#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩৬ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
খুব ভোঁরে মীরা আর আহান সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে সূর্য উদয় দেখতে গেল। সমুদ্রের পাড়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। সমুদ্র পাড়ে সূর্য উদয় এক অন্য রকম দৃশ্য৷ এই সৌন্দর্যের সাথে মীরার প্রথম পরিচয়। সূর্য উদয় দেখা শেষ হলে সমুদ্রের কিনারায় একে অপরের হাত ধরে হাটছে ওরা। মীরা কিছুক্ষণ পর পর আহানকে জড়িয়ে ধরছে। এই পাগলামিটা আহানের কাছে ভালো লেগেছে। কাল রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি আহান। যতক্ষণ জেগে ছিল, মীরাকে দেখেছে। মীরার চুলে বিলি কেটে দিয়েছে। মীরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। আহানের জীবনে বেঁচে থাকার কারণ হয়ে উঠল মীরা। আহানের একাকি জীবন ভরে উঠল পূর্ণতায়। নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হলো মীরা। তাকে হারানোর ভয় মনকে গ্রাস করে রেখেছে। কোনো কিছুর বিনিময়ে মীরাকে হারাতে চায়না আহান। হাটতে হাটতে দুজনে একসাথে স্টলের সামনে আসে। সেখানে নানা রকমের চা দেখতে পায় মীরা। মীরা বেছে বেছে দুই কাপ চা নিল। চা খেয়ে মীরার মনে হলো এটা চা নাকি অমৃত। চায়ের এতো টেস্ট হয়? তারপর তারা একটা রেস্টুরেন্টে গেল। সেখান থেকে ব্রেকফাস্ট করে হোটেলের দিকে রওনা হয়।
সকাল নয়টা দশটার দিকে ওরা তিনজন মিলে আশেপাশের দর্শনীয় স্থানসমূহে ঘুরতে গেল। ঘুরতে ঘুরতে অনেক কিছুর সাথেই পরিচিত হয় তারা। আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর! আয়ান একা একা। মীরা ও আহান পাশাপাশি হাটছে।
মীরার ফোনে হটাৎ কল আসে। স্ক্রিনে দিবার নামটা জ্বলজ্বল করছে। হটাৎ দিবা কল দিল কেন! ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে যায়। দিবা আবার কল দেয়। এবার মীরা রিসিভ করে কানে দেয়। ফোঁপানোর শব্দ কানে ভেসে আসছে মীরার। দিবা কাঁদছে! কিন্তু কেন? মীরা স্বাভাবিক কণ্ঠে জিগ্যেস করে, “কাঁদছিস কেন?”
দিবা ক্রমাগত ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এদিকে মীরার টেনশন বেড়ে যায়। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, “আরে বলবি কি হয়েছে? না বললে বুঝব কিভাবে।”
“বাঁচা মীরা। আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করেছে মীরা।”
আকস্মিক কথায় চমকে উঠে মীরা। দিবার বিয়ে? “আমার সাথে কি তুই ফাজলামো করছিস? ইরার বিয়ে হতে না হতেই তোর বিয়ে দিবে মামা!”
“মীরা আমি সত্যি বলছি। আব্বু হুট করেই পাত্রপক্ষ নিয়ে এসেছেন। আর তারা কালই বিয়ে পড়ানোর কথা জানিয়েছেন। মীরা প্লিজ হেল্প কর। আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা।”
“বিয়ে যখন ঠিক করেছেন, বিয়ে করে নে। আমাকে কেন বলতে আসছিস? ভালোই তো সেদিন আমাদের সবাইকে অপমান করেছিস আমার ভাই আর তুই।”
দিবা করুণ সূরে বলে, “মীরা এসব কি বলছিস! আমি কবে তোদের অপমান করেছি?”
“কেন তুই আমাকে ফোন করে ঝাড়ি দিয়ে বলিসনি যেন আমার দেবর তোকে ডিস্টার্ব না করে। অস্বীকার করতে পারবি?”
“আমার সাথে আব্বু আম্মু কথাই বলে না ভালো করে। সেদিনের ঘটনার জন্য আব্বু ভাবে আমিও জড়িয়ে আছি এতে। উঠতে বসতে কথা শোনায়। তাই তোকে ফোন করে এসব বলেছি। মীরা তুই যদি আমাকে সাহায্য করতে না চাস, তাহলে করতে হবে না।”
“তোকে কিভাবে সাহায্য করব বলতো। তুই তো আমার দেবরকে কোনো পাত্তাই দিলি না। ও যে তোকে ভালোবাসে, এর কোনো গুরুত্বই নেই তোর কাছে।”
“আমার যদি তার প্রতি ভালোবাসা নামক বিশেষ অনুভূতি না আসে, তাহলে কিভাবে আমি রাজি হবো?”
“বিয়ের পরও ভালোবাসা যায় দিবা। সত্যি করে বলতো, তুই আয়ানকে পছন্দ করিসনা? আমি কিন্তু আয়ানের সাথে অনেক কথা বলতে দেখেছি তোকে। খুব হেসেছিলিস তোরা।”
“কোথায়?”
“আমাদের বাসায় যখন এসেছিলি। যদি তোর ভালো না লাগতো, তাহলে তুই আয়ানের সাথে পাশাপাশি বসে হাসাহাসি করতিস না।”
“হাসাহাসি করলে, কথা বললেই ভালোবাসা হয়ে যায়?”
“আমি পছন্দের কথা জিগ্যেস করছি। উত্তর দে। সময় নেই।”
“আমি জানি না।”
“বিয়ে কখন?”
“কাল সন্ধ্যায়।”
“নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা। রাখছি।”
“মীরা!”
“একদম চ্যাঁচাবি না। যা হচ্ছে, সেটাই মেনে নে। তোর জন্য ভালো হবে।”
“তোরা সবাই শুধু নিজেদের কথাই চিন্তা করিস। আমার দিকটা কেউ ভাবিস না। ঠিকাছে, কাউকে সাহায্য করতে হবে না।”
দিবা ফোন কেটে দিল। এদিকে মীরা ভাবছে কিভাবে কি করবে। কিছুতেই অন্য কারো সাথে দিবার বিয়ে দেওয়া চলবে না। মীরা আহান ও আহানকে সবটা খুলে বলে৷ আয়ান কিছু বলেনি। তবে মুখটা মলিন করে রেখেছে। মীরা ভাবতে ভাবতে একটা প্ল্যান আসে মাথায়। আয়ান আর আহানকে সেই প্ল্যান এর বিষয়ে জানায়। আহান বাঁধা দেয়। আয়ান টু শব্দটিও করে না। মীরা বলে, “আমাদের আজ বিকেলেই রওনা দিতে হবে। প্লিজ আপনি টিকিট কেটে রাখুন।”
“মীরা, তুমি যা করতে চাইছ, তা কিন্তু মোটেও ঠিক না। এভাবে একজনের বাড়িতে গিয়ে এসব করা তাদের সম্মানে আঘাত হানবে।”
“আর একটা মেয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে যে তার বিয়ে হচ্ছে, সেটা অন্যায় নয়?”
“তার মা বাবা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলে এখানে অন্যায় কিছু তো আমি দেখছিনা।”
“একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে তার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া কি ন্যায়? আপনাদের আইন কি বলে?”
“দিবা তো এর প্রতিবাদই করেনি। দিবা প্রতিবাদ না করলে কিছুই আটকানো সম্ভব নয়। ওকে আগে বলতে হবে সে এ বিয়ে করতে চায়না।”
“আপনি একটু চুপ থাকুন। এমনিতেও আমি টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আপনি আর টেনশন দিবেন না।”
“ফাইন। চলো রেস্ট নিবে। ঠান্ডা মাথায় সব ভাববে। এতো তাড়াহুড়ো করবে না।”
“আচ্ছা, চলুন।”
তিনজন মিলে গাড়ি করে হোটেলে চলে গেল।
–
বিকেলের দিকে রেড়ি হয়ে মীরা, আহান আর আয়ান রওনা হয়। বাসে উঠে আয়ান জিগ্যেস করে, “কাল ঠিক তুমি কি করতে চাইছ আমার মাথায় ঢুকছে না। এসব অশান্তি আমি চাইনা।”
“আমি তোমাকে উদাস, বিদ্রোহী, কষ্ট পেতে দেখতে পারব না।”
“তুমি আমার বিষয়ে কেন ভাবছ?”
“তোমার বোন বলে। এইটুকু তো করতেই পারি।”
“দিবা আমাকে পছন্দ করে না মীরা। তাহলে কেন জোর করে তার সাথে আমার সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করব?”
“কে বলেছে ও তোমায় পছন্দ করে না? মেয়েরা মেয়েদের চোখের ভাষা পড়তে পারে। তা জানো? মেয়েটা এখন কিছুতেই স্বীকার করবে না।”
“তাহলে জোর করছ কেন।”
“আমি আমার ভাইকে কথা দিয়েছি। তাই।”
আয়ান আর কিছুই জিগ্যেস করেনি। আয়ান আর মীরা পাশাপাশি বসেছে। আহান অন্য সিটে বসেছে। আয়ানের সাথে টুকিটাকি কথা বলবে বলেই মীরা এমন করেছে। কাল কি হবে আল্লাহ-ই জানেন। অনেক বড়ো রিস্ক নিতে হবে। রাত হতেই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বাস দাড় করালে ওখান থেকে খাবার প্যাক করে তিনজন মিলে ডিনার শেষ করে। এরপর লম্বা ঘুম দেয়।
রাত একটার দিকে ফেনী শহরে পদার্পণ করে তারা। বাস থামতেই আহান মীরা আর আয়ানকে ডেকে তুললো। ঘুম থেকে জেগে ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ল তিনজনেই। মীরা ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ছে একেবারে। আহান একটা সিএনজি ডেকে নিল। তিনজন মিলে ওই সিএনজিতে বসে বাসায় রওনা দিল। আহান কাল ডিউটিতে যাবে। তবে মীরার প্ল্যান এর জন্য বিকেলের দিকে তাদের শ্রীপুর যেতে হবে।
অন্যদিকে একটা ঘটনা ঘটে গেছে! দিবা কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাচ্ছে যেন একেবারে। কি করবে না করবে ভেবে না পেয়ে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। ড্রয়ারে রাখা ঘুমের পিল নিয়ে কয়েকটা খেয়ে ফেলল পানি দিয়ে। নিজের রুমের দরজা লক করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। তাকে এমন কাজ করতে কেউ দেখেনি। দিবা কি চাইছে সে নিজেও জানে না। শুধু জানে সে এই বিয়ে করতে পারবে না। দিবার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে। ঘুমের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল সে। কেউ কিছু জানলো না।
চলবে…