#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১৯ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
ঘুমের মধ্যে মীরার মনে হচ্ছে তার গালে নরম তুলতুলে পশম জাতীয় কিছুর ছোঁয়া লেগেছে। মীরা পিটপিট করে চোখ খুলে দেখে একটা সাদা বিড়াল তার খুব কাছে বসে তার গালে পা দিয়ে রেখেছে। মীরা বিড়াল দেখেই এক চিৎকারে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠল। গুটিশুটি মেরে বিছানার এক কোণে বসে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। এদিকে মীরার চিৎকার শুনে দ্রুত আহান মীরার কাছে আসে। সে দেখে মীরা ভয়ে এক কোণে কাঁপছে। এই সিচুয়েশনে আহানের বোধগম্য হচ্ছে না যে সে কি করবে। হাসবে না মীরাকে বোঝাবে। আহান গিয়ে বিছানার এক পাশে বসলো। মীরা আহানকে বলল, “সরান প্লিজ। ওটাকে সরান। আমাকে কামড় দিবে।” আহান বাঁকা হেসে বলে, “ও আপনাকে কিছুই করবে না মিস।”
মীরা করুণ চোখে আহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহান এক হাত বাড়াল বিড়ালটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বিড়ালটা আহানের কাছে এসে সোজা কোলে বসে পড়ল। আহান তার গায়ে হাত বোলাতে থাকল। এই দৃশ্য দেখার পর মীরা অবাক হলো প্রায়। মীরা বলল, “আপনাকে কামড় দিবে না?”
আহান বলল, “ও আমার পোষা বিড়াল। ও নাম পিয়াওমি।”
মীরা চোখ সরু করে নিল। অস্পষ্টসুরে বলল, “পিয়াওমি?”
আহান বলল, “হ্যাঁ। ও আপনাকে কিছুই করবে না। বরং আপনার সঙ্গী হবে। আপনার সাথে থাকবে। ছুঁয়ে দেখবেন?”
মীরা ঢোক গিলে নিল। সে ভয় পাচ্ছে। আহান বলল, “একটু ধরুন। কিচ্ছু করবে না।”
মীরা কাঁপা কাঁপা হাতে বিড়ালটাকে ছুঁলো। বিড়ালটা তাকে কিছুই করলো না। অনেক শান্ত হয়ে রইলো। আহান তখন বিড়ালটাকে বলল, “পিয়াওমি? এটা তোমার নতুন ফ্রেন্ড। হ্যান্ডশেক করো।”
সাথে সাথেই বিড়ালটা তার একটা পা বাড়িয়ে দিল মীরার দিকে। মীরার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। সেও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। আহানকে বলল, “এতো কিউট কেন এই বিড়ালটা?”
মীরা হাসছে। বিড়ালটাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। মীরার হাসির দিকে আহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলছে, “আপনার ঠোঁটের কোণে এভাবেই হাসির রেখা ফুটে উঠুক মিস। আপনাকে হাসিতেই মানায়।”
আহান পিয়াওমিকে রেখে ওখান থেকে চলে গেলো। মীরা পিয়াওমির সাথে খেলছে বেশ।
কিছুক্ষণ পর আহান আসলো ব্রেকফাস্ট নিয়ে। মীরার পাশে বসে বলল, “ব্রাশ করে হাত মুখ ধুঁয়ে আসুন। ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছি।”
মীরা পিয়াওমিকে ছেড়ে দিয়ে আহানকে বলল, “কাল রাতে খাবার দিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলেন? আপনাকে আর দেখিনি।”
“থানায়।”
“হঠাৎ থানায়? তাও আবার এতো রাতে?”
“ছিল কিছু কাজ। বাদ দিন। যান ব্রেকফাস্ট করবেন, ফ্রেশ হয়ে নিন।”
মীরা উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। আহান সুন্দর করে খাবার সার্ভ করে দিল মীরাকে। মীরা খেতে খেতে বলল, “আপনি খাননি?”
“হুম খেয়েছি।”
“আচ্ছা।”
“আপনাকে আর নিচে যেতে হবে না। খেতে ইচ্ছে করলে আমার রুমে কিচেন আছে, ওখানে রান্না করে কিছু বানিয়ে খাবেন। আর যদি রান্না করতে না পারেন, তাহলে আমাকে বলবেন; আমি রান্না করে দিব।”
মীরা ভ্রু উপরে তুলে নিল। অবাক হলো বেশ। জিগ্যেস করল, “নিচে যেতে নিষেধ কেন?”
“আমি চাইনা আপনি ওই মহিলার সামনে যান।”
“উনি আপনার মা হন।”
“আমার মা একজনই, আর সে মারা গেছে।”
“তাহলে এগুলো কোত্থেকে নিয়ে এসেছেন?”
“বাবার কড়া নির্দেশ, নিচ থেকে যেন আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি। তাছাড়া কিচেনে যাওয়া হয়নি।”
“আপনি কি নিজে রান্না করে খান? একা একা! আপনার বাবা কিছু বলে না?”
“নাহ্। আমি আর মতো চলতে পছন্দ করি।”
“অহ্।”
মীরা খাচ্ছিল। হঠাৎ নজর পড়ে হাতের মধ্যমা আঙুলের দিকে। তুর্যর দেওয়া ডায়মন্ড এর রিংটা কি সুন্দর ঝলঝল করছে তার হাতে। মীরা রিং টাকে ধরে চোখ বুঝল। মনে মনে বলল, “তোমার দেওয়া এই স্মৃতিটা আমি আজন্ম আমার কাছেই রাখব তুর্য ভাই। কখনো হাত থেকে খুলব না। তুমি তো আমার সাথেই আছো।”
মীরার ধ্যান ভাঙে আহানের ডাকে। আহান মীরার সামনে একটা বাক্স রাখে। মীরা ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে, “এটা কিসের বাক্স?”
“এখানে আমার মায়ের গহনা আছে।”
আহান বাক্সটা খুলে তার মধ্যে থেকে একটা স্বর্ণের আংটি নিয়ে আহান মীরার হাতের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিল। মীরা অপ্রস্তুত ছিল। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না।
“এগুলো আজ থেকে আপনার।”
“আপনি রেখে দিন। এতো গহনা দিয়ে আমি কি করব? আমি এতো গর্জিয়াস গহনা পরি না।”
“আচ্ছা, তবে আপনি কিন্তু এগুলো একবার হলেও পড়বেন।”
“ঠিকাছে, আমি চেষ্টা করব।”
তাদের কথার মাঝে একটা ছেলে দৌড়ে এসে আহানকে জড়িয়ে ধরে। মীরা চমকে উঠে। ছেলেটি আহানকে বলে, “আই মিস ইউ ভাই। স্যরি বিয়েতে আসতে পারিনি।”
“ছাড় আমাকে। তোর ভাবি আছে।”
ছেলেটি আহানকে ছেড়ে মীরার দিকে তাকায়। দুজন দুজনকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলে, “তুমি?”
আহান দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। দুজনেই রেগে আছে। আহান ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে, “কি হয়েছে?”
ছেলেটা বলে, “এই মেয়ে এখানে কি করছে ভাইয়া?”
“ও তোর ভাবি।”
তখন মীরা বলে, “এই ছেলেটা কে আহান?”
“আমার ভাই।”
“ওই ঝগড়ুটে ছেলেটা আপনার ভাই?”
“অ্যাঁই, মুখ সামলে কথা বলো। তুমি ঝগড়ুটে, আমি না।”
আহান বিরক্ত হয়ে বলে, “কি হয়েছে বলবি?”
তখন মীরা বলে, “আমি তখন নতুন নতুন কলেজে উঠি। হঠাৎ একদিন ওর সাথে আমার ধাক্কা লাগে। নিজেই বেপরোয়ার মতো হেটে যাচ্ছে, তারউপর পুরো দোষটা আমার ঘাড়ে দিল। ওই সময় প্রচুর ঝগড়া হয়েছিল। তারপর থেকে যখনই আমাদের দেখা হতো ঝগড়া হতো। একে অপরের নাজেহাল অবস্থা করতাম।”
“কি সাংঘাতিক! অ্যাঁই শোণ, আজ থেকে ঝগড়া বন্ধ। দুজন মিলে মিশে থাকবা। আমি যেন কোনো কিছু না শুনি। আয়ান? হ্যান্ডশেক কর ভাবির সাথে। স্যরি বল ভাবিকে।”
“আমি স্যরি বলব?”
“হ্যাঁ তুই বলবি।”
আয়ান দাঁত কিড়মিড়িয়ে মীরার দিকে তাকাচ্ছে। মীরা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে। আয়ান হাত বাড়াল হ্যান্ডশেক করার জন্য। মীরা হ্যান্ডশেক করে জোরে আয়ানের হাত চেপে দিল। আয়ান আহ্ শব্দ করে উঠল। আহান জিগ্যেস করল, “কি হলো আবার?”
“কিছুনা।”
আয়ান চলে গেল। মীরা মনে মনে হাসছে। এবার দেবর কে খুব জ্বালাতন করা যাবে। মীরা আহানকে জিগ্যেস করে, “বিয়েতে ওকে দেখিনি কেন?”
“ও ট্যুরে গিয়েছিল। বিয়েটা হুট করে হওয়ায় ও আসতে পারেনি।”
“আপনাদের দুজনের সম্পর্কেটা কেমন?”
“আমি কোনো দিন ওকে সৎ ভাই ভাবিনি। ওর মা’কে সহ্য করতে না পারলেও ওকে আমি ঠিকি নিজের ভাই বলে মেনে এসেছি। নিজের ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছি।”
“সুন্দর।”
_
দুপুরের দিকে মীরা নামাজ পড়ে বসে ছিল। ভালো লাগছে না বিধায় রুমের চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে। রুমের ডানপাশে একটা ওয়ারড্রব, একটা আলমারি। বামপাশে কিচেন। তার সাথে ওয়াশরুম। পশ্চিম-পূর্ব হয়ে উত্তর দিকে খাট সাথে একটা ট্রি টেবিল ও ড্রেসিং টেবিল। দক্ষিণ দিকে দরজা একটা পড়ার টেবিল ও একটা সোফা। বেশ ভালোই লাগল মীরার। রুমটাও বিশাল। খিঁদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে মীরার। আহান এখনো থানা থেকে আসেনি। মীরা রান্নাঘরের দিকে গেল। গিয়ে দেখে খাবার আছে কিনা। রান্নাঘরে একটা ফ্রীজ রয়েছে, একটা ছোট হাড়ি পাতিল রাখার আলমারি রয়েছে। একটা গ্যাসের চুলা, তার সাথে একটা বেসিন, প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র রাখা রান্নাঘর জুড়ে। আলমারি খুলে মীরা দেখল একটা ভাতের পাতিল, একটা কড়াই ও একটা তরকারির পাতিল। মীরা একটা প্লেট নিয়ে ভাত, সবজি ও মাছ ভাজি নিল। বিছানায় এসে তৃপ্তি ভরে খেল। অসাধারণ রান্না হয়েছে। রান্নাটা কি আহান করেছে? জিগ্যেস করবে সে। আগে খাওয়া শেষ করুক। খাওয়া শেষে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে মীরা। রান্নাঘরে গিয়ে বেসিনে প্লেট ধুঁয়ে ওটা জায়গায় রেখে রুমে চলে আসে মীরা। লাগেজ থেকে জামা কাপড় গুলো এখনো গুছিয়ে রাখা হয়নি। মীরা ভাবল, এই সুযোগে গুছিয়ে রাখা যাক। মীরা আলমারি খুলল। আলমারিতে তে তেমন কোনো জামা কাপড় নেই। মীরা লাগেজ থেকে সব বের করে আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে রাখছে। গোছানো শেষ হলে লাগেজটাও সে আলমারির নিচের ড্রয়ারে রেখে দেয়। এসব করতেই ঘাঁম বের হয়ে যায় মীরার। প্রসাধনী সব ড্রেসিং টেবিলের উপর গুছিয়ে রাখে। ব্যাস! তার কাজ শেষ। অতঃপর মীরার চোখ পড়ে ট্রি টেবিলের উপর। সেখানে আহানের ছবির পরিবর্তে তুর্যর ছবি দেখে বিশ্মিত হলো মীরা। ছবির ফ্রেমের নিচে চাপা দেওয়া একটা কাগজের টুকরো দেখল মীরা। সেখা তুলে ভাজ খুলে পড়ল, “তুর্য কোথাও যায়নি মিস। তুর্য আমাদের সাথেই আছে। আজ থেকে তুর্য এখানেই থাকবে।”
মীরা বারবার অবাক হচ্ছে। আহান রেখেছে এটা? অবিশ্বাস্য হলেও মীরাকে এটা মানতে হচ্ছে। মীরা ঠোঁট চেপে কাঁন্না আটকিয়ে রাখল। আহানের ভাবনাই অন্যরকম। আহানের মতো করে কেউ ভাবে না। কেউ না।
চলবে…