#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৮ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
সকাল দশটা বেজে দশ মিনিট। মিরাজ মীরা ও মীরার ভাবি বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে আহানের জন্য। অথচ আহানের আসার কোনো নাম গন্ধই নেই। মিরাজ বারবার কল দিচ্ছে আহানকে। কিন্তু আহান কল রিসিভ করছে না। মিরাজ বলল, “তোরা যা, আমি আহানকে নিয়ে আসছি।” মীরা আপত্তি জানালো। সে বলল, “ভাবির সাথে না গিয়ে তুই ওনার জন্য যাবি? তুই দাঁড়িয়ে থাক উনি এক্ষুনি চলে আসবেন।”
মীরার কথাটা বলতে দেরি আহান আসতে দেরি হলো না। মীরা তো অবাক হয়ে গেলো। আহান বলল, “স্যরি৷ আসলে থানায় একটা কাজ ছিল।” মীরা বলে, “ইটস ওকে ইনিস্পেক্টর সাহেব। এবার চলুন।”
মীরা আর তার ভাবি বোরকা পড়ে বের হয়েছে বাসা থেকে। মিরাজ কালো পাঞ্জাবী পড়েছে আজ। কিন্তু আহানের গায়ে পুলিশের ড্রেস। মিরাজ তা দেখে আহানকে জিগ্যেস করে, “কিরে! তুই কি এটা পড়েই যাবি নাকি?” মিরাজের কথায় আহান নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সে পুলিশের ড্রেসে আছে। তখন আহান বলে, “আসলে তাড়াতাড়ি এসেছি তাই বাসায়ও যাইনি।” মীরা বলে, “আচ্ছা আপনি ভাইয়ার একটা পাঞ্জাবি পড়ে নিন। আসুন, আমি আপনাকে ভাইয়ার একটা পাঞ্জাবি বের করে দিচ্ছি।” আহান চুপ করে থাকে। সে এখন বাসার ভিতরে ঢুকবে? সেদিন তো বলেছিল সে আর এই বাসায় আসবে না। আহান বলে, “ইটস ওকে। আমি এটা পড়েই যাবো।”
কিন্তু মীরা মানে না। মীরা নিজেই বাসার ভিতরে চলে যায়। মীরা বুঝেছে আহান সেদিন দাদির কথায় আজ ওদের বাসায় যেতে চাইছে না। মীরা গিয়ে তার ভাইয়ের রুমের আলমারি থেকে খুঁজে একটা বেগুনি রঙের পাঞ্জাবি বের করে নেয়। তারপর একটা সাদা পায়জামা নিয়ে বাইরে চলে আসে। মীরা বাসার বাইরে এসে আহানের হাতে ওগুলো দিয়ে বলে, “ওই যে ওয়াশরুম।ওখানে গিয়ে চেঞ্জ করে নিন। আর আপনার ড্রেসটা আমায় দিন আমি বাসায় রেখে আসছি।”
মীরার কাছ থেকে ওগুলো নিয়ে আহান একটা পাব্লিক ওয়াশরুমে ঢুকে। এরপর চেঞ্জ করে বাহিরে আসে। ইতিমধ্যেই মিরাজ একটা সিএনজি নিয়ে এসেছে। মীরা আহানের কাছ থেকে তার ড্রেসগুলো নিয়ে বাসার ভিতরে গিয়ে রেখে আসে। ওরা সবাই একটা সিএনজিতে বসে। আহান আর মিরাজ বসে ড্রাইবারের পাশে। আর পিছনে মীরা আর তার ভাবি বসে। পিছনে জায়গা থাকা সত্ত্বেও মিরাজ তার বন্ধুর সাথে বসে। ওরা যাচ্ছে ওদের নানুর বাড়িতে।
ফেনী জেলার অনেকগুলো থানার মধ্যে ফুলগাজি হলো অন্যতম একটি থানা। ফুলগাজির সাথেই মীরাদের নানুর বাড়ি। গ্রামের নাম দক্ষিণ শ্রীপুর। তুর্যর দাদুর বাড়ি। তুর্যরা গ্রামে থাকে না। ফেনী শহরে থাকে৷ তুর্য তখন এসএসসি পরিক্ষায় পাশ করেছে। এর সুবাদে সে ফেনী কলেজে ভর্তি হয়। তার বাবাও ফেনীতে চাকরি করেন। তাই সুবিধা হওয়ার জন্য উনি স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। অন্যদিকে মীরার বাবা অনেক আগেই ফেনীর একটা ব্যাংকে চাকরি করতেন। এবং ওখানে ওনাদের ডুপ্লেক্স বাসা আছে নিজস্ব। মিরাজের প্রাথমিক পড়া শেষ হলেই ওনারা ওখানে চলে যান। ওনাদের বাড়ি ছিল পরশুরাম থানার অনন্তপুর গ্রামে। ফুলগাজি ও পরশুরাম দুটি পাশাপাশি থানা। মীরার বাবা অনেকবার বলেছেন তুর্যদের যে মীরাদের বাসায় থাকতে। কিন্তু তুর্যর বাবা রাজি নন। পরে উনি নিজেই পুরো ফ্ল্যাট কিনে নেন। এখন তাদের ভাড়া বাসায় থাকতে হয় না।
প্রায় আধাঘন্টা পর মীরারা এসে পৌঁছায় তার নানুর বাড়ির সামনে। সিএনজি থেকে নেমে ওরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে৷ ওদের আসতে দেখে মীরার কাজিন দিবা ও ইরা দৌঁড়ে আসে। দিবা আর ইরা হলো মীরার মামাতো বোন আর তুর্যর চাচাতো বোন। ওরা সবাই বাড়ির বড়ো সবাইকে সালাম করে নেয়। আহানের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেয় মিরাজ। তারপর ওদের বসতে বলা হয়। মীরা ও মিরাজ তাদের নানুর দুই পাশে দুজন বসে আছে। তাদের নানু কাঁদছেন। কতদিন পর উনি ওনার নাতি নাতনিদের দেখছেন।
আহান ও মীরার ভাবি স্নিগ্ধা সোফায় বসে আছে। দিবা আর ইরা ফল মিস্টি নিয়ে ওদের সামনে আসে। সুন্দর করে সব পরিবেশন করে দেয় ওদের। সবাই একটু কিছু মুখে দিয়ে উঠে যায়। মীরা ও মীরার ভাবি ভিতরের রুমে চলে যায়। বোরকা চেঞ্জ করে নেয়। ওরা আজকে শাড়ি পড়ে এসেছে।
আহান বাহিরে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখছিল। মিরাজ ঘরের সোফায় বসে ফোন টিপছে। এমন সময় দিবা আর ইরার সাথে হাসতে হাসতে মীরা ঘর থেকে বের হয়। আহান পিছনে তাকাতেই মীরার চোখাচোখি হয়৷ ওরা ওখানেই দাঁড়িয়ে যায়। আহান মীরাকে দেখছে, একটা নীল জামদানী শাড়ি পড়েছে মীরা। চুলগুলো খোলা। আহান অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নেয়। দিবা মুখে হাসি নিয়ে আহানের কাছে এসে বলে, “ভাইয়া! চলুন আপনাকে আমাদের গ্রামটা দেখাই।”
আহান বলে, “কিন্তু মিরাজ?”
তখন ইরা এসে বলে, “আরে ভাইয়ার কি দরকার। যা করছে তাই করুক। তাছাড়া ভাইয়ার এখন ভাবিকে সময় দেওয়া উচিৎ। চলুন আমরা যাই।”
“আচ্ছা চলো।”
ওরা সবাই বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। এদিকে যে মীরা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের খেয়ালই নেই। মীরাকে একা রেখেই চলে গেলো। মীরা অভিমান করে আছে৷ আজ আসুক। মুহুর্তেই দিবা এসে মীরার সামনে দাঁড়ায়। মীরা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দিবা কান ধরে বলে, “স্যরি বোন। তোকে রেখেই চলে যাচ্ছিলাম। চল চল।”
“যাচ্ছিলি যখন যা না। আবার ঢং করে আসতে গেলি কেন?”
“খেয়ালই ছিল না। ভাবলাম তুই পিছনে আসছিস। কিন্তু আহান ভাইয়া বলল যে তুই নেই। তাই আবার দৌড়ে এলাম। রাগ করিস না স্যরি। তুইও কেমন! তোকে কি দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেতে হবে?”
মীরা দাঁত মুখ শক্ত করে খিঁচে ধরে বলে, “হইছে, অনেক এক্সকিউজ শুনেছি। চল এবার।”
দিবাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মীরা গেইট দিয়ে বের হয়ে যায়।
দিবা আর ইরা আগে আগে হাটছে। অন্যদিকে আহান ও মীরা পিছনে পিছনে হাটছে। হাটতে হাটতে ওরা একটা রাস্তার মোরে এসে থামে। দিবা একটা বাড়ি দেখিয়ে আহানকে বলে, “ভাইয়া, এটা কার বাড়ি বলতে পারবেন?”
আহান ভ্রু কুচকে বলে, “আমিতো এই প্রথম এখানে এলাম। জানি না তো।”
দিবা বলে, “এটা বেগম খালেদা জিয়ার বাবার বাড়ি।”
আহান বিস্মিত হয়ে বলে, “আসলেই?”
“হ্যাঁ। চলুন ভিতরে যাই।”
ওরা সবাই খালেদা জিয়ার বাড়ির ভিতরে ঢুকে একটু ঘুরাঘুরি করলো। আবার বেরিয়ে এসে হাটা ধরলো। রাস্তার পাশেই একটা ছোট দিঘি। সামনেই একটা দোকান। একটা মাজার, একটা মসজিদ। দুপাশে রাস্তা।
দিবা বলল, “দক্ষিণ দিকের রাস্তা টা থানার পাশ দিয়ে বাজারে যাওয়ার। আর এই পূর্ব দিক হয়ে যেই রাস্তাটা দেখছেন? ওটা দিয়েও বাজারে যাওয়া যায়। সামনেই আমাদের গ্রামের বড়ো দিঘি রয়েছে। অনেক মানুষ এই দিঘিতে এসে ঘুরে যায়। দিঘিটা অনেক সুন্দর। যাবেন?”
আহান বলল, “চলো যাই তাহলে।”
আহান হাটছে। ঘুরে ঘুরে চারপাশের পরিবেশ দেখছে। মীরা আড়চোখে আহানকে দেখছে বারবার। এই বেগুনি রঙের পাঞ্জাবিতে আহানকে বেশ মানিয়েছে। ওরা দিঘির সামনে চলে আসে। দিঘির এতো সুন্দর মাধুর্য দেখে আহান মুগ্ধ হয়। কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে আহান পিছনে তাকিয়ে দেখে দিবা, ইরা আর মীরা ওরা কেউই নেই তার আশেপাশে। আশ্চর্য হয়ে যায় আহান। কোথায় গেলো ওরা। দিঘির ঘাট থেকে বেরিয়ে পূর্ব দিকে একটা বাগান দেখতে পায় সে। খেয়াল করে দেখে দিবা, ইরা ও মীরা মিলে ওই বাগান থেকে ফল চুরি করছে। এটা দেখে আহানের চক্ষু চড়কগাছ। আহান বাগানের ভিতরে ঢুকে ওদের ডেকে বলে, “আরে কি করছেন আপনারা। অন্যের ফল গাছ থেকে ফল নিচ্ছেন কেন?” মীরা বাগান থেকেই জবাব দেয়, “আপনি বুঝবেন না ফল চুরি করার মজা।”
“কে ওখানে?”
একটা লোক ওদের ধাওয়া করতে থাকে। দিবা আর ইরা আগেই দৌঁড় দিল। মীরা শাড়ির কুচি ধরে ওদের পিছনে দৌঁড়ে আসতেছে। রাস্তায় এসেই সোজা হুমড়ি খেয়ে পড়ল আহানের গায়ের উপর। আহান মীরার দু’বাহু ধরে তাকে আগলে নিল। মীরা চোখ তুলে আহানের দিকে তাকাল। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে আহানের কাছাকাছি। আহান মীরাকে জিগ্যেস করল, “আপনি ঠিকাছেন?”
মীরা চোখ নামিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে জবাব দিল। “হ্যাঁ।”
আহান মীরার হাত ছেড়ে দিল। মীরা আহানের কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়াল। দিবা আর ইরা চোখ বড়ো বড়ো করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। দিবা ইরার কানে ফিসফিস করে বলে, “এই দৃশ্য যদি তুর্য ভাই দেখতো তাহলে কি হতো ভাবতে পারছিস?”
ইরা ঢোক গিলে বলে, “তুর্য ভাই ঠিক থাকতো না। রেগে গিয়ে কি করতো আল্লাহই জানেন।”
দিবা আহানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভাইয়া চলুন, আপনাকে আমাদের কলেজ দেখাই। এইতো পাশেই আমাদের কলেজ। ফুসকা খেয়ে আসবো একেবারে।”
আহান বলে, “তোমরা খাও, আমি খাইনা ওসব।”
মীরার ফোন বেজে উঠলো হঠাৎ। মীরা ফোন হাতে নিয়ে দেখে তুর্য ভিডিও কল দিয়েছে। মীরা রিসিভ করে সাথে সাথেই। তুর্য বলে, “কখন এলি? কই আছিস?”
“দিঘির পাড়।”
এই বলে মীরা তুর্যকে দিঘি দেখাতে নিল। আর তখনই ফোনের স্ক্রিনে তুর্য আহানকে দেখতে পায়। আহানকে দেখেই তুর্য ভ্রু কুচকে নিল। আর বলল, “আহান? ও এখানে?”
মীরা বলল, “ভাইয়া নিয়ে এসেছে ওনাকে।”
“এক্ষুণি বাড়ি যা।”
মীরা কপাল ভাজ করে বলল, “কেন?”
“যেতে বলেছি যাবি।”
“যাচ্ছি। তুমি কি চাও তুর্য ভাই? এভাবে রাগ দেখিয়ে কথা বলো কেন তুমি?”
“বাড়ি যা।”
“যাচ্ছি তো।”
মীরা কাউকে কিছু না বলে তুর্যর সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ি চলে যাচ্ছে। দিবা ইরা আর আহান মীরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। দিবা বলল, “মীরা তো চলে গেল। চলুন ভাইয়া আপনিও আর কি করবেন। বাড়ি যাই।”
আহান বলল, “চল তাহলে।”
দিবা ইরা আর আহান একসাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা ধরে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিকেল নামিতেই সবাই একসাথে বিদায় নিল মীরাদের গ্রামের বাড়ি থেকে। গোটা রাস্তায় মীরা মন খারাপ করে ছিল। আহানের সাথে কথা বলতেই পারলো না সে ঠিক করে। কিভাবে তাকে কথার জালে ফাঁসাবে? সব দোষ তুর্যকে দিয়ে দিল মীরা। ফেনী সদর হাসপাতালের সামনে পৌঁছে যে যার গন্তব্যস্থলে চলে গেল। মীরা ও তার ভাবি স্নিগ্ধা বাসার ভিতরে চলে গেলো। আহান আর মিরাজ বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। মীরা আবার এসে আহানের ড্রেসগুলো দিয়ে আবার বাসার ভিতরে চলে গেল। আহানও মিরাজের থেকে বিদেয় নিয়ে নিজের বাসায় চলে গেল।
চলবে…