#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ২১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
নিস্তব্ধ সন্ধ্যা। ফুরফুরে শীতল হাওয়া বইছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। মিটিমিটি তারা ঘিরে ধরে আছে রূপবতী চাঁদকে। আহানদের বাসার ছাদে আজ জমজমাট আসর বসেছে। আহান, মীরা, আয়ান, মিরাজ, তার স্ত্রী, দিবা আর ইরা সবাই ছাদে গোল হয়ে পাটি বিছিয়ে বসেছে। আড্ডার আসর বসেছে। আহানের হাতে গিটার। যেটা আয়ান ওকে ধরিয়ে দিয়েছে। সবার অনুরোধ আহান যেন গান গেয়ে আসর জমায়। কিন্তু আহান অপেক্ষা করছে মীরা কখন তাকে একবার বলবে গান গাওয়ার জন্য। মীরা না বললে সে গাইবেই না।
মিরাজ বলল, “কি হলো, এতদিন পর এলাম। কই খুশি হয়ে আমাদের গান শোনাবি তা না। চুপ করে বসে আছিস।”
দিবা বলল, “প্লিজ ভাইয়া, একটা গান প্লিজ।”
একে একে সবাই আহানকে গান গাওয়ার জন্য বললেও মীরা এখনো বলেনি। আহান মীরার দিকে তাকিয়ে আছে করুণ দৃষ্টিতে। মীরা বুঝে উঠতে পারলো না আহান গাইছে না কেন। ভাবতে ভাবতে মীরার মাথায় এলো। সে একবারও আহানকে বলেনি গান গাওয়ার কথা। মীরা ভাবল, এই জন্যই বুঝি ইনিস্পেক্টর সাহেব চুপ করে বসে আছেন। মীরা প্রথমে গলা ঝাড়ল। সবাই হতবাক হয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। সবার এমন চাহনিতে মীরা কাচুমাচু হয়ে বলল, “তোরা সবাই এমনভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
ইরা বলল, “গান গাইবে আহান ভাইয়া। আর গলা ঝাড়ছিস তুই।”
“এখন আমি কি গলা ঝাড়তেও পারব না?”
আয়ান বলল, “যেভাবে ঝাড়লে, মনে হচ্ছিল তুমি গান গাইবে। আসলেই কি গাইবে?”
“নাহ্। আমি গান জানি না। যে জানে সে গাক না। ইনিস্পেক্টর সাহেব! কি? গান গাইবেন না?”
সবার সামনে ইনিস্পেক্টর সাহেব বলায় আহানের কাশি উঠে গেল। ও কাশতে থাকলে মিরাজ ওকে এক গ্লাস পানি এনে দেয়। মীরা বলে, “গলা ভিজিয়ে নিয়েছেন, এখন গান গান।”
আহান স্বাভাবিক হলো। যাক অবশেষে মীরা বলেছে তাকে। আহান গান ধরল।
“হতে পারে রুপকথার এক দেশের,
রাতের আকাশের এক ফালি চাঁদ,
তোমার আমার চিরকাল।
তুমি আমি হাতে রেখে হাত,
ছুঁয়ে দিয়ে আঙুলে আঙুল,
দেখতে পারো কিছু আদুরে সকাল।
হতে পারে এ পথের শুরু,
নিয়ে যাবে আমাদের অজানায়।
তুমি আমি আমাদের পৃথিবী,
সাজিয়ে নিবো ভালোবাসায়।
ভালোবাসি বলে দাও আমায়,
বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল।
তুমি শুধু আমারই হবে,
যদি করো মিষ্টি এই ভুল।
হাতে হাত রাখতে পারো,
সন্ধি আঙুলে আঙুল।
ভালোবাসা বাড়াতে আরও,
হৃদয় ভীষণ ব্যাকুল।
মীরা আহানকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। আহান এক ধ্যানে গান গাইলেও মীরা আহানের দিকেই দৃষ্টি স্থির রেখেছে। মনোমুগ্ধকর গলা আহানের! মীরা ইম্প্রেস হলো, সে-ই প্রথম দিনের মতো। গিটারের টুন বাজাতে বাজাতে আহান এক পলক মীরার দিকে তাকাল। মীরাকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। মীরা কেন এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে অক্ষম হচ্ছে আহান। ফের মীরার দিকে তাকাতে তার লজ্জা লাগছে। চোখ বন্ধ করে গলা ছাড়ল।
প্রতিদিন কি জানি কি হয়ে যায়
শুধু তোমার কল্পনায়
ডুবে থাকা, আমায় ভালোলাগায়,
ভালোলাগার স্বপ্ন বোনায়।
কখনো হারাবে না তুমি
চোখে চোখ রেখে কথা দাও।
থাকবে কাছে ছায়ার মত,
ছেড়ে যাবেনা কোথাও।
হতে পারে তোমার একটু চাওয়ায়,
এনে দেবো শুকতারা কুড়িয়ে।
স্বপ্ন আঁকবো চন্দ্র দিয়ে,
পূর্ণিমাতে তোমায় বুকে জড়িয়ে।
ভালোবাসি বলে দাও আমায়,
বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল।
তুমি শুধু আমারই হবে,
যদি করো মিষ্টি এই ভুল।
হাতে হাত রাখতে পারো,
সন্ধি আঙুলে আঙুল।
ভালোবাসা বাড়াতে আরও,
হৃদয় ভীষণ ব্যাকুল।”
গান শেষ হলো অবশেষে। সবাই চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসে ছিল। আহান ভেবাচেকা খেয়ে গেল! গান কি কারো পছন্দ হয়নি? আহানের ভুল ভাঙে যখন সবাই একসাথে হেসে উঠে করতালি দিতে থাকে। শেষ রাতে সবাই অনেক মজা করে। আয়ান রেস্টুরেন্ট থেকে শিক কাবাব নিয়ে আসে। সাথে পিজ্জা। খাওয়া দাওয়া হয় খুব ধুমধামে। শেষে ঠান্ডা নিয়ে আসে আয়ান। খুব মিশে গেছে মীরার পরিবারের সবার সাথে। পরিবার এতো সুন্দরও হয়? শুধু তার পরিবারটিই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আচ্ছা, মীরা কি পারবে তার পরিবারকে ঠিক করে দিতে? মা আর ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা দূর করে, তাদের এক করে দিতে? আয়ান ভাবে, তারও ইচ্ছে করে সুন্দর একটা পরিবার নিয়ে সমাজে উঁচু হয়ে বাঁচার। বন্ধু-বান্ধব কাউকেই বাসায় নিয়ে আসেনা শুধু মাত্র মা আর ভাইয়ের মিল নেই দেখে। এসব ভেবে একটা লম্বা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ে আয়ান।
ছাদের এক কোণে একা একা দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে মিরাজ। ছাদে এখন কেউই নেই। সবাই নিচে চলে গেছে। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে মিরাজ। দ্রুত হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে মীরা। ভাইকে এমন কাঁদতে দেখে মীরা জিগ্যেস করে, “কি হয়েছে ভাইয়া?”
মিরাজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুর্যর কথা খুব মনে পড়ছে। ও বেঁচে থাকলে হয়তো এই আনন্দ, মজা সব আরো দ্বিগুণ হতো।”
“তুর্য ভাই চলে যাওয়ার পিছনে আমিই দায়ী। আমি যদি সেদিন জেদের বসে তুর্য ভাইয়ের প্রপোজ অ্যাকসেপ্ট না করতাম। তাহলে আজ তুর্য ভাই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকত। কিচ্ছু হতো না ওর।”
“তুর্য তোর ভাগ্যে ছিল না মীরা। আর অ্যাকসিডেন্ট এর উপর কারো হাত নেই। যে তোর ভাগ্যে ছিল তুই তাকেই পেয়েছিস। আহান খুব ভালো ছেলে। আগলে রাখিস। ওকে ভালোবাসার মতো কেউ নেই।”
“তবুও এই অপরাধবোধ আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে ভাইয়া। আমি কেন তাকে স্বপ্ন দেখালাম? তুর্য ভাইকে ঠকিয়েছি আমি।”
“ঠকানো কাকে বলে? তুই কি পালিয়ে গিয়েছিস? নাতো! তুই আহানকে বিয়ে তখনই করেছিস যখন তুর্য ছিল না। তুর্য বেঁচে থাকলে হয়তো ওর সাথেই তোর বিয়ে হতো। এতো কিছু ঘটতো না। তাছাড়া, তুর্য মারা যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছে; তুই যেন আহানকে বিয়ে করিস।”
“ওটা তো কষ্ট চেপে রেখে বলেছে। আচ্ছা ভাইয়া, আমি কেন তুর্য ভাইকে ভালোবাসতে পারলাম না?”
“সবাইকে ভালোবাসা যায়না। আর যাকে ভালোবাসা যায়, সে ছাড়া আর কাউকেই ভালো লাগে না।”
“তবুও নিজেকে দোষ দেই৷ আমার কারণেই সব। আসলে ওই মুহুর্তে আমার কি করা উচিৎ আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই তুর্য ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই।”
“বললাম না নিজেকে দোষ দিবি না। তুর্য যদি আগে থেকে জানত যে, তুই আহানকে পছন্দ করিস। তাহলে তোকে বিয়েই করত না। যা নিচে যা। আমি আসছি। সবাই খুঁজছে হয়তো।”
মীরা মন খারাপ করে ছাদ ত্যাগ করলো। মিরাজ একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল। পরে সেও ছাদ থেকে নিচে চলে গেল। আজ রাতটা সবাই আহানদের বাসায় কাটাবে। মিরাজ আর তার বউ এর জন্য একটা রুম। দিবা আর ইরার জন্য একটা রুম দেওয়া হলো। রাত অনেক হওয়ায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ল।
চলবে…