিয়েতে এসেছিস। কই একটু মজা করবি, আনন্দ করবি তা না।”
আহান জবাব দেয়। “আমি কি করবো আবার?”
“কেন গান গাইবি। তোর বন্ধুর বিয়ে বলে কথা।”
“আমি পারিনা এসব গান টান।”
মিরাজ আহানের কথা শুনে না। সে সবাইকে জানিয়ে দেয় আহান এখন গান গাইবে। আহান পড়ে যায় মুশকিলে। তবুও বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে সে রাজি হয়।
মীরা চুপচাপ আহানের গান শুনছে। অন্যদিকে তুর্য একটু হলুদ নিয়ে এসে মীরার গালে ছোঁয়ায়। মীরা প্রথমে হকচকিয়ে উঠে। তুর্য হাসতে হাসতে বলে, “আমি, এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?”
মীরা বলে, “গানটা শুনি আগে। তারপর তোমার যত ইচ্ছে হলুদ লাগিও আমাকে।”
তুর্য মীরার পাশে বসে পড়ে। বুকপকেট থেকে একটা গোলাপ বের করে সেটার কাটা ছাড়িয়ে মীরার কানে গুঁজে দেয়। মীরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তুর্যর দিকে। তুর্য মুচকি হেসে বলে, “তোকে খুব সুন্দর লাগছে মীরু।”
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই যে যার মতো ঘুমাতে চলে যায়। মীরা আর তার কাজিন এবং বান্ধবীরা একসাথে মীরার রুমে শোয়। অন্যদিকে মিরাজের রুমে মিরাজ তুর্য আর আহান শুয়ে থাকে। সবাই যখন ঘুমের রাজ্যে তখন তুর্য চুপিচুপি ওদের রুম থেকে বের হয়ে যায়। তারপর আস্তে করে পা টিপে মীরাদের রুমের কাছে যায়। তখন একজন কাজিন দরজা খুলে দেয়। তুর্যর হাতে একটা মেহেদী। তুর্য গিয়ে ঘুমন্ত মীরার হাতে নিজের নাম লিখে দেয় মেহেদী দিয়ে। তারপর খুশি মনে ওখান থেকে বের হয়ে যায়। তুর্য যাওয়ার পর তার কাজিন দরজা লাগিয়ে দেয়। মীরার অজান্তেই এসব প্ল্যান করে ওরা তিন কাজিন মিলে।
চলবে…
#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি