#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১০ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে থৈ থৈ করে মাঠ, ঘাট, রাস্তা, পুকুর। সজিব হয়ে উঠে গাছপালা। মনে হয় অনেক দিন বেতৃষ্ণায় ছিল তারা। বৃষ্টি এসে তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। এমন সময় পথঘাট কাঁদায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। রাস্তায় চলাচল করতে হিমশিম খেতে হয়। তবে পিচ ঢালা রাস্তা অনেক সুন্দর দেখায়।
আজ শুক্রবার। মীরাদের বাসায় নিজের মা বাবাকে নিয়ে হাজির হয়েছে তুর্য। সোফায় বসে আছেন মীরার বাবা, মা, তুর্যর বাবা, মা, ও মিরাজ। মীরার দাদি এখানে আসেননি। উনার কোনো ইচ্ছে নেই এ বিষয়ে কথা বলার। মীরা তার রুমে আছে। মীরার ভাবি সবার জন্য নাশতা রেড়ি করল। ঘোমটা টেনে ট্রে করে নাশতা নিয়ে এসে সবার সামনে রাখলো। তারপর মিরাজের পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো। মীরার বাবা তুর্যদের বললেন নাশতা নিতে। উনারা কথার ফাঁকে ফাঁকে খেতে লাগলেন। একসময় তুর্যর বাবা বললেন, “তাহলে আমরা বিয়ের তারিখ ঠিক করি? যেহেতু ওরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে একসাথে থাকবে তখন তো আর আমাদের কিছু বলার নেই। দেরি না করে ওদের বিয়ে দিয়ে দেই।”
আজমীর সাহেব একটুখানি চুপ থাকলেন। উনি ভাবছেন ছেলের বিয়ে দিয়েছেন দু মাস হলো, এরমধ্যেই মেয়ের বিয়ে? মিরাজ তখন বলল, “আপনারা বিয়ে কবে পরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মামা?”
তুর্যর বাবা বললেন, “আগামী দশ দিনের মাথায় বিয়ে হয়ে গেলে মন্দ হয়না।”
আজমীর সাহেব বললেন, “তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না? মিরাজের বিয়ে হলো দু’মাস আগে। এর মধ্যেই মীরাকে…”
আজমীর সাহেবের কথার মাঝেই তুর্য বলে উঠলো, “সমস্যা নেই ফুপা। বিয়েটা আমি ঘরোয়াভাবেই করতে চাই। আমাদের আত্নীয়-স্বজন আর কিছু চেনা জানা মানুষ থাকবে। পরে নাহয় বড়ো করে অনুষ্ঠান করব।”
আজমীর সাহেব ভাবলেন। তুর্যর কথাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তাই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তারপর মীরার মা সবাইকে মিষ্টি মুখ করালেন। তুর্য এদিক ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছে। মীরাকে খুঁজে চলেছে। এই মেয়েটা যেন তার সামনে আসতেই চায়না। ভার ক্লান্ত মন নিয়ে বসে আছে তুর্য।
–
নিজের রুমে শাড়ি পড়ে সেজেগুজে বসে আছে মীরা। তুর্যরা আসবে তাই ওর মা ওকে আজকে শাড়ি পড়ে রেড়ি হতে বলেছে। কিন্তু মীরা ভেবেই পাচ্ছেনা যে ওরা আসলে মীরাকে কেন শাড়ি পড়ে সাজতে হবে? এসব ভাবনার মাঝেই মীরার ভাবি এসে ধপ করে বসে পড়ল মীরার পাশে। মীরা চমকে উঠে বলল, “কি হলো?”
মীরার ভাবি মুচকি হাসলো। “তুর্য ভাই দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।”
মীরা চুপ হয়ে গেলো। তখন মীরার ভাবি বলল, “তোমাদের বিয়ে তো খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছে। দশ দিন পর তোমাদের বিয়ে হবে।”
মীরা চমকালো। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? “বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো না?”
“আরে, ননদিনী। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয় ততো ভালো বুঝলে? আমি যাই। তুর্য ভাই এলো বলে।”
মীরার ভাবি চলে গেলো৷ মীরার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। শাড়ির আঁচলের কোণা নিয়ে হাতের আঙ্গুলে প্যাঁচাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে ওর সিদ্ধান্তটা ভুল। মীরা ঘামছে। তুর্যর ভালোবাসাকে সম্মান দিতে গিয়ে আবার নিজের মনের বিরুদ্ধে যাচ্ছে না তো সে?
তুর্য ধীর পায়ে এগিয়ে এলো মীরার কাছে। শাড়ী পড়ে কতটা কোমল আর স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ওকে। মীরাকে ঘামতে দেখে কপাল কুচকালো তুর্য। তারপর আস্তে করে মীরার পাশে বসলো সে। জিগ্যেস করল, “কোনো সমস্যা? কেমন যেন লাগছে তোকে।”
মীরা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। মীরা ধীর কন্ঠে বলে, “তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে তুর্য ভাই। আমার বন্ধু হিসেবে এসব তোমার জানা জরুরী।”
তুর্য মীরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “বল, আমি সব শুনতে রাজি আছি।”
মীরা নিজেকে তৈরি করছে। তুর্য তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। “আমার জন্য তোমার মনে যেই অনুভূতি হয়, ঠিক সেই অনুভূতি আমার অন্য একজনের প্রতি হয়।”
কথাটা শোনার সাথে সাথেই মীরার হাত তুর্যর মুঠোয় থেকে আলাদা হয়ে গেল। কেউ যেন তার হৃদপিন্ড খন্ড খন্ড করে দিল। মীরার এ কথায় তুর্য যেন নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেছে।
“আমি তো তোকে জোর করিনি মীরু! তাহলে কেন তুই আমার প্রপোজ অ্যাকসেপ্ট করলি? কেন আমায় বললি না তোর মনে অন্য কারো বসবাস?”
তুর্যর প্রশ্নের জবাবে মীরা বলে, “তুমি আমার পুরো কথাটা শোনোনি তুর্য ভাই। আমি তাকে পছন্দ করি এটা সত্যি। কিন্তু সে আমাকে এড়িয়ে চলে, আমাকে সে পছন্দ করে না তুর্য ভাই। আমি তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, সে আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। আর মনে হয়না সে দিবে। এখন তুমিই বলো, যে আমাকে এড়িয়ে চলে আমি তার কথা ভেবে বসে থাকব, নাকি যে আমাকে ভালোবাসে তার ভালোবাসাকে আমি সম্মান জানাবো? আমরা খুব ভালো বন্ধু তুর্য ভাই। আমার মনে হয় আমরা একসাথে থাকতে থাকতে আমাদের মাঝে সুন্দর একটি ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হবে। শুধু আমার সবটা মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। তবুও তুমি চিন্তা করো না। আমি সামলে নিব সবটা।”
মীরার কথায় তুর্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেও তুর্যর মনে আঘাত এখনো রয়ে গেছে। তুর্য জিগ্যেস করলো, “তুই কাকে ভালোবাসিস মীরু? বলবি আমায়?”
“থাকনা তুর্য ভাই। আমি তার নামও কল্পনায় আনতে চাইনা। ভুলে যেতে চাই তাকে। সে যতক্ষণ আমার মস্তিষ্কে থাকবে, তাকে ভোলা ততটাই কঠিন হয়ে যাবে।”
“এখন আমি কি করব মীরু?”
“কি জন্য এসেছিলে সেটা কম্পিট করো। আমার মনে হলো তোমায় এই বিষয়টা জানানো উচিৎ তাই জানালাম।”
তুর্য মীরার বাম হাতটা নিজের হাতের উপর রাখলো। তারপর হাতের মধ্যমা আঙুলে একটা ডায়মন্ড রিং পরিয়ে দিল। মীরা অবাক হয়ে তুর্যর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল, “এটার তো অনেক দাম তুর্য ভাই।”
তুর্য স্মিত হাসলো। “তোর হাসির চেয়ে বড়ো দামী আমার কাছে আর কিচ্ছু নেই মীরু।”
মীরা বড়বড় চোখে তাকালো। কি সুন্দর করে কথা বলে তুর্য। এই ছেলেটার সাথে যত জড়াচ্ছে ততো মনে হচ্ছে সে ছেলেটাকে ঠকাচ্ছে।
তুর্য উঠে দাড়ালো। দু কদম পা সামনের দিকে বাড়িয়ে আবার থেমে গেল। পিছন ফিরে তাকিয়ে মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে মীরু৷”
কথাটা বলেই এক মুহুর্ত দেরি করলো না সে। দপাদপ পা ফেলে চলে গেল। মীরা ফিক করে হেসে দিল। তুর্যকে ভালোই লাগে তার কাছে। কিন্তু তার প্রতি বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি হয়নি মীরার মনে। মীরা চোখ বুঝলো! সে জানে না সামনে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য। জীবনের প্রতিটি সময়ই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জীবনকে গোছানো বাকি। এভাবে চলতে পারে না। তুর্যর জন্য নিজেকে গোছাবে। তুর্যর মনের মতো বউ হবে।
–
মীরাদের বাসায় আজ যেন খুশীর বন্যা বইছে। বিয়ের তোরজোর শুরু হলো। আর মাত্র কিছুদিন। এরপরই মীরার সাথে তুর্যর বিয়ে। মিরাজ যেন একজন আদর্শ ভাই। বোনের বিয়ে নিয়ে সবার থেকে তারই বেশি মাথা ব্যথা। অন্যদিকে একটা খুশির সংবাদ পাওয়া গেছে। মীরার ভাবি স্নিগ্ধা অন্তঃসত্ত্বা। ঘর আলো করে খুব শিগ্রই নতুন সদস্য আসবে। বাসায় দুটো খুশির সংবাদ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা সবাই। মীরার নানুর বাড়ির সবাই আসবেন বলেছেন বিয়েতে। দুই ছেলে মেয়ের একসাথে বিয়ে হচ্ছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? অন্যদিকে তুর্য সবসময় মীরাকে কল দিয়ে যাচ্ছে। মীরার কিছু করার নেই। তুর্যকে তার সময় দিতে হবে। শপিং মলে যাচ্ছে, আর এটা ওটা দেখাচ্ছে ভিডিও কলে। মীরা তুর্যর পাগলামি দেখে হাসতে থাকে। ছেলেটা মারাত্মক পাগলামি করে। মীরার সব পছন্দ তুর্যের জানা। তবুও সে তাকে দেখিয়ে নিচ্ছে। বিয়ের শপিং এখনো বাকি। মীরাসহ করবে বলে তুর্য ঠিক করে। মীরাও রাজি হয় তুর্যর সাথে যাওয়ার জন্য।
চলবে…