#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছে মীরা। আজ দুদিন হলো সে হসপিটালে যায়নি। শুনেছে তুর্যর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। শুনেই মীরার খুব খারাপ লেগেছে। বিছানায় দুই হাটু ভাজ করে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে মীরা। সে কোনো দিক খুঁজে পাচ্ছেনা। মিরাজ এসে মীরার রুমের দরজা নক করে। মীরা আওয়াজ শুনে দরজায় দৃষ্টিপাত করলো। ভাইকে দেখে বলল, “কিছু বলবি?”
মিরাজ রুমে এসে বোনের পাশে বসলো৷ বোনের মাথায় হাত দিয়ে জিগ্যেস করল। “তুর্যর জন্য মন খারাপ? কি হয়েছে বললি না। সেদিন ওভাবে বাসায় চলে আসার জন্য তাড়াহুড়ো কেন করেছিস?”
মীরা চুপ করে রইলো। ভাইয়াকে বলা কি ঠিক হবে? কিন্তু সে গোপন রাখলো না। বলেই দিল তার ভাইকে। মিরাজ সব শুনে চিন্তিত হয়ে গেল। মিরাজ বলল, “কি বলিস! তুর্য হঠাৎ এসব বলল কেন?”
মীরা বলল, “জানিস ভাইয়া। আমি ব্যর্থ! একজন আমাকে ভালোবেসে জীবন মৃত্যুর মাঝখানে লড়াই করছে। আর আমি তাকে ভালোই বাসতে পারলাম না।”
মিরাজ বলল, “মন খারাপ করিস না। ভালোবাসা হলো এমন এক অনুভূতি, যা সবার প্রতি আসে না। আর যার প্রতি আসে তাকে ভুলে থাকাও যায়না।”
ভাইয়ের কথা শুনে মীরা শুকনো ঢোক গিললো। সে তো ভুলে থাকতেই চাইছে। কিন্তু ভোলা যাচ্ছেনা তাকে। মিরাজ আবারো বোনের মাথায় হাত রেখে বলল, “চল, আমরা এখন হসপিটালে যাব।”
“তুর্য ভাই আমাকে দেখলে রাগ করবে না তো?”
“কেন করবে? চলতো। আমি আছি।”
মীরা উঠে রেড়ি হয়ে নেয়। ভাইয়ের সাথে মিলে হস্পিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো সে।
.
তুর্য এখন ক্ষানিকটা কথা বলতে পারলেও তার অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা করে তার। হসপিটালের বিছানায় শুয়ে জীবন্ত লাশের ন্যায় দিন পার করছে সে। এই নিয়ে তুর্যর আক্ষেপ এর শেষ নেই। ডাক্তারেরা আশংকা করছেন তুর্যর হাতে খুব বেশি সময় নেই। তুর্যর নিজেরও জানা হয়ে গেছে সে আর এই পৃথিবীতে থাকবে না।
মিরাজ মীরাকে নিয়ে হসপিটালে আসলো। তুর্যর কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো ভেতরে ডাক্তার আছে কিনা। ডাক্তার নেই দেখে মিরাজ মীরাকে বলে, “তুই ভেতরে যা। আমি ডাক্তারকে নিয়ে আসছি। তুর্যর কি অবস্থা জানা যাবে।”
মীরা মাথা নাড়ালো। মিরাজ ওখান থেকে প্রস্থান করলো। মীরা গুটি গুটি পায়ে তুর্যর কেবিনে ঢুকলো। তুর্য তখন জেগে ছিল। মীরাকে আসতে দেখে সে খুশী হয়ে যায়। কিন্তু সে তার এই আনন্দটা প্রকাশ করতে পারে না। মীরা তুর্যর পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। বলল, “তুর্য ভাই!”
তুর্য জবাবে বলল, “বোস। তোর সাথে অনেক কথা আছে।”
মীরা একটা চেয়ার টেনে তুর্যর সামনে বসলো। তুর্য বলল, “শপিংমলের একটা দোকানে এক জোড়া নুপুর দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, নুপুরজোড়া তোকে বিয়ের রাতে নিজ হাতে পড়িয়ে দিব। কিন্তু শপিং শেষে আর মনে ছিলো না। যখন বাইরে এলাম, মনে পড়ল। তাই তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম সেখানে। যদি আমার আগে কেউ ওগুলো নিয়ে নেয়। হয়েছিলও তাই। আমি গিয়ে দেখি একটা ছেলে হাতে ধরে দেখছে বারবার নুপুরগুলো। আমি তাকে অনুরোধ করলাম এটা না নিতে। কিন্তু ছেলেটার খুব জেদ। সে এগুলোই নিবে। তার সাথে তর্কাতর্কি হলো কিছুক্ষণ। এরপর দোকানদার নিজেই ওগুলো কারো কাছে বিক্রি করবে না বলে দিল। অনেক জোর করেছিলাম তাকে যেন ওই নুপুরজোড়া আমায় দিয়ে দেয়। আমি ডাবল দাম দিব। কিন্তু না, সে রাজিই না। বাধ্য হলাম চলে আসতে। আসার সময় একটা আওয়াজ পেলাম প্রেসার কুকারের মতো সিটি দিচ্ছিল যেন। আমি সেদিকে এগুতেই ধুম করে একটা আওয়াজ হলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল চারিদিকে। আমি যেন আগুনের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। বারবার চোখের সামনে তোর চেহারাটাই ভেসে আসছিল। তারপর আমার আর কিচ্ছু মনে নেই মীরু।”
তুর্য ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কথাগুলো বলতে তার খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু সে নিরুপায় ছিল। তাকে যে তার প্রিয়তমার সাথে কথা বলতেই হবে। মীরা এতক্ষণ তুর্যর কথা শুনছিল। শুনেই গা শিউরে উঠল তার। চোখ বন্ধ করে নিল সে। কি ভয়ানক, কি মর্মান্তিক! কতটা যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তার। তুর্য বলল, “এ জন্মে তোকে পাওয়া হলো না মীরু। হয়তো এর জন্যই তোর অনামিকা আঙ্গুলে সেদিন আংটি পরাইনি আমি। আমার দেওয়া আংটিটা যত্ন করে রাখিস মীরু। ভাববি আমি সবসময় তোর সাথে আছি। আংটিটা আঙ্গুল থেকে খুলিস না কখনো। নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে সুখে থাকিস।”
মীরা ধরা গলায় বলল, “কি বলছ এসব তুমি তুর্য ভাই? তুমি সুস্থ হয়ে যাবে দেখো। এভাবে কেন কথা বলছ!”
“এটাই সত্যি মীরু। জানিস, আমার একটা আফসোস থেকে যাবে। আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে পেলাম না। তাকে বিয়ে না করেই জীবন ত্যাগ করতে হবে আমাকে। শোণ মীরু, আমি চলে যাওয়ার পর তুই কিন্তু একদম কাঁদবি না।”
মীরা হু হু করে কেঁদে উঠল। কাঁন্নার আওয়াজ তীব্র গতিতে বাড়তে লাগল। কেঁদে কেঁদে বলল, “প্লিজ চুপ করো তুর্য ভাই। এভাবে বলো না তুমি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সহ্য করতে পারছিনা।”
“অনেক কিছুই তোকে সহ্য করতে হবে মীরু। ভেঙে পড়িস না। জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা আসবে। শক্ত হয়ে থাকবি। মাটি কামড়ে পড়ে থাকবি, তবুও হাল ছাড়বি না।”
মীরা কাঁদছে। একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে হাসপাতালে আজ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। অথচ কয়দিন আগেও সে ছিল হাসিখুশি, স্ট্রং একজন মানুষ। মীরা এসবের জন্য নিজেকে দ্বায়ী করছে। মীরার সাথে বিয়ে ঠিক না হলে হয়তো তুর্যর এসব হতো না। তুর্য বলল, “তোর সাথে আম খাওয়ার প্রতিযোগিতা আর হলো না। আমার নিশ্চিত জয়টা তুই হতে দিলি না সেদিন। পঁচা মেয়ে একটা।”
মীরা শুধু তুর্যর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই অবস্থায় কেউ মজা করে? তুর্য বলল, “আহানকে কবে থেকে পছন্দ করিস মীরু?”
মীরা চমকালো! তুর্যর মুখে আহানের নাম শুনতেই তার মুখটা মলিন হয়ে গেল। তুর্য কি তবে আহানের ব্যাপারে জেনে গেল? মীরা চোখের পলক ঝাপটাচ্ছে বারবার। আর ভিতরে ভিতরে অনেক কিছুই ভাবছে সে। তুর্য মীরাকে দেখে মুচকি হাসলো। বলল, “ভয় পাচ্ছিস? ভাবছিস কিভাবে জেনে গেলাম!”
“তুমি আমার পুরো কথাটা শোনো…”
“শুনেছিলাম তো। তুই বলেছিলি আমায়, তুই কাউকে পছন্দ করিস। কিন্তু সে যে আহান তা আমি জানতে পারলাম তোর মেসেঞ্জার চেক করে। সেদিন তোর ফোনটা আমার কাছে ছিল। একটা কল দেওয়ার জন্য তুই লক খুলে দিয়েছিলিস আমাকে, আমি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তোর মেসেঞ্জার চেক করে নিলাম। দেখলাম তোর সাথে আহানের কথোপকথন। তোর লাস্ট লেখাটা পড়লাম, ‘আমার জন্য আপনার মনে কি কোনো অনুভূতি আছে ইনিস্পেক্টর সাহেব!’ আহানের কোনো উত্তর নেই। এইজন্যই বোধয় তুই আপসেট। তুই তার উত্তর না পেয়েই আমার প্রপোজ অ্যাকসেপ্ট করেছিস। তোর কোনো দোষ নেই মীরু৷ তুই আমাকে সব জানিয়েছিস।”
মীরা কিছু বলার আগেই ওখানে মিরাজ চলে আসে ডক্টর নিয়ে। মিরাজের মুখটা মলিন হয়ে আছে। হয়তো সেও জেনে গেছে তুর্যর ব্যপারে। মীরা চেয়ার থেকে উঠে যায়।
ডাক্তার তুর্যকে ভালো করে দেখে। তবে কিছু না বলেই বৃদ্ধা আঙুল উপরে তুলে মলিন হেসে চলে যায়। মীরা বুঝলো না ডাক্তারের ভঙ্গি। তুর্য মীরাকে বলে, “মীরু একটু বাহিরে যা, আমি তোর ভাইয়ের সাথে কথা বলব।”
“আমার সামনে বললে কি হয়?”
“আমি তোকে যেতে বলেছি।”
মীরা কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে চলে যায়। তুর্য তখন মিরাজকে বলে, “আহানকে কল করে আসতে বল, আমি ওর সাথে কথা বলব।”
“আহানকে কি প্রয়োজন? তাছাড়া ও এখন ডিউটিতে।”
“যখন ডিউটি শেষ হবে, এখানে আসতে বলিস। এখন ফোন দিয়ে জানা।”
মিরাজ আহানকে কল দিল। বলল তুর্য তাকে আসতে বলেছে, সে যেন ডিউটি শেষ করেই এখানে আসে।
___
রাত নয়টা। আহান এসেছে হাসপাতালে। তুর্যর কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে তুর্য ছাড়া কেউ নেই। বাহিরে তুর্যর বাবা মা ও মীরার বাবা বসে আছেন। আহান প্রথমে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করলো। তারপর তুর্যর কেবিনে ঢুকলো। তুর্যকে তখন ঔষধ দেওয়া হচ্ছিল। আহানকে দেখে তুর্য দরজার দিকে তাকায়। নার্স ঔষধ খাইয়ে চলে যায়। আহান তুর্যর কাছে এসে বসে। জিগ্যেস করে, “এখন কেমন আছেন তুর্য?”
“বেশ ভালো। তুর্য জবাব দেয়।
আহান বলে, ” মিরাজ বলল আপনি নাকি আমায় ডেকেছেন?”
“হ্যাঁ। কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”
“কি?”
“আমি আর মাত্র কয়েকদিনের অতিথি। আমি চলে যাওয়ার পর তোমায় একটা কাজ করতে হবে।”
আহান একটু ভ্রু কুচকে নিল। কয়েকদিনের অতিথি মানে কি বুঝালো তুর্য?
“কি কাজ করব?”
“মীরাকে তোমায় বিয়ে করতে হবে।”
তুর্যর কথা শুনে আহান বসা থেকে সোজা দাঁড়িয়ে যায়। বলে, “এসব কি বলছেন? উনি আপনার বাগদত্তা। ওনাকে আমি কিভাবে বিয়ে করব?”
“আমি জানি মীরা আমার বাগদত্তা। কিন্তু আমি তো মারা যাবো। তখন মীরার কি হবে?”
“আপনি কি বললেন? মারা যাবেন!”
“হুম, জানো আমার কথা বলতে খুব কষ্ট হয়। তবুও যেগুলো না বললেই নয়। আমার শেষ ইচ্ছাটা তুমি রাখবে আহান? মীরাকে আমি ভালোবাসি। আমি ওকে পাইনি তো কি হয়েছে, আমি চাই ও সুখে থাকুক। আর তুমি ওকে সুখে রাখতে পারবে। কারণ মীরা তোমাকে পছন্দ করে। আমি সব জানি। দেখো, মীরা হয়তো এখন রাজি হবে না। তবে সব সামলানোর দায়িত্ব তোমার।”
“এসব কি বলছেন? আমি এভাবে অন্য একজনের বাগদত্তাকে বিয়ে করতে পারব না। এটা অন্যায়। আর উনার মত না নিয়েই আপনি এটা কিভাবে বলতে পারেন?”
“আমি আমার প্রিয় মানুষটার জন্য সব করতে পারি।”
“মাপ করবেন। আমি আপনাদের মাঝে আসতে চাইনা। আমি চাইনা আমার জন্য আপনাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব আসুক৷ উনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন উনাকে নিয়ে আমার অনুভূতি কি। আমি ওনাকে আবেগে ভাসাতে চাইনি। চাইনি মিরাজ আর আমার বন্ধুত্বে কোনো ফাটল ধরুক। তাই ওনাকে কোনো জবাব দেইনি। ওনার সামনেও আসা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি পারব না। এটা অন্যায় হয়ে যাবে। ওনার সাথে অন্যায় হবে, আপনার সাথে অন্যায় হবে।”
“কোনো অন্যায় হবে না। ভালোবাসার মানুষটাকে সুখী দেখা কি অন্যায়?”
“উনি আমার সাথে সুখী থাকবেন না। উনি আপনার সাথে ভালো থাকবেন।”
“আমিতো চলেই যাব।”
“আমি আসছি।”
“এই মৃত্যুর পথযাত্রীর শেষ ইচ্ছাটা তুমি রাখবে না ভাই?”
আহান আটকে গেল৷ ও কোথায় যাবে? ও যেটা থেকে নিজেকে পিছু ছাড়াতে চাইছে, সেটা কেন বারবার তার সামনে আসছে?
“আপনি ভুল বুঝবেন না। শুধু আমার ইচ্ছেতেই সব হবে না।”
“মীরাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।”
আহান কিছু বলল না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে কল দিয়ে মিরাজকে জানালো, মীরাকে বিয়ে করার জন্য তুর্য তাকে রিকুয়েষ্ট করেছে। কথাটা শুনে মিরাজের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তুর্যকে হারাবে এটা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে তার। তুর্য কত কিছুই না ভেবে যাচ্ছে তার বোনের জন্য। এই ছেলেটা কিভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে তিলে তিলে।
চলবে…